ছবির বামের অংশটি একটি বিখ্যাত ছবি, ১৯৬৪ সালে তোলা, “Early Morning Train in Japan”, ছবিটি ভোরের ট্রেনের। ছবিতে দেখা যাচ্ছে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া জাপানী তরুনদের।
ভ্রমনের সময়টুকুতে ঘুমিয়ে নিচ্ছে। যদি বলি আজ যে উন্নত জাপানকে আমরা দেখছি তার উন্নতির জন্য অনেকাংশে দায়ী এরকমই কিছু চিত্র তাহলে মানবেন? মানতেই হবে, কারন হিসেব সেরকমই বলে। সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু পরের, ষাট এর দশকের শুরুর দিকের। জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শোক কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে সে সময়। হঠাত কি এক কারনে এই সময়টাতে জাপানের জনসংখ্যা হঠাত খুব দ্রুত বাড়তে শুরু করল, আবার ১০ বছরের কম সময়ের মধ্যে ফার্টিলিটি রেট রিপ্লেসমেন্ট লেভেলে চলে গেল অর্থাৎ প্রতি নারী গড়পরতা প্রায় দুটি বাচ্চার জন্ম দেন এমন অবস্থা। এই দশ বছরে জন্ম নেয়া বাচ্চাগুলো পরবর্তী ১৫-২০ বছরে যুবক হয়েছে, কিন্তু দেশে নতুন অল্প বয়সী বাচ্চার সংখ্যা তেমন বাড়েনি। তাই ১৯৮০ সালে জাপানের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি ছিল কর্মক্ষম তরুন। তারা দেশের যেটুকু সম্পদ গ্রহন করত তার চেয়ে অনেক বেশি উতপাদন করত। এই যুবক বয়সী জাপান এর সময়কাল চলে ১৯৫০ থেকে প্রায় ২০০০ সাল পর্যন্ত। এই পঞ্চাশ বছরে জাপানী যুবকেরা কি করেছে সেটা আমরা আজকের জাপানকে দেখে বুঝি।
এমন উদাহরন কি শুধু জাপানে? চলুন আরো কিছু উদাহরন দেখি। পরাক্রমশালী বিজয়ী আমেরিকাতেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরেই বাচ্চাকাচ্চার বিস্ফোরন দেখা দেয়! ১৯৪৬-৬৪ পর্যন্ত। এরপর ফার্টিলিটি রেট ২ এর কাছাকাছি নেমে আসে। তাই একইভাবে জাপানের মতই ইউএসএ আরো আগেই তরুন জনগোষ্ঠীর আধিক্য টের পায়। এরাও ১৯৫০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তারুন্যের শক্তি টের পেয়েছে এবং সেটা তারা কাজে লাগিয়েছে সর্বোচ্চভাবেই। এই যে একটা দেশ তরুন জনগোষ্ঠী দিয়ে ভরে গেল, আর তারা তাদের সর্বোচ্চ আউটপুট দিয়ে দেশের জিডিপি বহুগুনে বাড়িয়ে দিল এই ঘটনার একটা খটমটে নাম আছে, Demographic Divident । অর্থনীতিবিদেরা মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর এই দেশগুলোকে বলেন এশিয়ান টাইগার, যদিও সবচেয়ে বড় টাইগার এই বঙ্গদেশের জাতীয় পশু। এই এশিয়ান টাইগারেরা খুব অল্পদিন আগেও জেলে জাতি ছিলো, অর্থনীতির মানদন্ড এই বাংলাদেশের তুলনায় ভালো কিছু ছিলো না। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯০ এই সময়টাতে এসব দেশে তারুন্যের আধিক্য ঘটে এবং তারা এটাকে এত চমতকারভাবে কাজে লাগিয়ে তাদের অর্থনীতিকে এত শক্তিশালী করে যে সারা বিশ্ব তাদের অর্থনৈতিক শক্তিকে এশিয়ান টাইগার নাম দিতে বাধ্য হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এখন এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যদিও তাদের দেশের একটি বিরাট অংশ দারিদ্র সীমার নিচে তবু তাদের অর্থনৈতিক শক্তি সারা বিশ্বেই সমীহ করার মত।
আমাদের এই ছোট্ট দেশটির দিকে তাকাই এবার। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ আশির দশকে এদেশে ফার্টিলিটি রেট ছিল ৭ এর উপরে, তার অর্থ হল প্রতিজন নারী প্রায় ৭ জন করে সন্তান জন্মদিতেন, তাই সে সময়ের জন্ম নেয়া সবার কমপক্ষে ৬-৭জন ভাইবোন থাকতই। এখন এই ফার্টিলিটি রেট ২.৩। বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুসারে আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট এর স্বর্ণালী সময়ে প্রবেশ করেছি গত বছর। আশি এবং নব্বই দশকে জন্ম নেয়া বাচ্চাগুলো এখন তাদের কর্মক্ষমতার শীর্ষে। দেশের প্রায় ৬৭ শতাংশ মানুষই এখন তরুন!! সম্ভাবনার ভোরের ট্রেন এখন আমাদের দোরগোড়ায়, শুধু উঠে পড়তে হবে এই জাপানী তরুনদের মত। আচ্ছা ট্রেনটা কতক্ষন থাকবে স্টেশনে? ২০৩৩ সাল পর্যন্ত একটা সময়ের কথা বলা হয় যে পর্যন্ত আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ তরুন জনগোষ্টীর মধ্যে থাকবে। এরপর, এই তরুনেরা বুড়ো হবে, তারা কর্মক্ষম থাকবে না এবং তাদের রিপ্লেস করার জন্য নতুন তরুনও খুব বেশি আসবে না কারন এখন আর আগের মত ৭-৮ জন শিশু জন্মায় না প্রতি পরিবারে। অর্থাৎ আমাদের এই তারুণ্যে শক্তিকে কাজে লাগানোর সময় ২০ বছরেরও কম। ২০ বছরে আমরা মালয়শিয়া সিঙ্গাপুর কিংবা জাপান হতে পারি, আবার ২০ বছরে আমরা বিপুল তরুন জনগোষ্টীকে বেকার বসিয়ে কিংবা গঠনমূলক কাজে না লাগিয়ে অক্ষম রাষ্ট্রে পরিনত হতে পারি।
আমাদের ভোরের ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে, আমাদের আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচানোর তরুনেরা এখনো স্টেশনে পৌছেছে কি? নাকি তারা স্টেশনে আগুন লাগাচ্ছে? সাফল্যের ট্রেনে বোমা মারছে, লাইন খুলে রেখে নস্ট করছে সব সম্ভাবনা? ১৬ কোটির ৬৭% হয় ১০ কোটি ৭২ লাখ। এই ১০ কোটি তরুনের মধ্যে কতজন সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বা মুশফিক আছে? এই ১০ কোটির মধ্যে কতজন ডক্টর ইউনূসের মত নোবেল বিজয়ী হবার সম্ভাবনা নিয়ে বসে আছে, কতজন বিল গেটস এর মত উদ্যোক্তা হবার মত সম্ভাবনাময়? মাত্র ৫৪ লক্ষ লোকের দেশ সিঙ্গাপুরে যদি মাত্র ১০০০০ জনও সফল মানুষ থাকেন তাহলে ১৬ কোটির এই দেশে সফল মানুষ হবার সম্ভাবনা ৩ লক্ষ লোকের। এখন আমরাই ঠিক করব এই ৩ লক্ষ লোক কি পেট্রোল বোমায় দক্ষ হবে নাকি নিজ যোগ্যতায় সফলতার চূড়ায় উঠে বাংলাদেশকে একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিনত করবে? এই সিদ্ধান্ত কে দেবে? যারা এখনো এই তরুনদের বিপথগামী করছে তারাই নাকি তরুনেরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে ক্রিকেটার সাকিব কিংবা বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম হবার? ১০ কোটি তরুনের সাফল্যের ট্রেন প্লাটফর্মে অপেক্ষায়……
তথ্যসূত্রঃ (উইকিপিডিয়া, ডেইলি স্টার, কোবে ইউনিভার্সিটি জার্নাল, জাপান)
লিখেছেন ঃ ডাঃ মারুফুর রহমান অপু, প্রতিষ্ঠাতা-প্ল্যাটফর্ম।