মনোরোগ পরিমিতি একনাগাড়ে অনেকক্ষন কথা বলে তিনি থামলেন , আমার দিকে তাকিয়ে পানি চাইলেন ৷ পানি দেয়া হল ৷ তার দীর্ঘক্ষণের দেয়া আবেগঘন এই ইতিহাসের মধ্যে মূলত কিছুই নেই, আছে শুধু তার মাদ্রাসায় পড়ার কারণে অন্যভাইবোনদের চেয়ে সে যে ভিন্নভাবে বড় হয়েছে এটা পরিবারের সদস্যরা মানতে চায় না ৷ দ্বন্দ্বটা দৃষ্টিভঙ্গির ৷ এর পরের অংশটা আসলেই লিখে রাখার মতো ৷ ” স্যার সেদিন আমরা একটা দামি রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম ৷ ছোট মামা অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছেন তিনি খাওয়াবেন ৷ আমার মেঝো ভাই মামার কাছ থেকে এই কস্টলি খাবার আদায় করতে এমন ব্যবস্থা ৷ ১৭ তলার ছাদে পৌঁছে আমি অভিভূত ও অবাক হলাম ৷ এটা কি আমাদের বাংলাদেশ !! সবুজ বাগান , ফাঁকে ফাঁকে বসার জায়গা ৷ পানির ঝর্ণার শব্দ মৃদু কানে লাগে ৷ ঝুলানো দোলনার কাছে ভিড় , বুড়া গুড়ারা ছবি তুলছে ৷ পুবাকাশে চাঁদ ঝুলে আছে ৷ অনেক বাতাস ৷ বাঁশ ঝাড় আর অন্যান্য গাছের গায়ে ফ্লাড লাইটের আলোর খন্ডাংশ ৷ মনে হচ্ছে চাঁদটাও এরাই বানিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা দানের জন্য ৷ আমরাও অন্যদের মতো নানান ঢঙের ছবি তুললাম , খেলাম – হাসি তামাসায় মাতলাম ৷ যে কাজটা আমি করিনা আজ কেন যে করলাম মাথায় আসছে না ৷ সিগন্যাল ক্রসের পরই আমার খারাপ লাগছিলো যার মাত্রা রেস্টুরেন্টের বিল পরিশোধের সময় আরও বেড়ে গেল ৷ মামার মতো বৃহৎ দিলের লোকও ছোট্ট করে বললেন – ঢাকায় এতো দামি খাবার করা খায় ! এ নিয়েও কতক্ষন কথা হল ৷ ফেরার সময় সিগনালে সেই বুড়ো লোকটাকে পেলাম ৷ সেই একই ভঙ্গিতে হাত পাতছে , গাড়িতে টোকা দিচ্ছে , মুখ বানাচ্ছে ৷ আড়াই ঘন্টা হয়ে গেছে – কি অমানসিক কষ্টের কাজ ! আমি আর নিজেকে সামলাতে পারিনি ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলেই মাইক্রোর স্লাইডিং ডোর বাম হাতে টান দিয়েই নেমে পড়লাম ৷ বুড়োকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলাম, একটা পাঁচশো টাকার নোট হাতে গুঁজে দিলাম ৷ বুড়ো প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও পরে বুঝতে পেরে আমাকে জোরে বুকে চেপে ধরে, কেঁদে দেয় ৷ আমি তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি যা দেখে মাইক্রোর যাত্রীসহ আসে পাশের লোকরা বিস্মিত হয় ৷ আমি দ্রুত মাইক্রোতে উঠি ৷ তখন থেকে যে শুরু হলো এখনো চলছে ৷ আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে – চিকিৎসা লাগবে ৷ অনেক মানসিক যন্ত্রনায় রেখেছে স্যার ৷ বুঝতেই চায় না যে সব মানুষের মানসিক গড়ন এক না ৷ কিভাবে বুঝাই বলুন স্যার ! মানসিক ডাক্তার দেখানো প্রসঙ্গে পরিবারের দুএকজন বিরোধিতা করাতে এই তিনদিনের বিলম্ব ৷ ” সে বার বার দরজার দিকে তাকালে আমি তাকে আশ্বস্থ করলাম ” আমার অনুমতি ছাড়া কেউ ঢুকবে না ৷” সে আবার শুরু করলো ৷ – স্যার যে কারণে আলাদা কথা বলতে চেয়েছি ৷ – বললেনতো ! – না স্যার ৷ আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে মানসিক রোগীর যে রোগ প্রথমে নির্ণয় হয় সেটাই চলতে থাকে , নতুন করে কেউ আর রিভিউ করে না ৷ অন্য ডাক্তারগণও এই ব্যবস্থাপত্র দেখলে যা আছে তাই লিখে দেয়, নতুন করে ভাবে না ৷ আমাকে যে ঔষধ দেবেন আমি খাবো ৷ কিন্তু স্যার কোনো রোগের নাম না লিখলেই ভালো ৷” আমি তার এ কথায় হতভম্ব হয়ে গেলাম ৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম ” আচ্ছা ” ৷ পার্টিকে ডেকে যখন বুঝিয়ে বলতে গেলাম ” ওনার তেমন কিছু হয়নি ৷ অফিসের ঝামেলা নিয়ে একটু বিচলিত আছেন ৷ কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা লাগবে না ৷ বাসায় নিয়ে যান , ভর্তিও লাগবে না ৷ ” এতে রোগীর আত্মীয়স্বজন খুশি হতে পারলেন না যেন ৷ বাজে আচরণ শুরু করলেন ৷ কে একজন বললেন ” এতক্ষন গোপন কথা কিসের ? তখনই আমার সন্দেহ হয়েছে ডাক্তারকেতো পটিয়ে ফেলছে !!” বলে বিলাপ করতে করতে পরিবেশ নষ্ট করার উপক্রম ৷ আমি তার ভাইর হাতে প্রেস্ক্রিপশনটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম ” ভালো থাকবেন ৷ উনি সুস্থ আছেন ৷ কাউকে জোর করে রোগী বানানো আমার কাজ নয়, এটা সামাজিক অপরাধ ৷ ” মুচকি একটা হাসি দিয়ে ফাহিম হাত নাড়িয়ে বাই বাই জানালো ৷ ওরা চলে গেলে আমি আরও কিচ্ছুক্ষন চেয়ারটায় চোখ বন্ধ করে বসে থাকলাম ৷
প্রফেসর ডা. মেজর ( অব.) আব্দুল ওহাব
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মুন্নু মেডিকেল কলেজ ৷
অনুলিখন : জামিল সিদ্দিকী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ,গাজীপুর