লিখেছেন ঃ অধ্যাপক মোহাম্মদ নাসিমুল ইসলাম
বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন, ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারা, মালয়েশিয়া।
ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ।
ভেবেছিলাম তনুকে নিয়ে আর কিছু লিখব না। কিন্তু “সোহাগী তনু ঃ ফরেনসিক মেডিসিনের অভিশাপ না অহংকার” আর্টিকেলটি বাংলানিউজ২৪.কম এ প্রকাশিত হলে একাধিক অভিনন্দনের পাশাপাশি ফেসবুকের ইনবক্সে পরিচ্ছন্ন একটি হুমকি পেলাম। হুমকিদাতা মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন “কুমিল্লা থেকে” আমাকে বাংলাদেশের মেডিকোলিগাল সার্ভিস নিয়ে কিছু স্তবকের পাশাপাশি আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা, বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশনের সাথে তার ভাষায় আমার মিসহ্যাপ তার জানা আছে বলে আমাকে মনস্ত্বাতিক চাপে রাখার হাস্যকর চেষ্টা চালাচ্ছেন। মেসেজের সাথে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানদের তালিকা সমৃদ্ধ বোর্ডের ছবি পাঠিয়েছেন যেখানে আমাকে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দেখানো আছে। ভুল ইংরেজীতে লেখা সেই মেসেজের জনক সাখাওয়াত হোসেন নামে বাংলাদেশের ফরেনসিক বিভাগে কর্মরত কাউকে আমি চিনি না অথবা সে নামে কেউ আছে বলেও আমার জানা নেই। তবে হুমকির তথ্য এবং ইন্ধনদাতা যে ফরেনসিক বিভাগের কেউ হবেন তাতে সন্দেহের আপাতঃ কোন কারণ নেই। কেননা, আমার সাথে পিএসসি এর দ্বন্দ যেমন তার জানার কথা নয় তেমনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানদের তালিকা সমৃদ্ধ বোর্ডের ছবিও তার পাবার কথা নয়। তিনি অথবা তার ইন্ধনদাতা হয়ত জানেন না, পিএসসির সাথে আমার সেই দ্বন্দ সততার সাথে মোকাবিলা করেছি বলেই আমার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ প্রত্যাহার করে আমার অনুরোধে মন্ত্রণালয় আমাকে অবসর সুবিধা দিয়েছে। এটি আমার সততার সুফল।
সহযোগী অধ্যাপক পদবীতে থেকে নিজের নামের পূর্বে অধ্যাপক লিখা ছিল আমার ভুল যা সংশোধনের জন্য বাংলানিউজ২৪.কম কে অনুরোধ করেছি। আসলে প্রায় একযুগ ধরে অধ্যাপক পদে থাকায় ভুলটি হয়ে গেছে। ভুল ধরিয়ে দেয়ার জন্য উভয়কে ধন্যবাদ। আলোচিত হুমকি সম্বলিত মেসেজে আমাকে জানানো হয়েছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা না চাইলে বাংলাদেশে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য কোন স্যাম্পল পাঠানো যায় না, যা আমার জানা উচিত। তদন্তকারী কর্মকর্তা না চাইলে কেমিক্যাল টেস্টের জন্য যদি স্যাম্পল পাঠানো যায় তবে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য স্যাম্পল কেন পাঠানো যাবে না তা আমার বোধগম্য নয়।
শুনলাম, “সোহাগী তনু ঃ ফরেনসিক মেডিসিনের অভিশাপ না অহংকার” আর্টিকেলে তনুর ময়নাতদন্তে জড়িতদের আমি অর্ধ শিক্ষিত বলেছি বলে তারা গোস্বা করেছেন। আমার সে ধারণা সম্ভবত ভুল। ঘটনা সামাল দিতে তারা এখন একসঙ্গে বসে যেভাবে মিটিং সিটিং আর বিরিয়ানি ইটিং করছেন তাতে তাদের অর্ধ শিক্ষিত বললে বেশীই বলা হয়ে যাবে। ভুলে গেলে চলবে না, আলোচ্য ঘটনায়, তারা অন্যায় করে থাকলে শাস্তি পেতে পারেন,, ভুল করে থাকলে তা স্বীকার করে মাফ চাইতে পারেন আর ভুল না করে থাকলে বুক ফুলিয়ে যে যার প্রতিবেদন প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। এর কোন ব্যত্যয় হলে সারা জীবনের সঞ্চিত সম্মান নিমিষেই ভুলন্ঠিত হয়ে যাবে। এরকম চিকন এক তরবারির উপর তারা দাঁড়িয়ে আছেন বলেই আমি সেখান থেকে তাদের উদ্ধারে আমার সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলাম। ইংগিত দিয়ে বলেছিলাম, যে ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনের জন্য দ্বিতীয় পক্ষের ময়নাতদন্তকারীরা অপেক্ষায় আছেন, সেই প্রতিবেদনে চমক ছাড়া আশার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।
তনুর দেহ আর প্যান্টি নিয়ে চেইন অব কমান্ড না মেনে তো আর কম ঘাটাঘাটি হয় নি। ফলে তা কন্টামিনেশন হওয়ার প্রচুর সম্ভবনা রয়েছে। তাই যদি হয় তাহলে যে তিনজনের ডিএনএ সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তার একটি যদি প্রথম ময়নাতদন্তকারীর (আসলে হবে সিএমএইচ এ প্রথম মৃতদেহ পরীক্ষাকারী ডাক্তারের) হয়ে থাকে, তাতে আমি মোটেই অবাক হবো না। অবশ্য ঘাড়ানোর কিছু নেই। ভ্যাজাইনাল সোয়াবের ডিএনএ পচে গেছে, প্যান্টিতে ডিএনএর উপস্থিতি মানেই তো আর ধর্ষণ নয়। তাদের আশ্বস্ত করতে, জানিয়েছিলাম বিখ্যাত বক্সার মাইক টাইসনের গল্প যিনি যে বিছানায় একজন বিউটি প্যাজেন্টকে ধর্ষণ করেছিলেন সেই বিছানার চাদরে দুই শতাধিক মানুষের সিমেন (আসলে হবে ডিএনএ) সনাক্ত হয়েছিল, এর মানে এই নয় যে দুইশত মানুষ তার ধর্ষক ছিল!! আমার সে লেখায় দেয়া ইংগিত তারা বুঝতে পারেন নি ! তাই তারা জুগল বেধে খুঁজে ফিরছেন এমন এক পরামর্শ যাতে দুজনেরই কুল রক্ষা হয়! তারা কি নিজেদের ভুল বুঝতেও অক্ষম হয়ে পড়েছেন!!
আরো সোজা করে তাদের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা যাক। জানুন তনুর ঘটনায় একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে যা আপনাদের করা উচিত ছিল এবং যা আপনারা করেছেন। যদি কিছু বাদ পরে তবে, সেটাই মোদ্দা কথায় আপনাদের ভুল।
১। আত্মীয় এবং তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে ঘটনা নিয়ে আলোচনা এবং সুরৎহালের সাথে মিল অমিল সংশোধন।
২। ঘটনাস্থল পরিদর্শন আর সম্ভাব্য রহস্য সমাধানের সুত্র কালেকশন ।
৩। সিএমএইচ থেকে চিকিৎসার ফাইল এবং অন্তর্বাস এনে পরীক্ষা।
৪। ময়নাতদন্ত এবং তার প্রতিটি স্তরের একাধিক ছবি গ্রহণ ।
৫। সকল ধরনের স্টেইন পরীক্ষা (ডিএনএসহ)। ( পুলিশ ল্যাব এবং ফরেনসিক ল্যাব আলাদা আলাদা ভাবে এই পরীক্ষা করবে এবং কোন গড়মিল হলে তাৎক্ষনিক তৃতীয় ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা।)
৬। ময়নাতদন্ত শেষে তাৎক্ষনিকভাবে প্রাথমিক রিপোর্ট প্রদান ।
৭। সকল পরীক্ষার ফলাফল প্রাপ্তিতে মুল প্রতিবেদন দাখিল ।
প্রটোকলটি দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবেন এটি মেনে ময়নাতদন্ত করা খোদ বাংলাদেশে অসম্ভব নয়।
এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় কৃত ময়নাতদন্তের কোন প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। খবরে প্রকাশ, ডিএনএ প্রতিবেদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রতিবেদন দেয়া হবে, এই মানসিকতা পরিহার করা উচিত। এক্ষেত্রে প্রথমিক প্রতিবেদন প্রদান না করাটাই অনিয়ম। মনে আছে, ২০০২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে থাকাকালীন মন্ত্রণালয় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন প্রদানের সময়সীমা ৪৮ ঘন্টা বেধে দিয়ে আদেশ জারি করেছিল। সেই আদেশ এখনও বিদ্যমান কিনা জানা নেই তবে অনির্ধারিত অপেক্ষমান কাল মেনে নেয়া যায় না। এরকম অনিয়ম মেডিকোলিগাল সার্ভিসের অনিয়ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে কোন মামলায়, পুলিশ, ফরেনসিক আর অন্যান্য বিশেষজ্ঞগন এক অপরের পরিপূরক। উভয়েই সত্য উদ্ঘটনে সহায়তাকারী, যাদের মতামতের উপর ভিত্তি করে আদালত রায় দিয়ে থাকে। এখানে একজন যদি আরেকজনকে প্রতিপক্ষ ভাবেন তাহলে তা বিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি মনে রাখা উভয় পক্ষের জন্য শ্রেয়।
স্বনামধন্য এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেনসিক বিভাগের ভুল স্বীকার নিয়ে একটা সত্য ঘটনা বলেই আজকের লেখা শেষ করব। ময়নাতদন্ত শেষে ময়নাতদন্তকারী তার প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, “প্লীহা স্বাস্থ্যবান”, অথচ হাসপাতাল রেকর্ডে দেখা যায় বৎসর খানেক আগে মৃতের প্লীহা অপেরেশন করে ফেলে দেয়া হয়েছে। খবরের কাগজের মাধ্যমে ব্যাপারটি জানাজানি হলে ডাক্তার সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে। পরে ফরেনসিক ডাক্তার তার ভুল স্বীকার করলে আদালত এবং ডাক্তারসমাজ তা মেনে নিয়েছিলেন।
পরিশেষে বলব, নিজের ভুল বুঝতে পারলে তা স্বীকার করে মাফ চাওয়াই উত্তম। তবে ভুল না করে থাকলে বুক ফুলিয়ে নিজের দেয়া প্রতিবেদন প্রতিষ্ঠিত করুন। ময়নাতদন্ত মানেই হল, যা দেখেছি, যা পেয়েছি। সুতরাং রটনার পিছনে ঘটনা না থাকলে ভয় কেন?
যোগাযোগ ঃ [email protected]