প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -৯
” হার্টবিট (Heart beat) “
লেখক : আয়েশা আলম প্রান্তি
হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ।
হাসপাতাল করিডোর। ঘরিতে সময় ভোর ৬টা। ভোর বেলা সূর্যের রক্তিম আভা আর আকাশটা মিলে অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে। চোখ ধাঁধানো সুন্দর। হাসপাতালের শূন্য করিডোরে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছেন ডা:নাফিসা।নাফিসা এই হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক। সারা রাত নাইট ডিউটি করে খুব ক্লান্ত সে।একটি মেডিকেল কলেজ থেকে কিছুদিন আগে ডাক্তারি পাশ করে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করা শুরু করে নাফিসা।
“ঘুমাও নি রাতে?? ওটি এসিস্ট ছিলো না ইমার্জেন্সিতে ডিউটি?? ” বলতে বলতে এগিয়ে এলেন এপ্রন পড়া একজন চিকিৎসক। এই এপ্রন পড়া কর্তব্যরত চিকিৎসকের নাম ডা: আকাশ। আকাশ আর নাফিসা একই মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেছেন ও একই সাথে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে কর্তব্যরত আছেন। হঠাৎ আকাশকে দেখে নাফিসা অবাক হয় আবার মৃদু হেসে উঠে। হাসির কারনটা খুব হাস্যকর হলেও সত্যি।এই ভদ্রলোকের কথাই চিন্তা করছিলেন নাফিসা মনে মনে।। ” না ঘুম আসছে না, একবারে ডিউটি শেষ করে ঘুৃমাবো বাসায় গিয়ে।তুমি ঘুমাবা না?? নাকি দেশ, জাতি, সমাজের চিন্তায় ঘুম আসছে না আপনার!! ” আকাশের সাথে গল্প করতে শুরু করলেন। চুপ চাপ হাসপাতালের নির্জনতার মাঝেও তারা দুজন দুজনের সঙ্গ খুব বেশী উপভোগ করছেন, বুঝতে বাকী থাকলোনা দুজনের কারও।
আকাশ আর নাফিসা মেডিকেল কলেজের প্রথম দিন থেকে খুব ভালো বন্ধু।।ক্লাসের সবচেয়ে চুপচাপ শান্ত শিষ্ট লেজ বিশিষ্ট ছেলেটার বন্ধুত্ত হয় সবচেয়ে চন্ঞল, দুষ্ট মেয়েটার সাথে। ঘটনার প্রেক্ষাপট ২০১২ সাল।মেডিকেল এর প্রথম ক্লাস। এপ্রন পড়া নতুন মুখগুলো ক্যাম্পাসে এসেছে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। সকাল ৮ টার লেকচার ক্লাস চলছে। আকাশ সামনের সিটে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে এনাটমি লেকচার করছে। আজ প্রথম ক্লাস তাও এত কঠিন একটা বিষয়ে।সবাই খুব গভীর মনোযোগের সাথে বোর্ড আর প্রজেক্টরে তাকিয়ে প্রফেসরএর কথা বুঝার খুব চেষ্টা চলছে, যদিও অর্ধেকের বেশী পড়া মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে তাকিয়ে দেখে লেকচার গ্যালারীর বাইরে খুব সুন্দরী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। আকাশ সাধারনত মেয়েদের দিকে তাকায় না, না পারতে।কিন্তু ঐদিন কিছু সময় এর জন্য পুরা চুপ,অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে থাকে মেয়েটাকে। একটা মানুষ এত কিউট কিভাবে হয়!?? মিষ্টি চেহারা, সুন্দর হাসি, একটু পর পর গলার স্তেথোস্কোপ আর চুল ঠিক করছে হাত দিয়ে।ক্লাসে দেরী করে আসায় প্রফেসরের কাছে কি রিকোয়েস্ট!! এত কিউট করে কেউ সরি বলতে পারে জানা ছিলো না আকাশের। এই মুগ্ধকর মানবী ক্লাস শেষে এগিয়ে আসে আকাশের দিকে। ” এক্সকিউজ মি,লেকচার তুলেছো?? খাতা টা দিবা প্লিজ?? তুলবো? ” কথাপ্রসঙ্গে জানতে পারে মেয়েটার নাম নাফিসা সেদিন থেকে কথা বলা শুরু। তার পর বন্ধুত্ত বাড়তে থাকে কখনো ক্যান্টিন এ, কখনো ওয়ার্ডে রোগী দেখার ক্লাসে, কখনো লেকচার গ্যালারীতে কখনোবা আইটেম (ভাইভা) দেয়ার সময়।
মেডিকেলে প্রায় প্রতিদিন যা পড়ানো হয় তা পরদিন ভাইভা পরীক্ষার মতো ধরা হয়। এটাকে আইটেম বলে।নাফিসা প্রচন্ড ভয় পেত এই পরীক্ষাগুলা। আকাশ এর সাহায্যে পড়াশোনা অনেক সহজ হয়ে গেল আস্তে আস্তে।কিন্তু আকাশের জন্য ব্যাপারটা সহজ ছিলো না যখন সে জানতে পারলো যে মেয়েটাকে সে অনেক বেশী পছন্দ করে ফেলেছে তার একটা বয়ফ্রেন্ড আছে যে আমেরিকা থাকে।৫-৬ মাস পর পর দেশে আসে। মন ভেঙ্গে গেলেও নিজের প্রিয় মানুষটার খুশির জন্য চুপচাপ থেকে যায়। প্রেমিকা হিসেবেনা হলেও, ভালো বন্ধু হিসেবে থেকে যাক ভালবাসার মানুষটা পাশে।
দিন কেটে যায়।কেটে যায় বছর। মেডিকেলের চতুর্থ বর্ষে তারা এখন। দেখতে দেখতে প্রফ পরীক্ষা চলে। ২য় প্রফেশনাল পরীক্ষা। মেডিকেলে প্রতি দেড় বছর পর পর এই প্রফেশনাল পরীক্ষা হয়। দেড় বছর পর পর হওয়া এরকম ৩ টি প্রফেশনাল পরীক্ষাতে পাশ করতে পারলে তবেই মিলবে ডাক্তার নামের সার্টিফিকেট। আর সে পাশ মার্ক হলো ৬০%। পাগলের মতো সবাই পড়ে প্রতিটা পরীক্ষায়। আকাশের আজ মনটা খারাপ। গত দুইদিন ধরে নাফিসা মেডিকেলে আসেনা, তার ফোনও ধরেনা। ঐদিকে সামনে পরীক্ষা। নাফিসা কি প্রফ দিবেনা!? নিজের চেয়ে নাফিসার জন্য চিন্তা বেশী হতে থাকে!! নাফিসার বাসায় যায় আকাশ। জানতে পারে নাফিসার আম্মুর থেকে গত ২দিন ধরে নাফিসার অদ্ভুত আচরনের কথা। কারও সাথে কথা বলেনা, পড়াশোনা করেনা। বুঝতে বাকী থাকে না আকাশের কি হয়েছে। বিদেশে থাকা বয়ফ্রেন্ড এর সাথে ব্রেকআপ করেছে নাফিসা। ঐ ছেলের গত ২ মাস ধরে বিদেশে গার্লফেন্ড বানিয়ে ঘোরাফেরা করছে যেটা নাফিসা জানতে পারে দুইমাস পর। কষ্ট,ক্ষোভ সব কিছু মিলে নিজেকে সামলো উঠতে পারেনা। না প্রফ পরীক্ষা দিয়েছিলো নাফিসা ও পাশও করেছিলো।আর এই পুরা সময়টাতে তাকে সাপোর্ট করেছিলো আকাশ। কখনো বন্ধু হয়ে বুঝিয়েছে, কখনো পড়িয়ে দিয়েছে, কখনো ঘুরতে নিয়ে গেছে, কখনো নাফিসা কাঁদলে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে।
২০১৭ সাল। আকাশ আর নাফিসা এখন বেস্ট ফ্রেন্ড। একসাথে ডিউটি করে, সময় কাটায়। কিন্তু হারানোর ভয়ে কেউ কাউকে ভাললাগার কথা বলেনা। এভাবে কাজ শিখতে শিখতে, ওটি এসিস্ট আর আউটডোর এর ডিউটি, হাসপাতালের ডিউটি করতে করতে কেটে যায় দুজনের সুন্দর কিছু দিন,কিছু মাস।একদিন নাফিসার জন্য বিয়ের প্রপোসাল আসে। ছেলে মেডিসিনের কনসালটেন্ট। এফসিপিএস করা, বিসিএস অফিসার, খুব ভালো প্র্যাক্টিস করে। চেম্বারে খুব নাম ডাক। নাফিসার আম্মু খুব তরিঘরি করে বিয়ের জন্য। সব ঠিক ঠাক শুধু নাফিসার হ্যা বলার অপেক্ষা। নাফিসার আম্মু মেয়ের বন্ধু আকাশকে বলে ছেলের খোঁজ খবর নিতে। কিন্তু আন্টি জানেন না এই খবর শুনে দুনিয়া কেঁপে উঠে আকাশের। বুঝে উঠতে পারে না কি করবে। একদিকে ডিগ্রী ওয়ালা ডাক্তার আরেকদিকে আকাশ ইন্টার্ন চিকিৎসক। সে কি পারবে নাফিসাকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে যেটা হয়তো ঐ ভদ্রলোক দিতে পারবেন!?
সারাদিন চিন্তার পর সিদ্ধান্ত নেয় এত সহজে হার মানবেনা সে। নাফিসাকে আজ সে বলে দিবে নিজের মনের কথা।
ঐদিন ডিউটি শেষে নাফিসাকে মেডিকেলের ছাঁদে নিয়ে যায় সে। ছাদ থেকে খুব সুন্দর দেখা যায় চারদিক। অবাক নাফিসা কিছুটা বুঝতে পারলেও না বোঝার ভান করে হাসতে থাকে। আকাশ পকেট থেকে কিছু কাঠগোলাপ ফুল বের করে নাফিসাকে দেয়। নাফিসার সবচেয়ে প্রিয় ফুল। ফুলগুলো হাতে নিতেই নাফিসার সামনে হাত ধরে বলতে থাকে আকাশ নিজের মনের কথা যা সে গত ৬ বছর ধরে বলার চেষ্টা করেছে হাজার বার। কখনো শাড়ী পর নাফিসাকে দেখে, কখনো স্টেজে নাঁচ করা মিষ্টি নাফিসাকে দেখে আবার কখনো বা পরীক্ষার সময় পড়তে পড়তে টেবিলো ঘুমিয়ে যাওয়া মেয়েটাকে দেখে একবার হলেও নিজের বউ বানাতে চেয়েছে।নিজের লক্ষী বউ যাকে দেখে প্রতিদিন একবার আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাবে তার ঘরে একটা জীবন্ত পরী পাঠানোর জন্য। ” তোকে আমি হয়তো দামী কিছু কিনে দিতে পারবো না, কিন্তু নিজে না খেয়ে থাকলেও তুই না খেয়ে থাকবিনা। তোর পরীক্ষার সময় তোকে একদম জালাবোনা। তুই রান্না পারিস না তোকে রান্না করে খাওয়াবো। তুই পড়া না পারলে তোকে পড়ায় দিবো। তোকে কখনো জ্বালাবো না কষ্ট দিবো না। আর প্রমিস কোন একদিন বড় ডাক্তার হলে তোকে অনেক শপিং করে দিবো আর মেকআপ কিনে দিবো তোর না এগুলা পছন্দ!? ” কথাগুলা বলতে বলতে কেঁদে দেয় আকাশ। হাটু ভেঙ্গে বসে নিজের পকেট থেকে একটা আংটি বের করে বলে, ” বিয়ে না করলে হয় না বড় ডাক্তারকে?? ” নাফিসা চুপ চাপ তাকিয়ে কেঁদে দেয়।সুন্দরী নাফিসা জীবনে বহু ছেলের প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছে কিন্তু কখনো কাঁদেনি সে। আজ তার চোখে পানি। ” এত দিন লাগলো বলতে গাধা?? যদি বিয়ে হয়ে যেত আমার!?/ ” ” কোথাও যেতে দিতাম নাকি তোকে!?? বলে আকাশ জড়িয়ে ধরে তার পরীকে। মানুষের পাল্স, ব্লাডপ্রেসার আর হার্টবিট এর হিসাব করা দুই চিকিৎসক কখন যে নিজেরা নিজেদের হার্টবিট বাড়ার কারন হয়ে গিয়েছে তা বুঝতে বুঝতে ৬ বছর কেটে গেল।
ভালবাসা এমনই। যার সাথে যখন আপনার ভাগ্য আপনাকে লিখে রাখবে তখনই ভালবাসবেন আপনি, ঐ মানুষটাকে। জীবন কাটাবেন ঐ মানুষটার সাথেই। আর বিশ্বাস করুন আর নাই করুন হাজার মানুষের ভিড়ে ঐ একটা মানুষ আপনার হার্টবিট বাড়া কমানোর জন্য যথেষ্ট। ডাক্তারি ভাষা এখানে ব্যবহার না করি।কারন ভালবাসার কোন ভাষা নেই। ভাষার দরকার নেই। ভালবাসার মানুষের চোখের দিকে তাকান,জড়িয়ে ধরে অনুভব করুন।
, কি শুনতে পাচ্ছেন?? দুজনের
হার্টবিট?
Beautiful ❤️
Nice
Just awesome apu.