আজকের দিনে দেবি শেঠির নাম জানে না এমন লোক খুব কমই পাওয়া যাবে, যিনি হৃদয় কাটা ছেড়া করেও লক্ষ লক্ষ হৃদয় জয় করেছেন। দেবী শেঠি ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের দক্ষিণ কনাডা জেলার কিন্নিগলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাইবোনের মধ্যে অষ্টম শেঠি মেডিকেলে পঞ্চম গ্রেডে পড়ার সময় তত্কালীন দক্ষিণ আফ্রিকার জনৈক সার্জন কর্তৃক বিশ্বের প্রথম হৃত্পিণ্ড প্রতিস্থাপনের কথা শুনে কার্ডিয়াক সার্জন হবার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৯১ সালে নয় দিন বয়সি শিশু রনি`র হৃত্পিণ্ড অপারেশন করেন যা ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম সফল শিশু হৃত্পিণ্ড অস্ত্রোপচার। তিনি কলকাতায় মাদার তেরেসার ব্যক্তিগত চিকিত্সক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর কিছুকাল পর তিনি ব্যাঙ্গালোরে চলে যান এবং মণিপাল হার্ট ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ১৫,০০০ এর বেশি কার্ডিয়াক সার্জারি করেছেন।
ডাঃ দেবী প্রসাদ শেঠী পৃথিবীর ১০ জনের একজন, ভারতীয় হিসাবে তিনি আমার মতে তিনি ১নম্বর। আমার এই মতামতের পিছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি হলো এই ক্ষণজন্মা মানুষটি রোগীকে সর্বোচ্চ চিকিত্সা সেবা দেবার সাথে সাথে তার অর্থনৈতিক অবস্থা অর্থাত্ ব্যয়ভার বহন করার ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে চান এবং সে মতে পদক্ষেপ নেন। নিশ্চয়ই বাকী ৯জন ডাক্তার কারো অর্থনৈতিক অবস্থা জানতে চান না।
ডাঃ দেবী শেঠী একদিন একটি শিশুর জটিল অপেনহার্ট সার্জারী করছেন। এমন সময় তাঁর বিশেষ সহকারী অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করে বলেন- `স্যার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ফোন করে লাইনে আছেন এবং আপনার সাথে জরুরী একটা আলাপ আছে বলেছেন`। ডাঃ শেঠি দেখলেন এই শিশুটির অস্ত্রোপচার এ দেরী হলে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা তাই তিনি নিজের সহকারীকে বললেন-`পিএম-কে বলো আমি ওটিতে আছি এক ঘন্টা পর ফোন করার জন্য`। অবশ্যই এক ঘন্টা পর প্রধানমন্ত্রী ফের ফোন করেন।
দক্ষিণ ভারতে জন্ম নেয়া দেবী শেঠী ১৯৮২ খ্রীঃ কস্তুরবা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারী বিদ্যায় গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। পরে ইংল্যান্ড থেকে সার্জারী বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নেন। ১৯৮৯ খ্রিঃ লন্ডনের উচ্চাভিলাষী চাকরীর লোভ ত্যাগ করে দেশে ফিরে আসেন। এখানে ডাঃ রায়ের সাথে তিনি কলকাতার গড়ে তোলেন ভারতের প্রথম হৃদরোগ চিকিত্সা হাসপাতাল বি এম বিড়লা হার্ট রিসার্চ সেন্টার। কিন্তু ভারতীয়দের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা ইউরোপিয়ানদের তুলনায় তিনগুন বেশী হওয়ায় এই একটি হাসপাতাল যথেষ্ট ছিল না। এজন্য ডাঃ দেবী শেঠী ও ডাঃ রায় মিলে আরো তিনটি হৃদরোগ চিকিত্সা কেন্দ্র গড়ে তোলেন, বি এম বিড়লা হার্ট সেন্টার যাত্রা শুরুর অল্প দিনের মধ্যে ভারতের শ্রেষ্ঠ হার্ট হাসপাতালের একটিতে পরিণত হয।
ডাঃ দেবী শেঠী নামক এই মহাগুনী ব্যাক্তিটি ১৯৯৭ খ্রীঃ এর এপ্রিল মাস পর্যন্ত চার হাজার শিশুর সফল হার্ট সার্জারী সম্পন্ন করেন। লন্ডনের গাইস হাসপাতলে হার্ট সার্জন হিসেবে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেয়া ডাঃ দেবী শেঠী কে বন্ধুরা বলতেন `অপারেটিং মেশিন` । বি এম বিড়লা হার্ট রিসার্চ সেন্টার স্থাপনের পরই উদ্যেক্তারা শিশুদের জন্য পেডিয়াট্রিক সার্জিক্যালের ব্যবস্থা করেন এবং অল্প দিনের মধ্যে ৭দিন বয়সী এক সদ্যজাত শিশুর সফল অপেন হার্ট সার্জারী সম্পন্ন হয়। ভারতে সে সময় হৃদপিন্ডে সাফল্যজনকভাবে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হওয়া শিশুদের মধ্যে তার বয়সই ছিল সবচেয়ে কম।
মাদার তেরেসা তখন ডাঃ দেবী শেঠীর তত্ত্বাবধানে হাসপাতালের ইন-টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ক্রমে ক্রমে সেরে উঠছিলেন। একদিন তিনি দেখেন ডাঃ দেবী শেঠী একটি `ব্লু বেবি` বা নীল শিশুকে বেশ যত্ন করে পরীক্ষা করছেন। বেশ কয়েক মিনিট ধরে চুপচাপ ওই দৃশ্য দেখার পর মাদার তেরেসা ডাঃ শেঠীকে বললেন “আমি এখন বুঝতে পারছি কেন তুমি এখানে আছো। হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুদের যন্ত্রনা দূর করার জন্যই ঈশ্বর তোমাকে এখানে পাঠিয়েছেন।” ডাঃ শেঠীর ভাষায় তার জীবনে যতো প্রশংসা পেয়েছেন এর মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ প্রশংসা। এছাড়া ওপেন হার্ট সার্জারীর পর একটি শিশু যখন হাসপাতাল থেকে মা-বাবার কোলে ঘরে ফিরে তখন তাদের চোখে যে আনন্দের অশ্রু ধারা ঝরতে থাকে এবং মনে মনে স্র্ষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ডাঃ দেবী শেঠির (সামনে না পেয়েও) প্রতি ধন্যবাদ জানান তাও তাঁকে বেশ আত্মপ্রসাদ দেয়।
ডাঃ দেবী শেঠি নিজের মা-বাবার বরাবরের অসুস্থতার কারনে একজন ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ডায়বেটিক রোগী। ডায়াবেটিকস বাড়ার কারণে পিতাকে তিনি অনেকবার অজ্ঞান হয়ে পড়তে দেখেছেন। এই পরিবারের কাছে তখন ডাক্তারের চেহারাটাই ছিল যেন এক ঈশ্বরের মূর্তি। কারণ চরম মূহুর্তে ওই ডাক্তারই ডাঃ দেবী শেঠির মা-বাবার জীবন বাঁচাতেন।
ছোটবেলায় একটা ঘটনা তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। কোন এক শনিবার বিকেল বেলা মুম্বাই থেকে আসা দূর সম্পর্কের আত্মীয় দেবী শেঠির মা কে বলছিলেন ” … ডাঃ নামে একজন সার্জন আমার সন্তানের জীবন বাঁচিয়েছেন এবং একটা টাকাও নেননি। ` একথা শুনে ডাঃ দেবী শেঠির মা ওই সার্জনের মাকে বার বার আশীর্বাদ করে বলছিলেন, `এরকম ভালো মানুষের কারণেই এখনও পৃথিবীটা এতো সুন্দর।
১৯৯৭খ্রিঃ এপ্রিল মাস পর্যন্ত ডাঃ দেবী শেঠি যে ৪০০০ শিশুর হার্ট সার্জারী সম্পন্ন করেন তাদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবার থেকৈ আসা এবং এদের সবাইকেই তিনি বিনা মূল্যে চিকিত্সা করেছেন। উল্লেখ্য এখনো ডাঃ দেবী শেঠি এবং তাঁর নারায়ণা হৃদয়ালয় একদিকে দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে অপেন হার্ট সার্জারীর মত ব্যয়বহুল চিকিত্সা দেয় অন্যদিকে এই হাসপাতালে এসে যে কোন বয়সের হৃদরোগী যেন অর্থাভাবে চিকিত্সা সেবা বঞ্চিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা হয়। এছাড়াও এই হাসপাতলে দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের জন্য অনেক আসন বিনামূল্যে সংরক্ষিত আছে।