প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৪ মে ২০২০, সোমবার
ডা. হুমায়ূন কবির কল্লোল
কোভিড-১৯ পজিটিভ সার্জিক্যাল রোগী দেখতে ওয়ার্ডে ঢুকলাম। রোগী ৬৫ বছর বয়সের, পেট ফুলে আছে প্রস্রাব পায়খানা বন্ধ। তার আগের করা রিপোর্টগুলো হাতে নিলাম। ফুসফুস দেখতে সাধারন কোভিড আক্রান্তের মতই, রক্তে ক্রিয়েটিনিন – ২.৪, রক্তে বিলিরুবিন – ৩.৬, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে রোগীর। বোঝাই যাচ্ছে এরসাথে। অন্য অরগান গুলোও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পালস অক্সিমিটার (নাড়ি মাপার যন্ত্র) লাগালাম, অক্সিজেনের মাত্রা ৭২ শতাংশ। নার্সকে বললাম, অক্সিজেন লাগান। কিন্তু নার্স অক্সিজেন কিভাবে লাগাবে!!
অক্সিজেনের যতগুলা লাইন আছে, সবগুলোই কোন না কোন রোগীর নাকে লাগানো। আর কোন লাইন ফাকা নেই। কিন্তুু এই রোগীকে অক্সিজেন দিতেই হবে। খোঁজা শুরু করলাম, কোন রোগীর অক্সিজেনের মাত্রা মোটামুটি ভাল আছে কিনা, তার কাছে থেকে নিয়ে এই রোগীকে অক্সিজেন দিব। প্রায় সব রোগীরই অক্সিজেন পাওয়ার পরও সবারই অক্সিজেন মাত্রা কম।
শুধু রোগীর পাশের বিছানার ভদ্রলোককে পেলাম মোটামুটি ভালো। ৩ লিটার অক্সিজেন দেয়ার পর অক্সিজেন মাএা ৯৮ শতাংশ। তার অক্সিজেন বন্ধ করে দিলাম ৫ মিনিটে তার অক্সিজেন মাত্রা পেলাম ৯৬ শতাংশ। নার্সকে বললাম, এই লাইনটা শুরুতে উল্লিখিত রোগীকে দেন। কিন্তুু পাশের বিছানার রোগী ভালো থাকলেও, তার অক্সিজেনের লাইন কোন ভাবেই দিবে না। তাকে বোঝালাম অন্য রোগীর অবস্থা খারাপ, আপনার এই মুহুর্তে লাগছে না। তিনি কোনভাবেই বুঝছেন না। তিনি ফোন দিলেন তার পরিচিত একজন চিকিৎসককে আমাকে বোঝানোর জন্য। সেই চিকিৎসক ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলে আমিই তাকেই বুঝালাম। কিন্তুু এখনো ভদ্রলোক অক্সিজেনের লাইন ছাড়তে নারাজ। ক্ষিপ্ত হলেন, নিজে কত বড় নেতা সেই পরিচয় দিলেন, কোন এক বড় নেতাকে ফোন দিলেন।
যাই হোক, ডাক্তার নার্সদের চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত তিনি কিছুক্ষণের জন্য অক্সিজেনের লাইন দিতে সম্মত হলেন। প্রথম রোগীর নাকের নল ও প্রস্রাবের নল লাগালাম। ১০ লিটার অক্সিজেন দেয়াতে অক্সিজেনের মাত্রা হলো ৮৮ শতাংশ। এর মাঝে অন্য রোগী দেখতে অন্য ওয়ার্ডে গেলাম। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দেখি, পাশের বিছানার রোগী অক্সিজেন খুলে নিয়ে গেছে। অক্সিজেন কোন রোগীকে দিতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত আর ডাক্তারের হাতে নাই। সরকারি অক্সিজেনের দখল তিনি কোন ভাবেই ছাড়বেন না।
কাকে দোষ দিবেন? কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন? করোনার বিরুদ্ধে নাকি আমাদের মানসিকতার বিরুদ্ধে? নাকি আমাদের সিস্টেমের বিরুদ্ধে?
চৌদ্দশো কোটি টাকা দিয়ে ভেন্টিলেটর (দূষিত বায়ু সরিয়ে নির্মল বায়ু প্রবেশ করাবার যন্ত্র বা উপায়বিশেষ) কিনছেন পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত না করে! এই ভেন্টিলেটরের সফলতার হার কত, তা কি জানেন? খোদ আমেরিকার মত দেশে মাত্র ১০-১১%। আমাদের দেশে আরও অনেক কম হবে। যাই হোক, এসব বিগ বাজেটের প্রকল্পে যার যে আগ্রহ থাকুক, দেশের কিছু উপকার তো হবে। কিন্তু ভেন্টিলেটর চালাতে যে অক্সিজেন লাগবে, তার পর্যাপ্ত লাইন নিশ্চিত করেছেন তো?
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অক্সিজেন সবচেয়ে জরুরি ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সামগ্রী। অক্সিজেনের অভাবে কেউ ছটফট করছে, এটা স্বজন, চিকিৎসক বা কারোর পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব না। সকল রোগীর জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন নিশ্চিত করুন। আল্লাহ না করুক, কাল হয়ত আপনারও লাগতে পারে।
নিজস্ব প্রতিবেদক
সিলভিয়া মীম