প্রসঙ্গ :
চিকিৎসা বিজ্ঞান কি একজন রোগীকে বলার অধিকার রাখে ?- “আপনি ক্যান্সারে আক্রান্ত ! আর তো বেশিদিন বাঁচবেন না , আমাদের কিছুই করার নেই !”
প্যালিয়েটিভ কেয়ার ( palliative care ) নিয়ে কিছু লেখাটা আমার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গেছে । সাবজেক্টটার প্রতি শ্রদ্ধা দিনদিন বাড়ছেই ।
প্যালিয়েটিভ কেয়ার ( খুব সংক্ষেপে বললে অনিরাময় যোগ্য দুরারোগ্য ব্যাধির সান্তনামূলক চিকিৎসা ) , যেটা একজন মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম জীব হিসেবে মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত পাবার অধিকার রাখেন ।
এই চিকিৎসায় রোগীকে মানসিক , সামাজিক , আত্মিক ( spiritual / ধর্মীয় ) , অর্থনৈতিক সাহায্য করার পাশাপাশি আস্তে আস্তে রোগীর মনোস্তত্ত্বকে অবধারিত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করা হয় ।
একজন ক্যান্সার রোগী যখন রেডিওথেরাপি কেমোথেরাপি শেষ করার পরও ক্যান্সার কোষ ছড়িয়ে যায় শরীরের সর্বত্র , চিকিৎসা বিজ্ঞান হয়ে যায় নিরুপায় – সেক্ষেত্রে মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত রোগীকে কিছু basic support দিয়ে যায় এই প্যালিয়েটিভ কেয়ার ( palliative care ) l রোগীর অর্থনৈতিক অবস্হা , রোগীর সর্বশেষ ইচ্ছা , রোগীর ব্যাথা কমিয়ে দৈহিক প্রশান্তি ( pain relief ), রোগীর ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন , রোগীকে অহেতুক শারিরীক কষ্ট না দেয়া ( অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা ) সর্বোপরী রোগীর রোগের অনিরাময় যোগ্যতার বিষয়টি সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে রোগীকে প্রশান্তিময় মৃত্যুর দিকে আস্তে আস্তে ধাবিত করাই প্যালিয়েটিভ কেয়ার ( palliative care ) এর মূলনীতি ।
পঞ্চাশোর্ধ একজন মানুষ দীর্ঘদিনের কাশি নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গেলেন । চিকিৎসক রোগীকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বুঝলেন – রোগীর advance stage ক্যান্সার , রেডিও থেরাপী, কেমোথেরাপি দিয়েও তেমন ফলপ্রসু কিছু হবেনা , সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের প্রধান দায়িত্বের মধ্যে পড়ে রোগীকে সাহস দেয়া কিন্তু রোগীর নিকটাত্মীয়ের বিস্তারিত বুঝিয়ে বলা – রোগীর বর্তমান অবস্হা সম্পর্কে ।
রোগীর নিকটাত্মীয়ের এটাও বোঝানো চিকিৎসকের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে যে , এডভান্সড ক্যান্সার বা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যাওয়া ( distant metastasis ) ক্যান্সার কোষগুলো অনিরাময় যোগ্য !
মানুষ বাঁচতে চায় । মানুষ বাঁচতে চাইবে । এটা ধ্রুব সত্য । কিন্তু অহেতুক রোগীকে আশা দিয়ে অর্থনৈতিক দৈন্যতার দিকে ঠেলে না দেয়াটা মানবিক গুণের প্রকাশ । হ্যাঁ ! যাদের সামর্থ্য আছে সেসব রোগী উন্নত চিকিৎসা নিয়ে জীবনের আয়ুস্কাল কিছু বাড়াতে পারেন বৈকি, কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে দূর্বল বিপর্যস্ত রোগীকে আশার দুষ্টু চক্রে ফেলে দেয়াটা অমানবিক । একজন ক্যান্সার রোগী বাঁচার জন্য তার ভিটে মাটি বিক্রীর জন্যও প্রস্তুত থাকে । কিন্তু পর্দার আড়ালে থেকে যায় তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ , তার জীবনের সঞ্চয়টুকু অনিরাময় রোগের পিছে খরচ করার আগে বারবার রোগীর আত্মীয়দের বোঝাতে হবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যর্থতা ।
End of life care ( জীবনের শেষ সময়ের কিছু চিকিৎসা ) :
২০১৪ সালে ( DMC তে ) একজন ক্যান্সার রোগী মৃত্যুর ঠিক আধা ঘন্টা আগে আমাকে বলেছিলেন –
‘ ডক্টর একটা রবীন্দ্র সংগীত শুনবো । আর আমার ব্যাথাটা একটু কমিয়ে দিন ।’
আমি রোগীকে ব্যাথানাশক মরফিন দেই এবং ‘আগুনের পরশমনি’ গানটা শোনাই মোবাইলে ! রোগী মৃত্যুর আগে শুধু বলেছিলেন – ‘ বাহ্ ‘ !
এটুকুই তাঁর শান্তি । চিকিৎসক হিসেবে আমার শান্তি ।
রোগীকে শারিরীক , মানসিক , আত্মিক প্রশান্তি দেয়াই প্যালিয়েটিভ কেয়ারের কাজ । একজন ক্যান্সার রোগী মৃত্যুর আগে যদি চিকিৎসককে হাত ধরে বলেন – ‘ ডক্টর ! আমার মৃত্যুর পর আমার সন্তানটার লেখাপড়া কে দেখবে ? ‘
ডক্টর এবং প্যালিয়েটিভ সোসাইটি তখন বলে – ‘ আমরা আপনাকে ওয়াদা করছি, আপনার সন্তানের লেখাপড়ার খরচ আমরা দেবো। ‘ – Yes ! এটাই spiritual ( আত্মিক ) সাপোর্ট ।
“LET THE PATIENT DIE SMOOTHLY, WITHOUT PAIN , WITHOUT ANXIETY , WITH THE PROPER DIGNITY WHICH HE DESERVES AS A HUMAN.”
বিএসএমএমইউ ( BSMMU ) র প্যালিয়েটিভ বিভাগের প্রধান প্রফেসর নিজাম উদ্দীন ( FCPS , MD ) যখন বাংলাদেশে প্রথম palliative care এর কনসেপ্ট এনেছিলেন, তখন অনেকেই হেসেছিলেন , স্যারকে পাগলও ডেকেছিলেন ।
আজ সেই প্যালিয়েটিভ কেয়ার দায়িত্ব নিচ্ছে ক্যান্সারে মৃত রোগীর সন্তানের লেখাপড়ারও ।
হ্যাঁ , এটাই মানবতা । Palliative care department এবং প্যালিয়েটিভ কেয়ার কনসেপ্ট ছড়িয়ে পড়ুক বাংলাদেশের প্রত্যন্ত জনপদে ,
প্রফেসর নিজাম উদ্দিন তৈরি হোক নতুন প্রজন্মের চিকিৎসকদের মধ্যেই ।
একজন ক্যান্সার রোগী যেনো শেষ নিশ্বাস নির্ভয়ে ত্যাগ করতে পারেন সেই অধিকার হোক নিশ্চিত ।
লেখক : –
ডা. আসিফ সৈকত ,
রেজিস্ট্রার, ক্রিটিকাল কেয়ার ডিপার্টমেন্ট,
এপোলো হাসপাতাল , ঢাকা