প্ল্যাটফর্ম নিউজ, সোমবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২১
১৬ ডিসেম্বর ২০২১, বাংলাদেশের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। একই বছর স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকার বছরটিকে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করেছেন।
এই বিশেষ দিনে ‘হাসিখুশি’ পালন করে ২য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
১৬ ডিসেম্বর ২০১৯ প্রতিষ্ঠিত হয় ‘হাসিখুশি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র’। অনাড়ম্বর আয়োজনে নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামে ভাটপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয় দিনব্যাপী স্বাস্থ্যমেলা।
চার শতাধিক রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ ও ওষুধ বিতরণ করা হয়। এছাড়া রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, ডায়াবেটিস পরীক্ষা, ওজন মাপা ও প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেকের রক্তচাপ মাপার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পাঁচদোনাসহ অন্যান্য ইউনিয়ন থেকেও অনেক রোগী এসেছেন। এমন একজন রোগী জানান যে তিনি তাঁর আত্মীয়ের মাধ্যমে জেনেছেন যে এখানে ভাল ভাল ডাক্তাররা প্রতি শুক্রবার রোগী দেখেন। আজ (১৬ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার) একাধিক ডাক্তার আসবেন শুনে দেখাতে এসেছেন। তাঁর বাচ্চাটি দীর্ঘদিন ধরে রোগাক্রান্ত।
অপর একজন রোগী জানান যে আজ বিনামূল্যে হলেও এখানে ডাক্তাররা সময় দিয়ে রোগী দেখেন, কথা বলেন, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন এবং দরকার হলে রেফার করেন। আবার টেস্ট (রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা) করতে দিলে ডিসকাউন্ট লিখে দেন। কিছু ওষুধও পাওয়া যায়। গতবারের অভিজ্ঞতায় এবারও তাই এসেছেন।
স্থানীয় এক রোগীর স্বজন জানান ভিন্ন কিছু কথা। তিনি বলেন, “আমার বাচ্চার প্রায়ই জ্বর ঠান্ডা (সর্দি) লাগে। আগে যতবার ‘ফার্মেসির ডাক্তার’ দেখাইছি ততবারই চাইর পাশশ (চার-পাঁচশ’) টাকার ওষুদ দিছে। হাসিখুশিতে দেখানোর পরে আর এত টাকার ওষুদ লাগে না। পরে জানছি আমার বাচ্চারে এন্টিবাইটিক(এন্টিবায়োটিক) দিত। এখনো ওর জ্বর ঠান্ডা লাগে। এন্টিবাইটিক লাগে না। ঠিকই সুস্থ হইতাছে।”
সরেজমিনে দেখা যায়, রোগীকে প্রথমে একটি ডেস্কে তালিকাভুক্ত (রেজিস্ট্রেশন) করা হয়। তারপর সিরিয়াল দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বুথে। শিশু, নারী ও পুরুষদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বুথে ৬ জন ডাক্তার চিকিৎসা পরামর্শ দিচ্ছেন। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগেই রক্তচাপ(ব্লাড প্রেসার), ওজন, উচ্চতা দেখে নেয়া হয়। এই ডেস্কে স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করছেন। অন্য একটি ডেস্কে রক্তে শর্করার(ব্লাড সুগার) পরিমাণ দেখা হচ্ছে। একজন বিএসসি নার্স কাজ করছেন। আলাদা একটি ডেস্কে ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে। কোথাও কোনো হইচই নেই। উৎসবমুখর পরিবেশে রোগীরা চিকিৎসা পরামর্শ ও অন্যান্য সেবা নিচ্ছেন।
ঢাকা থেকে আসা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. ফাহিমুল ইসলাম মন্ডল বলেন, “করোনার কারণে টানা কাজের চাপে কোথাও যাওয়া হয় না দেড় দুই বছর। আজ সুযোগ হলো। বহুদিন পর মেডিকেল ক্যাম্প, ভাল লাগছে।” এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,”রোগী দেখে মনে হচ্ছে তাঁরা হয়তো অতটা সচেতন নন যেমনটা হয়ে থাকে শহরে। ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প তাঁদের স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলবে এবং রোগের শুরুতেই চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে সহায়ক হবে। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ তাঁদের চিকিৎসা সচেতন করবে বলে আশা করি। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ফার্মেসির ওষুধ সেবনের প্রবণতা কমে আসবে।”
হাসিখুশির অন্যতম উদ্যোক্তা ডা. সায়মন তাওহীদ বলেন, “এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এর ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশের আপামর জনগোষ্ঠী। একটি শিশু, যে কখনো কোনো ওষুধ সেবন করেনি, সেও ওষুধ-প্রতিরোধী জীবাণু সংক্রমণের শিকার হচ্ছে। অথচ এখানে তার কোনো দায় ছিল না। আজকের (১৬ ডিসেম্বর) মেডিকেল ক্যাম্পে চার শতাধিক রোগীর মাঝে চার শতাংশের নিচে এন্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করা হয়েছে। অথচ সাধারণ প্রবণতা হলো ওষুধের দোকানে গিয়ে অসম্পূর্ণ মাত্রায় এন্টিবায়োটিক সেবন। এটি যে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সেবন করতে হয়, এই সচেতনতা এলেই আয়োজন সার্থক।”
হাসিখুশির আরেকজন তরুণ উদ্যোক্তা মকবুল হোসেন সুজন। মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন সফল করতে কয়েকদিন আগে থেকেই ভাটপাড়ায় সংগঠকদের নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন,”যেখানে কিছু নেই সেখানেই কিছু গড়ার সম্ভাবনা থাকে। হাসিখুশি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শুরুতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। জনগোষ্ঠীর মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্থানীয় তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে। এই আয়োজনের মাধ্যমে তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা বাড়বে যা পরবর্তীতে কর্মসংস্থান ও দক্ষ জনবল বিকাশে সহায়ক হবে।” আগামীর কিছু পরিকল্পনা আসছে বছরেই ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করা হবে বলে তিনি জানান।
এদিকে এক কথায় এলাকার লোকজনের চিকিৎসা সচেতনতার দৃশ্য আঁকলেন হাসিখুশির সাথে যুক্ত স্থানীয় তরুণ আজহারুল ইসলাম, “অনেকেই এসেছেন শুধু ওষুধ নিতে। পেটব্যথা, মাথাব্যথা, গায়ে ব্যথার ওষুধ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ চাইছে। একটা ওষুধ খাওয়ার আগে যে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া জরুরি, এই সচেতনতার অভাব আছে।”
‘হাসিখুশি’ প্রকল্পের উদ্যোক্তা ডা. মুরাদ হোসেন মোল্লা জানালেন যে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে একেকটি ছোট ছোট পরিকল্পনা কিভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। মূল লক্ষ্য ঠিক রেখে যোগ বিয়োগ চলছে। তিনি বলেন, “সাম্প্রতিককালে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নাগরিক উন্নয়ন ও চাহিদা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। আমরা মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা স্বাস্থ্যে মনযোগ দিচ্ছি। গ্রাম পর্যায়ে সম্ভবত আমরাই প্রথম এমন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছি যা অনুদান নির্ভর নয় বরং স্বনির্ভর। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় উত্তরণের পথে স্বনির্ভরতা অপরিহার্য। গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারলে তাঁদের স্বাস্থ্যব্যয় কমে যাবে। স্বাস্থ্যশিক্ষায় সচেতন হবে, সুস্থতার সম্ভাবনা বাড়বে। কর্মঘন্টা, উৎপাদনশীলতা বাড়বে। ‘হাসিখুশি’তে একে একে আরো চিকিৎসা সুবিধা যুক্ত হবে। মানসম্মত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে আর দূরে যেতে হবে না।”
তিনি আগামী বছরের পরিকল্পনার কথা বলেন। শীঘ্রই এ ব্যাপারে ঘোষণা দেয়া হবে বলে জানান।
দিন গড়িয়ে সন্ধ্যায় যখন অপেক্ষমান রোগীর ভিড় কমে আসছিল, টিমটিম করে জ্বলা আকাশের তারার মতো শ্রেণীকক্ষের বাতিগুলো জ্বলছিল। আঁধার কাটাতে আলো আসবেই।
ডা. মো. মুরাদ হোসেন মোল্লা
উদ্যোক্তা
‘হাসিখুশি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র‘