প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৫ জুলাই ২০২০, শনিবার
ডা. তৌফিকুল হাসান সিদ্দিকী
কমান্ড্যান্ট, সিএমএইচ ঢাকা।
আমিন সাহেব (ছদ্মনাম) কল করেছিলেন আজকে। কৃতজ্ঞতা আর দোয়া চাইলেন আবারো তার কন্যার জন্য। ভালো আছে, শ্বশুরবাড়িতে আছে জেনে মনটা ভালো হয়ে গেল।
সেদিনের সন্ধ্যাটা এমনিতেই কেমন যেন গুমোট ছিল। ইমারজেন্সি ও ক্যাজুয়ালটিতে অস্বাভাবিক ভিড়। বিছানা একটাও ফাঁকা নেই। এক্সিডেন্ট আছে, হেলি ইভাকুয়েশন হয়ে আসা MI এর রোগী আছে, বয়স্ক কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত আছেন শ্বাসকষ্ট নিয়ে, ক্যান্সার এর রোগী আছে। ইমারজেন্সির কর্মীদের নাভিশ্বাস অবস্থা। এর মধ্যে একজন রাগে গজগজ করছেন, কেন তাকে আগে দেখা হয়নি, আধঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছেন। তরুন বিশেষজ্ঞ তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ইমারজেন্সিগুলো ম্যানেজ হলেই আপনাকে দেখছি। তিনি বুঝতে নারাজ, চাকুরীর জৈষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে তরুনকে ঝেড়ে যাচ্ছেন। থামালাম তাকে।
কোনার দিকে বেসিনের কাছে বেডটাতে ম্লান মুখে সদ্য কৈশোর পেরুনো একজন তরুনী দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সামলানোর চেষ্টা করছে, চেহারা পাংশুটে। হাতে ক্যানুলা দিয়ে সেলাইন লাগানো আছে।
জিজ্ঞেস করলাম, মা কি হয়েছে?
একজন চাকুরিরত জুনিয়র কর্মকর্তার কন্যা।
মুখে কথা নেই। ইশারায় জানালো তলপেটে ব্যাথা। একিউট এবডোমেনের চিকিৎসা দেওয়া আছে। কিন্তু কেন জানি আমার মন বলছিল, হয়তো মেয়েটির পাংশুটে, শংকিত মুখ দেখে- এটি অন্যকিছু।
তাড়াতাড়ি অনকল গাইনোকেলজিষ্ট কে আসতে বললাম। আমার সন্দেহের কথা জানালাম। গাইনোকলজিস্ট যিনি ডিউটিতে, তিনি আগে আমি যে সংস্থায় ডেপুটেশনএ ছিলাম সেখানে আমার সঙ্গে কাজ করেছেন। খুবই মানবিক গুণসম্পন্ন একজন মানুষ।
তিনি এসে নিশ্চিত করলেন, সন্দেহ সত্য, এটি এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি।
সাথে এও জানিয়ে দিলেন, মেয়েটির এখনো বিয়ে হয়নি!
সামাজিকভাবে মেয়েটি বিব্রতকর একটি পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছে। পিতামাতার কাছে কি ভাবে মুখ দেখাবে? সমাজ তাকে কিভাবে নেবে?
অফিসিয়ালি কর্মরতদের সন্তান বিয়ে হয়ে গেলে আমাদের হাসপাতালে আর প্রাধিকারভুক্ত থাকে না। অর্থাৎ প্রেগন্যান্সির চিকিৎসা প্রাপ্য নয়।
সেটি জেনেই গাইনোকলজিস্ট সিদ্ধান্ত চাইলেন, কি করবেন এখন? এক্টোপিকে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে, মেয়েটির জীবন অবশ্যই শংকায় পড়তে পারে।
বললাম, একিউট এবডোমেনই থাকুক ডায়াগনোসিস, বাবা-মাকে এখন বিস্তারিত কিছু বলার দরকার নেই। শুধু জরুরী জীবন রক্ষাকারী শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন জানিয়ে ওটিতে নিয়ে যান। বাকীটা আমি পরে সামলাবো।
ঘন্টাখানেক পর আমেনা জানালেন, শেষ হয়েছে, মেয়েটি ভালো আছে। ভেতরে যথেষ্ট রক্তক্ষরণ ছিল! দেরি হলে বিপদ হতো।
৭ দিন পর।
মেয়েটি প্রায় সুস্থ হয়ে উঠছে। আমেনাকে দিয়ে, মেয়েটিকে জানালাম, আমার সঙ্গে ছেলেটিকে দেখা করতে। ক’দিন পর ছেলেটা দেখা করতে এলো। ওরা একই ক্লাসে বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়ছে, খুব বেশি দিন হয়নি।
বললাম, মেয়েটার জীবন সংশয়ের কারণ।
অস্বীকার করলো না।
আরো জানালাম, তাকে বিয়ে করার কথা।
এখানে একটু আপত্তি। ছেলেটার পিতা-মাতা এ সময়ে বিয়ে মেনে নেবে না, তাই।
এবার একটু রূঢ় হতে হলো। জানিয়ে দিলাম, মত না দিলে যা কিছু করার প্রয়োজন তা করা হবে। কিন্তু আমি এখনই নিশ্চয়তা চাই, মেয়েটি হাসপাতালে থাকতে থাকতেই।
সবশেষে রাজী হলো।
২৬ মে, যেদিন মেয়েটির জন্মদিন সেদিন নোটারী পাবলিক আর কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হলো।
প্রাধিকারের আইন ভাঙা অথবা নিজ সীমার বাইরে যাবার দায়ে কি আমি অপরাধী?