প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৯ জুলাই ২০২০, বৃহস্পতিবার
ডা. সুমনা তনু শিলা
৩৭ তম ব্যাচ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ
আজকাল ইনসোমনিয়াতে ভুগছি। ঘুম আসতে চায় না রাতে। বহু কষ্টে চোখ দুটো কেবল একটু লেগে এসেছিল, এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো। বেশ বিরক্ত হলাম। রাত আনুমানিক ২টা বাজে। এত রাতে কেউ ফোন করে?
মোবাইলটা টেবিলের উপর চার্জে দেওয়া। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করলো না। একবার বিছানা থেকে উঠলেই ঘুমটা পুরোপুরি চলে যাবে। একটা বালিশ কানে চাপা দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু ফোনটা বেজেই চলেছে। ঘুমটা পুরোপুরি ভেঙে গেল। অগত্যা বিছানা ছেড়ে উঠলাম ফোনটা ধরার জন্য।
হায় হায় রোহান ভাই ফোন দিচ্ছে আর আমি ফোন না ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করছি? নিজেকে দারুণ অপরাধী মনে হলো। রোহান ভাই মেডিকেল কলেজে আমার রুমমেট ছিল। শুধু কি রুমমেট? বলা যায়, অন্নদাতা রুমমেট। আমি কৃষক পরিবারের ছেলে। আমাদের গ্রাম থেকে আমিই প্রথম কোন মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছি। আমাকে পড়ানোর ক্ষমতা আমার বাবার ছিল না। কিন্তু গ্রামের অতি উৎসাহী সবাই চাঁদা তুলে আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলো রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। বাবাকে বললো,
“সোহেলের দায়িত্ব আমাগের। সোহেল আমাগের গিরামের মুখ উজ্জ্বল কইরেছে। ওর পড়ালিখার খরচ আমরাই দিবানে।”
গ্রামের লোকজন সত্যি সত্যিই চাঁদা তুলে আমার খরচ দিচ্ছিলো। কিন্তু সেটা মাসে মাত্র সাতশো টাকা। আমি জানি, এটাই ওদের জন্য অনেক কিছু। কারণ ওদের অবস্থাও তো ভালো নয়।
মেডিকেল কলেজে এসে বুঝলাম, এ টাকা কিছুই নয়। অন্তত হাজার দুয়েক টাকা লাগে, খেয়ে পরে বাঁচার জন্য। আমি বরাবরই লাজুক টাইপের ছেলে। বাবাকেও একথা জানাতে লজ্জা লাগছিল। খুব হিসাব করে চলতাম। কাউকে বুঝতে দিতে চাইতাম না, আমার এই সমস্যার কথা। কিন্তু রোহান ভাই কিভাবে যেন বুঝে গিয়েছিলেন। প্রায়ই আমাকে নিয়ে নামকরা সব হোটেলে খেতে যেতেন। বলতেন,
“একা একা খেতে ভালো লাগে না। তোকে সাথে নিয়ে খেতে দারুণ লাগে।”
রোহান ভাই এর বাবা বিশাল ধনী। উনি তার একমাত্র সন্তান। মাস তিনেকের ভিতরেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম, উনি আসলে আমার খাওয়া খরচ বাঁচানোর জন্যই এই কাজটা করেন। তখন ওনার সাথে খেতে যেতে আমার লজ্জা করতো। আমি প্রায়ই এটা ওটা বাহানা করে এড়িয়ে যেতাম। বুদ্ধিমান রোহান ভাই কিভাবে যেন সেটাও বুঝে গেলেন। আমাকে এই লজ্জার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য দুইটা টিউশনি যোগাড় করে দিলেন। যেটা দিয়ে নিজের খরচ চালিয়ে বাবাকেও কিছু টাকা পাঠাতে পারতাম। গ্রামের লোকের কাছ থেকে আর সাহায্য নেওয়া লাগেনি।
পাশ করার পর দীর্ঘদিন রোহান ভাই এর সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যখন আমি ইনডোর মেডিকেল অফিসার হিসাবে ট্রেনিং পোস্টে আসি, তখন আবার রোহান ভাই এর সাথে দেখা। উনি মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছেন। যদিও আমি সার্জারিতে, কিন্তু রোহান ভাই এর সাথে আবার সেই আগের মত আড্ডা চলতে থাকে। উনি আমার বড় ভাই, আমার গার্জিয়ান।
সম্প্রতি রোহান ভাই এর করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছে। উনি হাসপাতালে আইসোলেশন এ আছেন। সংবাদটা শুনে কি যে কষ্ট পেয়েছিলাম। জানি, একে একে হয়তো আমরা সবাই আক্রান্ত হবো। কিন্তু রোহান ভাই এর খবরটা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না।
এতরাতে ফোন দিয়েছেন, নিশ্চয়ই খারাপ কিছু। আমার গা হাত পা কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা ধরলাম,
– হ্যালো ভাইয়া।
– কিরে ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলাম?
– কি যে বলেন ভাইয়া! এখন কেমন আছেন?
– বেশি ভালো মনে হচ্ছে নারে। শ্বাসকষ্ট আছে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ফ্ল্যাকচুয়েট করছে।
– কিছু হবে না ভাইয়া। ইনশাআল্লাহ খুব দ্রুত আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন।
– খুব ইচ্ছা করে জানিস। খুব ইচ্ছা করে, আমার মেয়ে মানহার সাথে আবার খেলবো। ওকে খাইয়ে দেবো। ও তো আমার কাছে ছাড়া অন্য কারো কাছে খেতে চায় না। তোকে এজন্যই ফোন করেছি। আজ রাতেও নেহাকে খুব জ্বালাচ্ছিল। কিছুতেই ওর কাছে খাবে না। পরে ভিডিও কল করে বলেছি, কাল সকালে এসে আমি ওকে খাইয়ে দিব। মানহা কথা দিয়েছে, কাল সকালে যদি আমি ওকে খাইয়ে দিই, তাহলে ও আর মাকে জ্বালাবে না। লক্ষী মেয়ের মত মায়ের কাছে খেয়ে নেবে। আসলে অনেক দিন আমাকে দেখেনি তো। অধৈর্য হয়ে গেছে।
– খুব স্বাভাবিক ভাইয়া। নেহা ভাবিরও তো খুব কষ্ট হচ্ছে।
– তোকে একটু কষ্ট দেবো সোহেল ।
– কি যে বলেন ভাইয়া! শুধু আদেশ করেন।
– আজ রাতে নেহার সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিলাম। তুই আগামীকাল সকালে পিপিই পরে যাবি আমার বাসায়। তোর সাইজ আর আমার সাইজ মোটামুটি একই রকমের। মানহা বুঝতে পারবে না। নেহা ওকে বুঝিয়ে রাখবে, আমার গলায় সমস্যা হয়েছে বলে আমি কথা বলতে পারবো না। আর আমাকে করোনা রোগীকে চিকিৎসা দিতে হবে, তাই পিপিই খুলতে পারবো না। তুই ওকে সকালে খাইয়ে দিয়ে আসবি। বাকিটা নেহা সামলে নেবে।
– ঠিক আছে ভাইয়া।
– খাইয়ে দিয়ে এসে আমাকে ফোন দিয়ে জানাবি, মানহা কি বললো।
– ঠিক আছে ভাইয়া।
পাঁচ বছরের মানহা কে একবেলা খাইয়ে দিতে হবে। এ আর এমন কি? আমি সকাল আটটার দিকে রোহান ভাই এর বাসার কলিং বেল বাঁজালাম। নেহা ভাবি দরজা খুলে দিলো। ভাবির জামা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, পাঁচ বছরের পরীটা। গুটুর গুটুর করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নেহা ভাবি বললেন,
“মানহা, তোমার বাবা এসেছে।”
আর যাবা কোথায়? দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো মানহা। ছাড়বেই না। আমি বিয়ে করেছি, বছর দুয়েক হলো। এখনও বাচ্চা নেওয়া হয়নি। ব্যাপারটা যে এত মধুর, আগে বুঝতেই পারিনি।
বাচ্চাদের খাওয়াতে যে এত সময় লাগে, আমার জানা ছিল না। সোয়া নয়টা বেজে গেছে। আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। এখান থেকেই সরাসরি চলে যাবো সিদ্ধান্ত নিলাম। আসার সময় মানহা আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলো। একটা ফুল একেছে সে। দাগগুলো একটু আঁকাবাঁকা হয়েছে, কিন্তু কি যে মায়া ছবিটার ভিতরে! বলল,
“আম্মু বলেছে, তুমি অনেকদিন আসতে পারবা না রোগী দেখার জন্য। প্রতিদিন সকালে এই ফুলটা দেখবা, তাহলে তুমি আমাকে মিস করবা না।”
আমি এতক্ষণ কোন কথা বলিনি । কিন্তু এখন অবাক হয়ে বললাম,
“এটা কি ফুল?”
ফুল আঁকার উত্তেজনায় মানহা, রোহান ভাই এর সাথে আমার ভয়েসের তারতম্যটা হঠাৎ করেই ধরতে পারেনি। খুশি খুশি হয়ে বললো,
“এটা মানহা ফুল।”
আমি কাগজটা চারভাঁজ করে বুক পকেটে রাখলাম। ডিউটি শেষ করে রোহান ভাই এর কাছে পৌঁছে দিয়ে আসবো।
হাসপাতালে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই আমার ইন্টার্ন ডা. অভি বলল,
“ভাইয়া শুনেছেন? রোহান স্যারের অবস্থা খুব খারাপ। অক্সিজেন স্যাচুরেশন অনেক কমে গেছে। একটু আগেই আই সি ইউ তে নেওয়া হয়েছে।”
আমার গা হাত পা কাঁপছে। বুক পকেটে এখনও মানহা ফুলটা রয়েছে। আমি শক্ত করে মানহা ফুলটা চেপে ধরলাম। মনে মনে বললাম,
“আপনাকে ফিরতেই হবে রোহান ভাই। পরীটা আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে।”