অবশেষে চিকিৎসকদের প্রতিরোধঃ রাজবাড়ী মডেল
এতদিন খবরের শিরোনাম ছিলঃ
১৬/৭/১৫ চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে তাণ্ডব। ভেতরের খবর চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে চিকিৎসক লাঞ্ছিত।
৭/৭/১৫ লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হামলা। ভেতরের সর্বশেষ খবর, এর আগেও গত বছর অক্টোবর মাসে এবং চলতি বছর মার্চে দুই দফা হেলথ কমপ্লেক্সে হামলা চালায় বহিরাগতরা।স্থানীয় প্রশাসন,পুলিশ ও সিভিল সার্জনকে জানিয়েও কোন সুরাহা হয় নি।
৫/৬/১৫ চিকিৎসকদের বধ্যভূমি বাংলাদেশঃ এবার আক্রান্ত হলো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাতীবান্ধা, লালমনিরহাট। ভেতরের খবর, মেডিকেলে কর্মরত চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেদম মারধোর করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আউটডোর এর এই মহিলা ডাক্তারকে সাময়িক বরখাস্ত।
৬/৬/১৫ আগৈলঝাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভাংচুর। ভেতরের খবরঃ চিকিৎসককে পিটিয়ে জখম করে প্রায় এক ঘণ্টা আটকে রাখে।
২০১৫ সালে চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন এমন কয়েকটি উপজেলা ।
জুলাই-হাতীবান্ধা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, লালমনিরহাট
জুন-জামালপুর সদর হাসপাতাল
মে-ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, চাঁদপুর
টুঙ্গিপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, গোপালগঞ্জ
মার্চ-টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কক্সবাজার
ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ময়মনসিংহ
ফেব্রুয়ারি-বীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, দিনাজপুর
শিবগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, চাঁপাই নবাবগঞ্জ
কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নোয়াখালী
২০১৪ সালের একটা শিরোনামই ছিল-শেরপুরে চিকিৎসককে জুতাপেটা করলেন স্থানীয় নেতার ভাই।
প্রতিবাদ ছিল শুধু অনলাইনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বড়জোর মানব বন্ধন, প্রতীকী কর্ম বিরতি অথবা সর্বোচ্চ লোক দেখানো দু ঘন্টার চেম্বার বন্ধ তাও বিকেলে যখন চেম্বারের সময়ই না। এখনো মানব বন্ধনের ছবি তোলার উপলক্ষ্য চলছে-ওদিকে একটি জাতীয় দৈনিক একজন চিকিৎসক ডাঃ নূনযীরুল মুহসেনীন (মীম) এর ব্যক্তিগত জীবন ব্যবচ্ছেদ করছে তাঁদের মালিকের ব্যক্তিগত আক্রোশ আর দম্ভে। কিছুদিন আগে একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভেঙ্গে এমনভাবে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে সেখানে এখনো চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়নি (ঐ উপজেলার সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দু হাত দু পা ভেঙ্গে মাথা ফাটিয়ে মৃত ভেবে যে ফেলে রেখে গেছে সেটা নাই জানলেন, কারণ জেনে লজ্জিত হবেন দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি প্রতিকারে)। এবার আসি মূল খবরে।
রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ সৌরভ সিকদার জরুরী বিভাগে কর্মরত থাকা কালীন গত ২/৮/১৫ তারিখে হামলার শিকার হন। স্থানীয় ফরহাদ শেখ রাত ১২.৩০ এ হাসপাতালে অনধিকার প্রবেশ করেন। এটা নিয়ে কর্মরত সিনিয়র স্টাস নার্স আব্দুল্লাহ আল মামুনের সাথে তর্ক বিতর্কের এক পর্যায়ে কর্তবরত চিকিৎসক ডাঃ সৌরভ সিকদার এগিয়ে আসেন। তখন ফরহাদ শেখ আরো ৪-৫ জনকে সাথে নিয়ে চিকিৎসকের উপর চড়াও হয় এবং এলোপাথারি কিল ঘুষি মারতে থাকে। ঘটনাটি তাৎক্ষণিকভাবে সদর হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডাঃ মো মাহবুবুল হক এবং আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ এস এম এ হান্নানকে অবহিত করা হয়। ঘটনার এটুকু পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় সকল সরকারি বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে আহরহ ঘটছে। এবং ঘটনার প্রতিক্রিয়াও আগের মতোই ঘটতে যাচ্ছিল।
খবরের শিরোনাম “রাজবাড়ী মডেল” লেখার কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গার মত রাজবাড়ী সদর হাসপাতালেও অভিন্ন প্রতিক্রিয়া ছিল, সাময়িক উত্তেজনার পর কর্তৃপক্ষের স্থানীয় প্রভাবশালীর সাথে দ্বন্দ্বে না জড়ানোর নীতি। কিন্তু রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে ফরহাদ শেখ জনৈক ফরহাদ শেখ নন। তিনি বার বার সেখানে পরভাব খাটানোর চেষ্টা করেছেন। মাদকাসক্ত ফরহাদ শেখ কিছুদিন পর পরই সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যেতেন এবং সরকারি ফিসের তোয়াক্কা তো করতেনই না তার সাময়িক চিকিৎসার জন্য ইঞ্জেকশন বা আনুষাঙ্গিক ওষুধের খরচ ও কর্তব্যরত চিকিৎসককে বহন করতে হত। ফরহাদ শেখের মূল অস্ত্র ছিল জেলার উর্ধ্বতন স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে তিনি কথায় কথায় মুঠোফোনে যোগাযোগ করে অভিযোগ করতেন। একজন সাধারণ রোগী সরকারের নির্ধারিত নম্বরে কর্তব্যরত চিকিৎসকের যে কোন গাফিলতির অভিযোগ জানাতে পারেন। কিন্তু ফরহাদ শেখ সাদারণ রোগীর মত নয় বরং কর্তব্যরত চিকিৎসকের সামনেই ভয় ভীতি প্রদর্শন পূর্বক উর্দ্ধতন কর্মকর্তা কে হুমকি দিয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করতেন। এর আগেও তিনি কর্তব্যরত চিকিৎসককে কখনো মৌখিক কখন শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন এবং স্থানীয়ভাবেও চিকিৎসকেরা সহায়তা পাননি। এবারো হামলার পর ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছিল, বিনা বাঁধায় হামলাকারীরা হাসপাতাল ত্যাগ করেন। প্রসংত উল্লেখযোগ্য যে বাংলাদেশের সকল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ক্ষেত্র বিশেষে সদর হাসপাতালে নিরাপত্তাকর্মী হয় অনুপস্থিত নয়ত কখনোই দায়িত্ব পালন করেন না। নাইট ডিউটির সময় শুধু মাত্র একজন উপ সহকারী কম্যুনিটি মেডিকেল অফিসার বা স্বাস্থ্য সহকারী, একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী , ইনডোরে একজন নার্স এবং ওয়ার্ড বয় এই জনবল নিয়ে হাসপাতালগুলো চলছে। যে কোন মুহূর্তে নাইট ডিউটির সময় রোগী আসলে সব সময় চিকিৎসককেই জরুরীবিভাগে রোগীর মুখোমুখি হতে হয় একা।
আক্রান্ত চিকিৎসকের সহকর্মীরা কোনভাবে এবার ছাড় দিতে রাজী হননি। তাঁরা জেলার পুলিশ কর্মকর্তা, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করেন। সকলের পরামর্শ ক্রমে আক্রান্ত চিকিৎসককে বাদী করে “রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে জরুরী বিভাগে অনধিকার প্রবেশ, সরকারি কাজে বাঁধা দান পূর্বক মারামারি করে কর্তব্যরত চিকিৎসককে আহত করা” এই অভিযোগ দায়ের করেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সেদিনই দ্রুত অপরাধীকে গ্রেফতার করে। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং সকলের সাথে যোগাযোগ করে অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করা নিশ্চিত করার জন্য চিকিৎসকগণ সচেষ্ট হন।
প্রথমত, বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত হামলার শিকার হচ্ছেন চিকিৎসক এবং চিকিৎসা সেবাদানকারীরা। বিনষ্ট হচ্ছে সরকারি সম্পত্তি সহ হাসপাতাল।
দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক হামলার বিপরীতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ একেবারেই হাতে গোণা।
তৃতীয়ত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোন আইনগত ব্যবস্থা নেয় না। কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ
দায়ের করা হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের যথাযথ আন্তরিকতার অভাব থাকে।
জাতীয় পর্যায়ে যখন ক্রমাগত মিথ্যাচারে প্রভাবশালী ক্ষমতাবানের আক্রোশে চিকিৎসকের চরিত্র হনন চলছে, চিকিৎসকের ব্যক্তিগত জীবনের নিরাপত্তা বারবার বিঘ্নিত হবার পরেও পেশাগত অভিভাবক সংগঠন দায়িত্ব নিচ্ছে না, সহকর্মীরা পাশে দাঁড়াচ্ছে না, পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নিরাপত্তা না দিয়ে প্রশাসন যেখানে শুধু নিয়মই চাপিয়ে দিচ্ছে এমন পরিস্থিতিতে এই ক্ষুদ্র প্রয়াস, একটা এজাহার, সহকর্মীদের দিনভর জন প্রতিনিধি, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসনের সাথে নিজেদের ন্যায্য অধিকারের জন্য পাশে দাঁড়ানো অনেক বড় কিছু। এখন থেকে প্রত্যেকটা হামলার বিপরীতে এরকম সামষ্টিক উদ্যোগ, ত্বরিত আইনগত ব্যবস্থা, রাজনৈতিক নূন্যতম হস্তক্ষেপ না করা, অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হলে অবশ্যই বাংলাদেশে চিকিৎসকের উপর হামলার ঘটনা কমে আসবে। একই কারণে মামলা আগেও হয়েছে কিন্তু জনৈক ফরহাদ শেখের মত প্রত্যেকটা উপজেলায়, সদরে, ইউনিয়নে যে দুর্বৃত্তরা স্বাস্থ্য সেবায় ক্ষমতার অপব্যবহার করছে, চিকিৎসক এবং প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জিম্মি করে অপকর্ম করে যাচ্ছে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শুরু হলো রাজবাড়ী থেকে।
এতদিন খবরের শিরোনাম ছিল-“ভুল চিকিৎসা অথবা চিকিৎসক লাঞ্ছিত” আজ থেকে শিরোনাম হোক চিকিৎসকগণ আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছেন, জনগণ সচেতন হচ্ছে, হলুদ সাংবাদিকতা অবশেষে চিরতরে বন্ধ হচ্ছে, হাসপাতাল কোন রকম দুর্বত্তের অভয়ারণ্য নয়।
ডাঃ জোবায়ের ইবনে জায়েদের তথ্য অনুলিখন এবং সম্পাদনায় ডাঃ মোহিব নীরব