অবসর ভাবনা

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, সোমবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০

ডা. মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান(স্বপন)
১৭তম ব্যাচ, রাচিম ।

 

মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে বারো বছর পর আমার রিটায়ারমেন্ট হলো। মোট প্রায় সাঁইত্রিশ বছরের দেশে বিদেশে আমার কর্মময় বর্ণাঢ্য চাকরি জীবন।
অবসরের প্রথমদিকে খুব খারাপ লাগলেও এখন ভালোই লাগছে। সকাল সন্ধ্যা কোনো ডিউটি নাই। অন কলে থাকতে হচ্ছে না। অখণ্ড অবসর।

আমার বয়স এখন তেষট্টি। তবে এখনো মাথার চুলের কিয়দংশ কাঁচা রয়েছে। সুঠাম অটুট স্বাস্থ্য। শরীরের চামড়া এখনো ঝুলে পড়ে নি। দাঁড়ি রাখি রাখি করে রাখা হয় নি। সপ্তাহে দু’বার শেভ করি। পোশাক আশাকে কেতাদুরস্ত। রঙ্গীন জামাকাপড় এখনো পরতে ভালোবাসি। দেখলে অনেকেই অবলীলায় বয়স ৪০-৪৫ বলে। আমি চুপ করে শুনি, প্রতিবাদ করলেও কেউ আমলে নেয় না।

ওহ, পরিচয় তো দেয়া হয় নি। আমি ডা. আসফাক হোসেন। পেশায় চিকিৎসক। কিডনি বিশেষজ্ঞ। একটি সরকারী হাসপাতালে চাকুরী করতাম। এখন অবসরপ্রাপ্ত। দু’সপ্তাহ হলো অবসর নিয়েছি।

বেশ ভালোই ছিলাম। ফুরফুরে মেজাজে দিন যাচ্ছিল। দু’দিন আগে হঠাৎ বাংলাদেশী ব্যবসায়ী দুদু মিয়ার সঙ্গে দেখা। মাথায় টুপি, মুখে অল্প দাড়ি। মুখ ভর্তি পান। ঠোঁট পানে খয়ের খাওয়ার জন্য টুকটুকে লাল, সমস্ত অবয়বে সুখী সুখী ভাব। এখানে একটা গ্রোসারির দোকান চালান। দেখা হতেই বললেন,

ডাক্তার, শুনলাম আপনার রিটায়ারমেন্টে হয়ে গেছে?
আমি: জ্বি, দু’সপ্তাহ হলো।
দুদু মিয়া: আহা, এই কয়দিনে চেহারাটা কেমন যেনো হয়ে গেছে।
আমি: হ্যাঁ, দেশে ফেরার টেনশন, মাল সামান কার্গো করা। করোনার জন্য ফ্লাইট সমস্যা সব নিয়ে ঝামেলায় আছি।
দুদু মিয়া: হুম, এখন চাকরি নাই! চেহারাটা ভেঙ্গে গেছে, চোখের নিচে কালি (করুণার দৃষ্টি)!
আমি: আর কত চাকরি করবো বলেন। প্রায় ৩৭ বছর তো করলাম। এখন সুস্থ থাকতে থাকতে দেশে ফিরে যাই।
দুদু মিয়াঃ দেশে গিয়ে কি করবেন ভাবছেন কিছু ?
আমি: আগে যাই তো। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
দুদু মিয়া: (দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) বিদেশে থাকা মানুষ দেশে গেলে বেশি দিন টিকে না।
আমি: সে কেমন?
দুদু মিয়া: আমার জানা মতে যে কয়জন বয়স্ক লোক দেশে গেছে ২-৩ বছরের বেশি বাঁচে নাই।
আমি: ও, আচ্ছা । তাই নাকি? আমাকে আপনি ভয় পাইয়ে দিলেন দুদু মিয়া।
দুদু মিয়া: সাবধানে থাইকেন। হায়াত মউত আল্লাহর হাতে।

বিদায় নিয়ে বাসায় আসতে আসতে দুদু মিয়ার শেষ কথাটিই আমাকে ভাবিয়ে তুললো। ডাক্তার হিসেবে প্রায় আমাদের খুব কাছে থেকে মৃত্যু দেখতে হয়। তারপরও মৃত্যুকে এতো ভয় কেনো আমাদের ?

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,

“মরিতে চাহিনা আমি

সুন্দর ভূবনে….”

আবার তিনিই ‘ভানু সিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে’ লিখলেন,

“মরনরে,
তুঁহু মম
শ্যামসমান ……”

মৃত্যু নিয়ে ভিন্নমত ও ভিন্ন চিন্তা থাকলেও মানুষ শেষ পর্যন্ত বুঝি বাঁচতেই চায়।

একটা জিনিস খেয়াল করলাম। রিটায়ারমেন্টের পরে সবাই আমাকে করুণার চোখে দেখছে। যতোদিন টাকা কামাই করবেন, ততোদিনই স্ত্রী পুত্রকন্যার কাছে আপনি আদরের। অবশ্য ব্যতিক্রমও রয়েছে।
নিজেকে এতোদিন একটা চলমান এটিএম বা ক্রেডিট কার্ড মনে হয়েছে। এখন তার ব্যালেন্স শূন্যের কোঠায়। সুতরাং আস্তে আস্তে নিজের চাহিদাও কমে যাবে সেটাই তো স্বাভাবিক। আমি এখন দেশে গেলে সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে বিবেচিত হবো। বেকার অবস্থা। সিনিয়র সিটিজেনদের এক্সপার্টিজ কাজে লাগানোর মত কোনো রকম সুযোগ এখনো বাংলাদেশে তৈরি হয় নি। এই বয়সটায় অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা বর্তমান বৈশ্বিক ব্যবস্থায় পিতামাতার জন্য বৃদ্ধাশ্রমের কথা চিন্তা করে, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।

এখানে গাড়ি বিক্রি না করলে আমার ফাইনাল এক্সিট ভিসা হবে না। তাই বন্ধুবান্ধবদের বললাম, আমার গাড়িটি বিক্রি হবে। টয়োটা করোলা ২০০৯ মডেল। এ্যাশ কালার। কেউ কেউ আসে। পাত্রী দেখার মতো দেখে। এটা ওটা জিজ্ঞেস করে, কাগজপত্র দেখে। তারপর কেউ বলে রংটা জ্বলে গেছে, পেছনে বাম দিকটা একটু ঘষা খাওয়া, ইঞ্জিনটা কিচ কিচ শব্দ করে, এসি ঠান্ডা কম করে ইত্যাদি। এরপর দাম দর করতে গিয়ে বলে, এতো দাম! কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতো সব হজম করে সঠিক ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করছি।

হঠাৎ আমাদের হাসপাতালের একজন বাঙ্গালী টেকনিশিয়ান, হায়দার আলি এসে বললো, স্যার গাড়িটা আমি নিতে চাই। সে গত চার বছর হলো গাড়িটা দেখছে, তাই গাড়ি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল। গাড়িটা দেখেশুনে দামদর করে কিছুটা আশানুরূপ মূল্যে গাড়ি বিক্রি চূড়ান্ত হলো। কিছু অর্থ অগ্রীম নিয়ে এগ্রিমেন্ট করে ফেললাম। হায়দার বললো এক সপ্তাহের মধ্যেই সে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করে গাড়ি নিয়ে যাবে। এরপর সে প্রায় প্রতিদিন তার একটা ভটভটি (ভেসপা মটর সাইকেল) নিয়ে এসে গাড়ি দেখে যেতো। তার ভয় আমি পাছে বেশি দাম দিয়ে অন্য কারো কাছে বেচে দেই। একদিন স্টার্ট দিয়ে গাড়িতে বসে আছি। তখনি ভটভটি নিয়ে হায়দার হাজির। আমার দিকে না তাকিয়ে গাড়ি পরখ করতে করতে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, স্যার কই যান?
আমি: একটু শপিং মলে যাবো।
হায়দার: ও, আমি মনে করলাম দূরে কোথাও যাবেন।
আমি: না দূরে কোনো কাজ নাই।
তার অর্থ হলো এখন থেকে গাড়িটাকে সে নিজের ভাবতে শুরু করেছে। এর পর পাঁচ দিনের মাথায় সে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করে সন্তুষ্টচিত্তে গাড়িটা নিয়ে গেলো। একইদিনে অনলাইনে ওর নামে গাড়ি ট্রান্সফারও করে দিলাম।

গাড়ি বিক্রি করার পর বুঝলাম, পরিবার বা স্ত্রী ছাড়া থাকা যায় কিন্তু গাড়ি ছাড়া থাকা বেশ কঠিন। ট্যাক্সি এই ছোট শহরে অতো এ্যাভেলেবল না। তাই প্রয়োজন হলে একে ওকে রিকোয়েস্ট করে গাড়ি ম্যানেজ করতে হচ্ছে।

হাসপাতালে আমার এক যুগের চাকুরী জীবনে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছি। রোগীরা বলে, যেওনা ডাক্তার। তুমি গেলে আমাদের কে দেখবে? তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে বিভিন্ন লেভেলে দরখাস্ত দিয়ে আমার এক্সটেনশন করার চেষ্টা করেছিল। কিন্ত সফল হয়নি।
রোগীরা যে আমাকে এতটা ভালোবাসে তা কখনো বুঝতে পারি নি। এক রোগী তো বলেই বসলো, ডাক্তার তোমার জন্য এখানে অন্য যে কোনো বিজনেসের ব্যবস্থা করে দিই। তবু তুমি আমাদের মাঝে থাকো। আমি এদের ভালোবাসায় আপ্লুত এবং বাকরূদ্ধ।

হাসপাতালে ডাক্তার ও সিস্টাররা একদিন আমার ফেয়ারওয়েলের আয়োজন করলো। বিশাল আয়োজন। মাল্টিন্যাশনাল কুজিনের আয়োজন সাথে কেক ও ডেসার্ট।

ডাক্তার ও সিনিয়র সিস্টাররা আমায় অনেক প্রশংসা করে বক্তব্য রাখলেন। পরিশেষে আমার বিদায়ী বক্তব্য। দীর্ঘ বারো বছরের আমার চাকুরির নানারকম অভিজ্ঞতার কথা বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে আসছিলো। চোখের কোনা ভিজে উঠলো। একসময় আর কথা বলতে পারছিলাম না। পাকিস্তানের ডা. ইমতিয়াজ আমার পিঠে শান্তনার হাত রাখলেন। আমি কোনোমতে আমার বক্তব্য শেষ করলাম।

বক্তৃতা পর্ব শেষ। এখন ফটো সেশন। তারপর খাওয়া। একজন পাকিস্তানি সিস্টার চিকেন বিরিয়ানি রান্না করেছিল। চমৎকার স্বাদ। ইন্ডিয়ান সিস্টাররা ইডলি সাম্বার আর ফিলিপিনোদের পানশিত। এছাড়াও বহুবিধ আইটেমে টেবিল সাজানো।
খাবার আগে আমার ইউনিট ইন চার্জ হাতে একগাদা গিফট ধরিয়ে দিলেন।

আমি জীবনের অধিকাংশ সময় পারস্য ও মধ্যপ্রাচ্যে কাটালাম। নানান অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিভিন্ন মানসিকতার মানুষের সাথে দেখা হয়েছে, মেলামেশা হয়েছে।
আত্মত্যাগ, ভালোবাসা, মায়ামমতা, সহমর্মিতা যেমন দেখেছি আবার স্বার্থপরতা, হিংসা, জিঘাংসাও দেখতে হয়েছে। তবে আমাদের মতো পরনিন্দা ও পরচর্চা করতে তাদের কমই দেখেছি।

বাংলাদেশে ডাক্তারী করা এখন আগের মতো সহজ নয়। আফসোসের সাথে বলতে হয়, ডাক্তারদের ভাবমূর্তি এখন বিভিন্ন কারণে প্রশ্নের সন্মুখীন। ভালো ডাক্তার প্রচুর থাকা সত্ত্বেও ডাক্তার ও রোগীদের মধ্যে ফারাক ও বৈরি সম্পর্ক বহুলাংশে বেড়েছ। ডাক্তার, রোগী, রোগীর আত্নীয়স্বজন, মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ, ঔষধ কোম্পানি, হাসপাতাল প্রশাসন, বিএমএ, বিএমডিসি,
মাল্টি মিডিয়া এবং সরকার সবাইকে এর দায়ভার কমবেশি বোধ হয় নিতেই হবে।
কারণগুলো সবাই জানেন ও বোঝেন কিন্তু কারো যেনো কিছু করার নেই, বলার নেই।

দেশে গেলে আমি সিনিয়র সিটজেন হবো। বন্ধুবান্ধবরা দেশে সাফল্যের উচ্চশিখরে আসিন। কেউ রিটায়ার করেছেন আবার কেউ এখনো প্রাইভেট হাসপাতালে কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত। এমতাবস্থায় দেশে গেলে যতোটুকু সম্ভব নিজের মান সন্মান বাঁচিয়ে মানব সেবামূলক কাজ করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবো ভাবছি।

(বিঃ দ্রঃ – সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে রচিত তবে চরিত্রের নামগুলো বদলে দেয়া হয়েছে।)

Omaima Akter Maria

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯ এ প্রাণ হারালেন প্রথিতযশা ডেন্টিস্ট

Tue Sep 29 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ করোনা মহামারীতে শহীদ হলেন আরেকজন চিকিৎসক। এবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন ডা. মো. শামসুজ্জামান। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) তিনি সৌদি আরবের প্রথিতযশা ডেন্টিস্ট ছিলেন। ঢাকা ডেন্টাল কলেজের ১৮ তম ব্যাচের (D-18) প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন তিনি। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণজনিত জটিলতায় রাজধানীর এভার কেয়ার […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo