ছবির নাম ‘অলীক সুখ’৷ মূল রচনা সুচিত্রা ভট্টাচার্য৷ স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, বিবেকের সংঘাত, সততার লড়াই৷ হাজারও এক স্তর রয়েছে এই গল্পে৷ তারপরেও সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় অভিনয় প্রতিভা৷
প্রথমেই ডাউনলোড করার জন্য ডিভিডিরিপ লিংক দিচ্ছি। ডাউনলোড (মেগাফায়ার্জ লিংক) -Resume able
অলীক সুখ এবং বিপর্যয়
মূল প্লটের কেন্দ্রে রয়েছে একটি অলীক সুখ-ভাবনা৷ কিংশুক (দেবশঙ্কর হালদার) একজন সফল গাইনোকলজিস্ট সার্জেন৷ দিনে পাঁচটা চেম্বার, তিনটে অপারেশন, পঞ্চাশটা রোগী অ্যাটেন্ড করা তার কাজ৷ পাশাপাশি বারো বছরের পুরনো স্ত্রী রম্যাণি (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত) আর এক পুত্র সন্তান, বাবা-মা নিয়ে তার সুখের সংসার৷ তেরো নম্বর বিবাহ বার্ষিকীতে সে চায় তার স্ত্রীকে কোটি টাকার ফ্ল্যাট উপহার দিতে৷ একজন সফল রোজগেরে স্বামীর পক্ষে খুবই বাস্তবিক চাহিদা৷ সে বউকে সুখে রাখতে চায়৷ এই সুখ কতটা অসার, কতটা অলীক- সেই গভীর সত্য কিংশুকের জানা নেই৷ ফলে, সে নার্সিংহোমের কাছ থেকে ঘন্টা তিনেকের ছুটি নিয়ে ফ্ল্যাট বুক করতে যায়, আর এই অবসরেই মারা যায় প্রথমবার সন্তানের জন্ম দিতে আসা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে কবিতা (সোহিনী সেনগুপ্ত)৷ কবিতা কিংশুকের তত্ত্বাবধানে থাকা রোগী৷
চিকিত্সকের অনুপস্থিতিতে চিকিত্সার অভাবে মারা যায় এক রোগী৷ আঙুল ওঠে কিংশুকের দিকে৷ এবারে কিংশুক কী করবে? সে কি এই বিপর্যয় রোধ করতে পারবে? সে কি এর পরেও স্ত্রীকে এনে দিতে পারবে সেই অলীক সুখের প্রতীক কোটি টাকার ফ্ল্যাট? বেশ চমত্কার কাহিনির সেট-আপ৷ হিরো ইন ডিসট্রেস৷ ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে কাহিনির মোড় ঘুরে যায়৷ এসে দাঁড়ায় বিবেক৷ গল্পের সেন্ট্রাল থিম হয়ে ওঠে ‘হিপোক্র্যাটিক ওথ’৷ তবু এই বিবেক জাগ্রতকারী গল্পও আমরা দেখে ফেলতে পারি শুধুমাত্র অভিনয়ের গুণে৷ ছবির জোর এইখানেই৷
বিবেক না, অশরীরী?
কবিতা মারা গিয়েছে৷ কিন্ত্ত এরপরে তার শরীর নিত্যসঙ্গী রম্যাণির৷ হতে পারে সেই কবিতা অশরীরী, কিংবা রম্যাণির বিবেক অথবা তার দ্বৈত সত্ত্বা৷ ঠিক স্পষ্ট নয়৷ না হলেও যে খুব একটা ক্ষতি হয়েছে তাতো নয়ই, বরং সোহিনী সেনগুপ্তর এক-মাত্রিক বাচিক এবং শারীরিক, বিশেষ করে চোখ এবং হাতের, অভিনয় চরিত্রটার প্রতি কৌতূহলী করে রাখে আমাদের৷ মূলত এই চরিত্রটির কাজ তখন রম্যাণি-কিংশুকের মধ্যে বিচিত্র নাটকীয় সংঘাত ঘটানো৷ চরিত্রটির ব্যাপারে দর্শকের এই কৌতূহল নির্মাণে ডিওপি শীর্ষ রায়ের কম্পোজিশনও অনেকটাই দায়ী৷ এই পর্বে ঋতুপর্ণাও অভিনয় করেন বেশ নীচু স্কেলে৷ এমনকী কখনও-কখনও তিনি লম্বা কোনও দৃশ্যে সম্পূর্ণ নির্বাক হয়েও বাঙ্ময়৷ কবিতার তুলনায় রম্যাণি চরিত্রটি অনেক বেশি মাল্টি-লেয়ারড৷ নানা রকম টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে চরিত্রটি ওঠা-নামা করতে থাকে৷ ফলে, সোহিনীর তুলনায় ঋতুপর্ণাকে দৃশ্যগতভাবে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে৷ এবং তিনি সফল৷ কবিতা-রম্যাণির সংযোগে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে গিয়ে কিংশুক চরিত্রে দেবশঙ্কর হালদার কিছুটা যেন উচ্চকিত৷ লাউড৷ কিন্ত্ত কিংশুকের সাফল্যের আস্ফালনটাই তো একটি ‘লাউড’ ঘোষণা৷ সুতরাং দেবশঙ্করের এই অভিনয় যে চরিত্রের প্রয়োজনে তা আশা করাই যায়৷ সেই কারণেই ব্রড জেশ্চারের মাধ্যমে চরিত্রটির অসহায়তা প্রকাশ করতে দেখা যায় তাকে৷ সিনেমার এই দ্বিতীয় অঙ্কে এই তিনজনই প্রধান এবং এই অঙ্কের নাটকের মূল উদ্দেশ্য ক্রমশ কিংশুককে কোণায় ঠেলে নিয়ে যাওয়া৷ তার অসহায়তা যে মেকি, এবং সেটা যে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা ভুল কাজের ওপর, এই সত্যটা তাকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নেওয়া৷ কী করবে এখন কিংশুক? পারবে কি সে নিজের বিশ্বাসে স্থির থাকতে? এরপরেও পারবে কি সে স্ত্রীকে কোটি টাকার ফ্ল্যাট উপহার দিতে? এই রকম একটা টেনশন নিয়ে দ্বিতীয় অঙ্কের শেষ৷
সাব-প্লট এবং থার্ড অ্যাক্ট
মূল প্লটে বিবেক ঢুকে যাওয়ার পর কৌতূহলটা অনেক বেশি গড়ে ওঠে সাব-প্লট ঘিরে৷ সাব-প্লটের কুশীলব মৃতা কবিতার স্বামী (বিশ্বনাথ বসু) আর কবিতার বোন৷ মারা যাওয়ার আগে কবিতা জন্ম দিয়ে গিয়েছিল এক শিশুর৷ সেই শিশুর দেখভাল করে এখন কবিতার বোন (সায়নী ঘোষ)৷ ধীরে ধীরে এই শিশুটিকে ঘিরে এই দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠে একটা সম্পর্ক৷ মূল প্লটের মতো এই সাব-প্লটেও দর্শকের কৌতূহল থাকে শেষে কী হবে?
তৃতীয় বা শেষ অঙ্কে যখন ক্রমশ সমাধানের পথে এগোচ্ছে প্লট এবং সাব-প্লটের নাটকীয় প্রশ্ন, তখনই এক দুর্ঘটনায় পড়ে রম্যাণি৷ সে তখন সন্তান সম্ভবা৷ মফঃসলের এক নার্সিংহোমে সে ভর্তি৷ আর ঠিক তখনই টেবিলের তলায় ঘুষ দিয়ে কোর্টের বাইরে সেটলমেন্ট করে বেরিয়ে আসতে আসতে কিংশুক জানতে পারছে তার স্ত্রীর দুর্ঘটনা৷ এবার ঘটনাচক্রে কিংশুক নিজেই তৈরি করে সেই শুরুর সংঘাত, যে সংঘাতের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে নিজেকে কবিতার মৃত্যুতে৷ যে সংঘাত তৈরি করেছিল কবিতার স্বামী৷ একটা বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ হয়৷ বিবেক তার ভূমিকায় সফল৷ তবে এখানেই ছবির শেষ নয়৷
ছবির শেষ
জানা গেল কবিতার স্বামী এবং বোন বিয়ে করবে সেটলমেন্টের টাকা পেয়ে৷ দেখা গেল নার্সিংহোমে স্ত্রীর কাছে কিংশুক স্বীকার করছে তার অপরাধ৷ কেবল জানা গেল না কোটি টাকার ফ্ল্যাটটা নিয়ে শেষ পর্যন্ত কিংশুক কী ভাবছে? যেটা নিয়ে ‘অলীক সুখ’-এর শুরু, সেই মূল প্রশ্নের কোনও উত্তর শেষ পর্যন্ত চিত্রনাট্যে নেই৷ এটা দুর্বলতা ভেবে নিলে, দুর্বলতা৷
দেখবেন কি?
প্রতিটি চরিত্রের অভিনয় ভালো৷ এমনকী একটি অত্যন্ত ছোট চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি কোন মাপের অভিনেতা৷ আসলে অভিনয় জীবনের একটা পর্যায়ে পৌঁছে, কয়েক জনের ক্ষেত্রে, স্ক্রিন প্রেজেন্স-এর সময় কতটা, তার বোধহয় আর অর্থ থাকে না৷ যেটা বলার, তা হল, ‘হিপোক্রিটিক ওথ’, সুখের সন্ধান, ওসব জটিল প্রশ্নের মধ্যে না ঢুকতে চাইলেও, শুধুমাত্র অভিনয়ের গুণেই এ ছবি দেখা যায়৷ অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় নিজে গিটার হাতে ‘এমবিবিএস’ গানটি পর্দায় জমিয়ে গেয়েছেন৷ ছবির এটাও একটা অতিরিক্ত আকর্ষণ৷
(এইসময়)
I am an MBBS-
আইএমডিবি রেটিং 7.7/10
ইউটিউবে-