প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -৪৬
“অস্পর্শী”
লেখকঃ সামিরা আফরোজ
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ
মোবাইলের অ্যালার্ম বেজেই চলেছে,অথচ রাহাতের ঘুম থেকে উঠার নামই নেই।সীমান্ত রাহাতকে একটা সজোরে ধাক্কা দিতেই রাহাত ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।সামনের দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখল,ঘড়িতে ১২ টা বাজে।”হায় হায়!ক্লাস তো ছিল ৯ টায়।অই,তুই আমারে আগে ডাক দিবি না?১২ টা বাজে আর এখন ডাক দিছস?”একনাগাড়ে রাহাত কথা গুলো বলে থামল।”আরে ঘড়ি তো নষ্ট।ব্যাটারি শেষ। মোবাইলে দেখ ৮:৩০ টা বাজে।ভুলে গেছিস,লেকচারের পর আমাদের গ্রামের ট্যুরের কথা?নে,এখন তাড়াতাড়ি রেডি হ” বলে সীমান্ত মুখ ধুতে চলে গেল।
দুই বন্ধু লেকচার শেষ করে তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিল।বাসে ৫ ঘণ্টা জার্নির পর সেখান থেকে একটা ভ্যান ভাড়া করল।অত:পর দীর্ঘ জার্নি শেষে মাগরিব নামাজের ঠিক আগে আগে এসে তারা গ্রামের বাড়ি পৌঁছায়।সীমান্তদের গ্রামের এই পুরাতন রাজবাড়ি সত্যিই দেখার মত।কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর সীমান্তর মা সীমান্তকে নিয়ে মফস্বলে চলে যান। পড়াশুনার সুবিধার জন্যই সীমান্ত ভার্সিটির হোস্টেলে উঠেছিল।আর গ্রামের বাড়ি দেখাশোনারর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বুড়ো এক গ্রামের লোককে।সীমান্ত আর রাহাত পৌঁছার পর সেই বুড়ো কেয়ারটেকার অনেক জোরাজুরি করেন যাতে তারা রাতটা সেই বুড়ো লোকের বাসায় কাটায়।কিন্তু রাহাত মানতে নারাজ।শেষে বুড়ো চাবি বুঝিয়ে রুম দেখিয়ে চলে যান।
চাবি নিয়ে রাহাত আর সীমান্ত প্রথমে দোতলার একটি রুমের দরজা খুলল।ঠিক আগেকার দিনের রাজপ্রাসাদের মতো।তবে সমস্যাও আছে।নেই কোনো নেটওয়ার্ক,নেই কোনো কারেন্ট। আর ঘরের এক কোণে টিমটিম করে হারিকেনের আলো জ্বলছে।”চল্ দোস্ত,অন্য রুমগুলোও ঘুরে আসি।” সীমান্ত তখন রাহাতকে নিয়ে দরবার ঘর,দালান ঘর ঘুরে দেখাতে লাগল।চার্জার লাইট অার মোবাইলের অালোতেও প্রত্যেকটি ঘর এত সুন্দর আর আকর্ষণীয় লাগছিল যে রাহাতের মনে হচ্ছিল এখানেই যদি সারাজীবন থেকে যাওয়া যেত!!
হঠাৎ করে বাহিরের ঘরে ধুপধাপ শব্দ শোনা গেল।দুজনে দৌঁড়িয়ে সেখানে গিয়ে দেখল কেউ নেই।রাহাত সীমান্তকে সাহস দিয়ে বলল,”আরে পুরাতন বাড়ি তো,ইঁদুরের দৌঁড়াদৌঁড়ির শব্দ হয়তো হবে।চল্ শেষের রুমটায় যাই।” “দোস্ত,ওই রুমটায় কেউ কখনও যায় না।আমার মা কেন জানি বারবার নিষেধ করতেন যেন কখনও ওখানে না যাই।” “তুই রসায়নের ছাত্র হয়ে এখনো বিশ্বাস করিস,ভূত-প্রেত আছে!!চল তো যাই। “…
ওই কক্ষের তালায় মনে হয় জং ধরা।অনেক কষ্টে অবশেষে তালা খোলা গেল।দরজা খুলতেই কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ।কিন্তু এই রুমটিই মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর।কারুকার্যখচিত সোনার পালঙ্ক,নক্সা আঁকা ফুলদানি,দামি কার্পেট।তবে দেয়ালে ঝুলানো একটিমাত্র ছবি!
চার্জার লাইটটা উঁচু করে ছবিটার দিকে ধরতেই মুহূর্তের মধ্যে নিভে গেল লাইটটা।সীমান্ত ততক্ষণে অনেক ভয় পেতে শুরু করেছে।হঠাৎ করে আপনা থেকেই জ্বলে উঠল চার্জার লাইটটা।দেয়ালে একটি মেয়ের ছবি।অপরূপ সুন্দরী!ছবিটা দেখতে এতটাই জীবন্ত যেন মনে হচ্ছে সামনেই দাঁড়িয়ে আছে এই অপরূপ মানবী।দুইজনেই স্তব্ধ হয়ে আছে।হঠাৎ করেই বাইরে থেকে দমকা বাতাস ঢুকল ঘরে,আর সশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।কিন্তু ওরা দৌঁড়িয়ে দরজার কাছে যেতেই দেখা গেল,দরজা কেউ হেঁচকা টানে ওদের জন্য খুলে দিল।কিন্তু কাউকেই দেখা গেল না।রাহাত আর সীমান্ত দুজনে দ্রুত রুম থেকে বের হল।তালা লাগাতে গিয়ে দেখে তালা ভাঙা!!অগত্যা তারা দরজা চাপিয়ে দিয়ে চলে এল নিজেদের রুমে।অার একজোড়া ভয়ংকর চোখ নীরবে ওদের অনুসরণ করে চলল!!
তারা প্রথম যে রুমে ব্যাগ নিয়ে উঠেছিল,সেখানে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।সঙ্গে নিয়ে আসা খাবার খেয়ে তারা ঘুমাতে চলে যায়।দুজনেই ক্লান্ত ছিল,তাই ঘুম আসতে আর দেরি হল না।অনেকক্ষণ পর রাহাতের ঘুম ভাঙল,পাশে মোবাইলটা নিতে গিয়ে দেখে বিছানায় সীমান্ত নেই।ঘরে হারিকেন এখনো জ্বলছে।রাত প্রায় দুটো।কোথায় গেল সীমান্ত এতো রাতে??আবার দরজাটাও খোলা।রাহাতের গা ছমছম করতে লাগল।সে কি একবার উঠে গিয়ে দেখবে সীমান্ত কোথায়?হঠাৎ করে মনে হল,কাছে কোথাও সীমান্তর কান্না ভেসে আসছে!রাহাত দ্রুত রুম থেকে বের হল।একদম ঠিক ওই তালাভাঙা রুম থেকেই মনে হচ্ছে আওয়াজটা ভেসে আসছে!রাহাত এক দৌঁড়ে সেই রুমের সামনে গেল।রুমের ভিতর ঢুকবে কি ঢুকবে না,চিন্তা করতে করতেই দেখল,সীমান্তর মত কেউ মেঝেতে কার্পেটের উপর শুয়ে আছে,ওর মুখটা অপর পাশে ফিরানো।”কিরে তুই এখানে ঘুমাস কেন?”বলে সীমান্তকে ধাক্কা দিতেই দেখলো,সীমান্তরর মুখ পুরা বীভৎস।ঘাড় থেকে অনবরত রক্ত পড়ছে,আর পুরো মুখে অাঁচড়ের দাগ!চিৎকার দিয়ে রাহাত রুম থেকে বের হতে যাবে, ওই মুহূর্তে রুমের দরজা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।কেউ একজন মনে হল রাহাতের ঘাড়ে হাত রাখল!”পালানোর পথ নেই,তাই পথ খুঁজো না”একটি মিষ্টি কণ্ঠের আওয়াজ এল।
রাহাত চট করে ঘুরতেই দেখে,সেই ছবির মেয়েটি!কি অপরূপ সুন্দরী!! রাহাত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।মেয়েটি সশব্দে হেসে উঠল।তার হাসির ঝংকার যেন প্রতিধ্বনি তুলছে।”কি ভাবছ?তোমার বন্ধুর এরকম দশা কেনো করলাম,তবে শুনো।তোমার বন্ধুর বড়মা ছিলেন আমার সৎমা।আমার মা মারা যাওয়ার পর বাবা তোমার এই বন্ধুর বড়মাকে বিয়ে করেন।তিনি ছিলেন যত না বদরাগী,তার চেয়েও বেশি লোভী।তাঁর শত অত্যাচারের সাক্ষী অামি।আমাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য এই রুমে আমাকে বন্দী করে রাখেন।কোন খাবার দেন নি।আমার মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন যাতে চিৎকার কেউ শুনতে না পারে।আর বাবাকে ভুল বুঝিয়েছিলেন,আমাকে পাগল বানিয়েছিলেন তাঁর কাছে।বাবা তখন তাঁকে অন্ধের মত বিশ্বাস করতেন।শেষে এই রুমে তিনি আমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারেন,যখন বাবা গ্রামের বাইরে তাঁর জমিদারির কাজে গিয়েছিলেন।আগুনের লেলিহান শিখায় তিলে তিলে দগ্ধ হই আমি,কেউ আমাকে বাঁচাতে আসে নি।আর তিনি সবাইকে বলে বেড়িয়েছিলেন,আমিই নাকি ঘরে আগুন দিয়েছি,মাথার ঠিক নেই বলে!!তাঁর এই নির্মমতার প্রতিশোধ নিয়েছি আমি।এই আমিই শেষে অামার সৎমাকে মেরেছিলাম ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে!আর তাঁকে মারার সময় তার ঔদ্ধত্যের কারণে শপৎ নিয়েছিলাম তাঁর বংশকে নির্বংশ করব অামি।তাই সীমান্তর দাদা,বাবাকেও আমি মেরেছি,আর সীমান্তকে মারার মধ্যে দিয়ে আমি আমার কাজ শেষ করেছি।” এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বলে খলখলিয়ে হাসতে হাসতে এবারে রাহাতের দিকে এগুতে লাগল মানবী!!
“আমাকে মেরো না,আমার দোষ নেই….” “কিরে,কি আবোলতাবোল বকছিস?উঠ্ কয়টা বাজে,সেই খেয়াল আছে??”সীমান্তর ডাকে রাহাত ধড়মড়িয়ে উঠল।এতক্ষণ যা দেখছিল সব দু:স্বপ্ন!!!সীমান্ত এদিকে বলে চলেছে,”ভুলে গেছিস?আজ না লেকচারের পর আমাদের গ্রামে যাবার কথা?”রাহাত দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল।ঘড়িতে ১২ টা বাজে!!! “আরে ব্যাটা ঘড়ি নষ্ট,মোবাইলে দেখ ৮:৩০ টা বাজে”সীমান্ত বলল।তখন রাহাত বলে উঠল-“দোস্ত শোন্, আমাদের গ্রামের ট্যুর ক্যানসেল।তোর আর ওই গ্রামে যাওয়ার দরকার নেই।আর কারণটা না হয়, অজানাই থাক…..।”
(সমাপ্ত)