আমরা সবাই হাঁপানি কিংবা শ্বাসকষ্ট রোগের কথা শুনেছি, এই রোগকে মেডিকেলের ভাষায় অ্যাজমা (Asthma) বলা হয়। আসুন অ্যাজমা সমপর্কে কিছুটা জেনে নিই।
অ্যাজমা কাকে বলে?
অ্যাজমা হচ্ছে শ্বাসনালীর দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত একটি রোগ, যেই রোগে শ্বাসনালী যে কোনো এলার্জেন জাতীয় বস্তুর প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীলতা দেখায়। এবং প্রদাহের কারণে শ্বাসনালীর ভিতরের মিউকাস মেমব্রেন ফুলে যায়, এতে করে শ্বাসনালীর টিউব টা সরু হয়ে যায়। আর এই সরুপথে ফুসফুসে বাতাস প্রবেশ করতে এবং বের হতে বাধা প্রাপ্ত হয়।
শ্বাসনালী একটি টিউবের মত, আমরা জানি যে, শরিরের কোনো জায়গায় ইনফ্লামেশন কিংবা প্রদাহ হলে শরীরের ওই জায়গা ফুলে যায়, এখন যদি একটি টিউবের মত অর্গানের ভিতরের আবরণে প্রদাহ হয়, তাহলে এই টিউবের ভিতরের অংশ ফুলে যাবে, এতে করে টিউবের ভিতরের গহবর সরু হয়ে যাবে, একটি সরু পথে বায়ু চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হবে। আর এই সরুপথে বায়ু চলাচলের কারণে বাঁশির মত শব্দ হবে, যাকে wheezing বলা হয়।
আবার এই সরু পথে ফুসফুসে বাতাস আসা যাওয়া করতেও কষ্ট হবে, যাকে Breathlessness বা শ্বাসকষ্ট বলে।
আবার শ্বাসনালীর একটি বৈশিষ্ট হচ্ছে শ্বাসনালিতে কোনো প্রদাহজনিত বস্ত আসলে শ্বাসনালী খুব জোরে ধাক্কা সহকারে বায়ু নির্গমন করে সেই প্রদাহ জনিত বস্তকে শ্বাসনালি থেকে বের করতে চেষ্টা করে তথা Cough কিংবা কাশি উৎপন্ন করে প্রদাহজনিত বস্ত শ্বাসনালি থেকে বের করে শ্বাসনালী পরিষ্কার করতে চেষ্টা করে। অ্যাজমা তে যেহেতু শ্বাসনালিতে প্রদাহ হয়, তাই শ্বাসনালী কাশি তৈরি করে সেই প্রদাহজনিত বস্ত থেকে নিজেকে পরিষ্কার করতে চেষ্টা করে। তাই কাশি উৎপন্ন হয়। শুকনা কাশিও হতে পারে, আবার মিউকাস সমৃদ্ধ (Productive Cough) কাশিও হতে পারে।
আবার নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় যেই পরিমান বায়ু ফুসফুসে প্রবেশ করে, শ্বাসনালী সরু হয়ে যাওয়ার কারণে তা পরিপূর্ণ বের হতে পারেনা। এই জন্য কিছু বাতাস প্রতিবার নিঃশ্বাস এর সাথে ফুসফুসে জমা হতে থাকে। ফুসফুস বাতাসে পরিপূর্ণ হয়ে প্রসারিত হয়ে যায়, যার কারনে বুকে চাপচাপ অনুভব হয়, যাকে Chest tightness বলে।আবার বুকে ব্যাথা ও হতে পারে।
তাহলে আমরা অ্যাজমার প্যাথোফিজিওলজি থেকে অ্যাজমা রোগের ৪ টা উপসর্গ পেলাম।
১। বাঁশির মত শব্দ বা wheezing
২।শ্বাসকষ্ট বা breathlessness
৩।কাশি বা Cough
৪। বুকে চাপচাপ অনুভব হওয়া বা chest tightness.
৫। শিশুদের অ্যাজমা দেখা দিলে সাথে জ্বর ও চলে
আসবে।
অ্যাজমার উপসর্গ রাত্রে এবং ভোর সকাল বেলায় বেশি দেখা দেয়। অ্যাজমার জন্য উপরের ৪ টি উপসর্গ থাকতে হবে এমন কোনো শর্ত নাই, কারো কারো ক্ষেত্রে কেবল একটি উপসর্গ থাকতে পারে,
যথা কোনো অ্যাজমা রোগীরের উপরের ৪ টা
উপসর্গের কেবল একটি উপসর্গ তথা কাশি রয়েছে, তাহলে এইটাকে বলা হবে Cough Variant Asthma।
এইভাবে কারো ক্ষেত্রে কেবল শ্বাসকষ্ট আর বাশির মত শব্দ থাকতে পারে, আবার কারো কেবল কাশি আর বাশির শব্দ থাকতে পারে।।
অ্যাজমার প্রকারভেদ
১। Extrinsic Asthma
যদি অ্যাজমার বাহ্যিক কোনো কারণ সনাক্ত করা যায়, তাহলে এইটাকে Extrinsic Asthma বলে। যেমন একটি বাচ্চা ধুলা-বালি কিংবা ঠান্ডা কিছু খেলে যদি তার অ্যাজমার উপসর্গ দেখা যায়, তাহলে এই প্রকার অ্যাজমাকে Extrinsic Asthma বলা হবে, কারণ এখানে অ্যাজমার কারণ জানা যায়
২। intrinsic Asthma
যদি অ্যাজমার কোনো কারণ সনাক্ত করা না যায়, তাহলে তাকে intrisic Asthma বলে।
উপসর্গের ভিত্তিতে অ্যাজমাকে আবার ৩ ভাগে ভাগ করা হয়।
১. মাইল্ড ইন্টারমিটেন্ট অ্যাজমা:
যদি অ্যাজমার উপসর্গ সপ্তাহে একবার করে দেখা দেয় ৩ মাস পর্যন্ত, এবং প্রতি মাসে ২ রাত কিংবা তার কম রাত অ্যাজমা অ্যাটাক হয়, তাহলে এইটাকে মাইল্ড বা স্বল্প পরিসরের অ্যাজমা বলে।
২। মডারেট অ্যাজমা
যদি অ্যাজমার উপসর্গ প্রতিদিন একবার করে দেখা
দেয়, কিংবা প্রতি সপ্তাহে এক রাত করে কিংবা প্রতি মাসে ৩-৪ রাত করে যদি অ্যাজমার উপসর্গ দেখা দেয়, আবার ভালো হয়ে যায়, তাহলে এইটাকে মডারেট অ্যাজমা বলে।
৩। সিভিয়ার বা ভয়াবহ অ্যাজমা
যদি অ্যাজমার উপসর্গ সমূহ প্রতিদিন একবার করে দেখা দেয়, এবং তা ভালো না হয়ে বাড়তেই থাকে, এবং রাত্রে যদি আরো বেড়ে যায়, তাহলে এইটাকে সিভিয়ার অ্যাজমা বলে।
অ্যাজমা কাদের বেশি হয়?
শিশুদের অ্যাজমার প্রবণতা তুলনামুলক বেশি থাকে, তবে যেই কোনো বয়সেই অ্যাজমা হতে পারে।
অ্যাজমার কারণ
কিছু মানুষ কেন অ্যাজমা দ্বারা আক্রান্ত হয়, তার সঠিক কারণ জানা যায়নি, তবে জেনেটিক কিংবা বংশগত অ্যাজমার প্রবণতা পরবর্তী প্রজন্মে অ্যাজমা আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রাখে।
অ্যাজমার ট্রিগার ও রিস্ক ফ্যাক্টর
১। অ্যাজমা জেনেটিক ভাবে কিংবা পারিবারিক ভাবে স্থানান্তর হতে পারে। বাবা মায়ের যদি অ্যাজমা থাকে, তাহলে সন্তানের ও অ্যাজমা হতে পারে।
২। এলার্জি জাতীয় বস্তর সংস্পর্শের কারণে অ্যাজমা হতে পারে। যথা ধুলা-বালির কারণে, গৃহপালিত পোষা প্রাণীর সংস্পর্শ যথা বিড়াল কুকুর ইত্যাদির সংস্পর্শ থেকে, বিচানার অভ্যান্তরীন ক্ষুদ্র অনুজীব যথা হাউস ডাস্ট মাইটের কামড় থেকে অ্যাজমা উপসর্গ দেখা দিতে পারে, আর এই ধরনের অ্যাজমাগুলি শিশু বয়সেই বেশি হয়ে থাকে।
৩। গৃহাভ্যন্তর যে কোনো দূষিত বস্তর সংস্পর্শ থেকে অ্যাজমা হতে পারে।
৪। শিশুকালের শ্বাসনালীর ইনফেকশন থেকে দীর্ঘস্থায়ী অ্যাজমা হতে পারে, যথা কারো যদি রেসপাইরেটরি সিংসাইটিয়াল ভাইরাস ইনফেকশন হয়, তবে তা থেকে অ্যাজমা হতে পারে।
৫। এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবারের অভাবেও অ্যাজমা হতে পারে। যথা ভিটামিন এ, ই, ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারের অভাবে অ্যাজমা দেখা দিতে পারে।
৬। অতিরিক্ত আদ্র পরিবেশ কিংবা অতিরিক্ত শুষ্ক
পরিবেশে বসবাস করার কারণেও অ্যাজমা হতে পারে।
৭। অতিরিক্ত ঠান্ডা পানীয়, কিংবা শীত থেকেও অ্যাজমা হতে পারে।
৮। যে কোনো এলার্জিক রোগ থেকে অ্যাজমা হতে পারে।
৯। ইমিউনুগ্লোবিউলিন-ই এর পরিমান বেড়ে গিয়ে অ্যাজমা এবং অন্যান্য এলার্জির উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
১০। ফ্যাক্টরি, মিল, কল কারখানার বর্জ্য পদার্থের সংস্পর্শ থেকে অ্যাজমা দেখা দিতে পারে।
১১। বায়ু দূষন অ্যাজমার অন্যতম কারণ
কখন অ্যাজমা বেড়ে যায়?
বসন্তকাল এবং শীতকালে অ্যাজমা বেড়ে যায়, বসন্তকালে ফুলের পাপড়ি সমূহ পরিবেশে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে পড়ে, তা নাকে প্রবেশে করে শ্বাসনালিতে গিয়ে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, তাই বসন্ত কালে অ্যাজমা বেড়ে যায় আবার শীতকালে অতিরিক্ত ঠান্ডা রেস্পাইরেটরি মিউকোসাকে স্টিমুলেট করে প্রদাহ তৈরি করে অ্যাজমা উপসর্গ তৈরী করে।
প্রতিরোধ
১। শিশুদেরকে ধুলাবালি মুক্ত রাখবে
২।পোষাপ্রাণী থেকে দুরে রাখবে
৩। বিড়ালের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখবে
৪। অতিরিক্ত আদ্র কিংবা অতিরিক্ত শুষ্ক পরিবেশ
পরিহার করে চলবে
৫। থাকার ঘর ভালোভাবে পরিষ্কার রাখবে, বিচানাতে যেন কোন হাউস ডাস্টমাইট বাসা বাঁধতে না পারে, সেই বিষয় খেয়াল রাখবে। বিচানার অনুজীব সমূহ খালি চোখে দেখা যায়না, তবে রোদের তাপে এই গুলি মরে যায়, তাই কিছুদিন পরপর বিচানা চাদর, কম্বল তোষক ইত্যাদি রোদের তাপে শুকিয়ে নিবে।
৬। শিশুদের কে রেফ্রিজারেটর এর পানি পান করানো থেকে বিরত থাকবে।
৭। যে কোনো দূষিত বায়ু যথা অন্যের ধূমপানের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখবে।
৮। যেইসব খাবার খেলে এলার্জি দেখা দেয়, তথা যেইসব খাবারের মাঝে হাইপারসেনসিটিবিটি রয়েছে, তা পরিহার করে চলবে।
৯। একবারি শিশু অবস্থায় গরুর দুধ পান করলে অ্যাজমা হবার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই অন্তত ১ বছর পর্যন্ত গরুর দুধ থেকে বিরত রাখি।
১০। অ্যাসপিরিন এবং অন্যান্য পেইন কিলার মেডিসিন অ্যাজমা তৈরি করে, তাই খুব প্রয়োজন না হলে এইগুলি ব্যবহার থেকে বিরত থাকবে।
ইনভেস্টিগেশন
অ্যাজমা মূলত ক্লিনিক্যালি ডায়াগনোসিস করা হয়, তবে ইনভেস্টিগেশন হিসাবে এই টেস্ট গুলো করা হয়:
১। পালমোনারি ফাংশন টেস্ট তথা স্পাইরোমেট্রি টেস্ট, পিক ফ্লো মিটার ইত্যাদি
২। সিবিসি করে ইওসিনোফিল কাউন্ট দেখে এলার্জির পরিমান যাচাই করা হয়
৩। ইমিউনুগ্লোবিউলিন-ই টেস্ট
৪। স্পুটাম এক্সামিনেশন
৫। এক্সরে
চিকিৎসা
অ্যাজমার তীব্রতা অনুযায়ী একেকজন কে একেক প্রকার চিকিৎসা দেওয়া হয়।
১। মাইল্ড অ্যাজমা এর ক্ষেত্রে short acting bronchodilator inhaler দেওয়া হয়। উপসর্গ দেখা দিলে সালবিউটামল ইনহেলার ইত্যাদি ব্যবহার করলে উপসর্গ থেকে সুস্থ থাকে।
২। মডারেট অ্যাজমা কিংবা যাদের দুই বছর যাবত অ্যাজমা রয়েছে, অথবা যাদের প্রতি সপ্তাহে তিনবার করে উপসর্গ দেখা দেয়, এমনকি অ্যাজমার উপসর্গের কারণে তথা শ্বাসকষ্ট কিংবা কাশির কারনে যদি রাত্রে ঘুম ভেংগে যাওয়ার মত অবস্থা হয়, তাহলে সালবিউটামল ইনিহেলার এর সাথে কর্টিকোস্টেরয়েড ইনহেলার ও দেওয়া যেতে পারে। উল্যেখযোগ্য স্টেরয়েড ইনহেলার হচ্ছে,
1. Beclomethasone Dipropionate
2. Budesonide
3. Fluticason
এইভাবে পর্যায়ক্রমে Long acting bronchodilator inhaler Salmetro, or Formeterol ইত্যাদি দিবে।
যখন অ্যাজমার সিভিয়ার উপসর্গ কন্ট্রোলে আসবে, তখন prophylactic treatment হিসাবে রেগুলার মন্টিলুকাস্ট অথবা থিওফাইলিন ইত্যাদি ব্যবহার করবে।
ডা. ইসমাইল আযহারি
DCMC/2013-14
প্ল্যাটফর্ম ফিচার রাইটার:
সামিউন ফাতীহা
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর