অ্যাভিগান নিয়ে যত কথা

১২ এপ্রিল, ২০২০

– ডা. আবদুন নূর তুষার

অ্যাভিগান নামের ঔষধ নিয়ে প্রচুর কথা চলছে। এর জেনেরিক নাম ফ্যাভিপিরাভির। এটার মূল পেটেন্ট ফুজিফিল্মের কাছে। তাদের একটা ঔষধ গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে যেটার নাম ফুজি টোয়ামা। তারা মূলত রেডিওফার্মাসিউটিকাল/ তেজস্ক্রীয় ঔষধ, ক্যানসার, স্নায়ুতন্ত্র ও সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে গবেষণা করে। এরা ২০১২-১৩ সালে ফ্যাভিপিরাভির তৈরী করে, যা পশুর শরীরে পরীক্ষায় বেশ কিছু ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে বলে প্রমান পাওয়া যায়। যেমন ফ্লু, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস, ইয়েলো ফিভার ভাইরাস, জিকা ভাইরাস, রিফট ভ্যালি ফিভার ভাইরাস ও ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ ইত্যাদি।

২০১৩ সালেই আমেরিকার এফ ডি এ, এটার ফেজ থ্রি ক্লিনিকাল ট্রায়াল করেছিল। সেখানে এটা ফ্লুর বিরুদ্ধে কাজ করে বলে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু ঔষধটি বাজারজাত করা হয় নাই।

এর কারন কি?
কারন হলো গবেষণায় এটা টেরাটোজেনিক বলে প্রমাণিত হয়। মানে এটা গর্ভস্থ ভ্রুন ও শিশুর মারাত্মক ক্ষতি করে। এর ফলে গর্ভের শিশুর মৃত্যু হতে পারে , বিকলাংগ শিশু জন্ম নিতে পারে। এর অন্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও আছে।

গবেষণাটি র‌্যান্ডমাইজড ডাবল ব্লাইন্ডেড প্লাসেবো কন্ট্রোল স্টাডি ছিল। সেখানে একদলকে প্লাসেবো দেয়া হয়েছিল। আরেক দলকে ঔষধ। গবেষণাটি দৈবচয়ণ করে অংশগ্রহণকারী বেছে নিয়েছিল। গবেষকরা ডাবল ব্লাইন্ড ছিলেন। অর্থাৎ যারা ঔষধ খাচ্ছেন তারা জানতেন না তারা কি প্লাসেবো নিচ্ছেন নাকি ঔষধ, আর গবেষকরাও জানতেন না কাকে ঔষধ দিচ্ছেন আর কাকে প্লাসেবো। যারা গবেষণা করেন, তারা এটা বুঝবেন। এটা ঔষধ পরীক্ষার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি।

তবে টেস্টিং এর এক্সক্লুশন ক্রাইটেরিয়া ছিল বিরাট।
১. গর্ভবতী মা, স্তন্যদায়ী মা,
২. চার সপ্তাহের মধ্যে ফ্লু টিকা নিয়েছেন এমন ব্যক্তি,
৩. অ্যাজমা বা ক্রনিক ফুসফুসের অসুখ আছে এমন ব্যক্তি,
৪. গাউট আছে যাদের,
৫. যাদের ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া আছে,
৬. যাদের অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ ও প্যারাসিটামলে অ্যালার্জি
আছে,
৭. যারা স্টেরয়েড নেন,
৮. যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এমন অসুখ আছে,
৯. গবেষণার আগের ১ বছরের মধ্যে যাদের মানসিক অসুস্থতা
বা মানসিক রোগের ঔষধ খাওয়ার ইতিহাস আছে,
১০. যাদের কিডনি জটিলতায় ডায়ালিসিস করতে হয়,

এমন মানুষদের এই গবেষণায় রাখা হয় নাই। তার মানে এক বিরাট সংখ্যক মানুষ এর বাইরে ছিলেন।

২০১৫ সালে এই স্টাডি শেষ হয়। ২০১৪ সালে জাপানে এটা তৈরী করার অনুমোদন দেয়া হলেও স্বাভাবিক সময়ে এটা বাজারে পাওয়া যায় না। এটা কেবল হাসপাতালে দেয়া হয় এবং এটা তৈরী ও ব্যবহারের আগে জাপানের স্বাস্থ্য, কল্যান ও শ্রম মন্ত্রনালয়ের অনুমতি নিতে হয়। এবারো জাপানে এটা তৈরীর অনুমতি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নিতে হয়েছে। কেবল মাত্র কোন ভাইরাল আউটব্রেক হলে এটা তারা ব্যবহার করবে বলে রেখে দিয়েছিল।


কোভিড ১৯ শুরু হওয়ার পরে চীনে এটা ব্যবহার করা হয়েছে। এ বিষয়ে চীনের ন্যাশসাল রিসার্চ সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজ এর গবেষক কিংজিয়ানচাই যিনি থার্ড পিপলস হসপিটাল শেনজেন এ কাজ করেন, তিনি বলেছেন যে এই গবেষণায় তারা দেখেছেন যে এটা টেস্টে পজিটিভ হবার ৪ দিনের মধ্যে, রোগের লক্ষন প্রকাশের আগেই দিলে বেশি কাজ করে। এটা কাজ বেশী করে কমবয়সী, সঠিক ওজনের মানুষের মধ্যে, যাদের তখনো জ্বর হয় নাই। তাদের পরীক্ষাটি ছিল ননর‌্যান্ডম এবং ননব্লাইন্ড।

তাহলে ১৮ মার্চ ২০২০ এ গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হলো , চীন দাবী করেছে অ্যাভিগান কাজ করছে। এত দুর্বল গবেষণায় আসলে এটা বলা সম্ভব না। গবেষক নিজেই যেখানে বলেছেন যে এটা মূলত: যাদের টেস্ট পজিটিভ কিন্তু রোগ এর লক্ষণ প্রকাশিত হয় নাই তাদের বেলায় বেশি কাজ করে। তার মানে টেস্ট যে দেশে বেশী করা হবে সেখানে এটা বেশি কাজ করবে কারণ রোগের লক্ষ্মণ প্রকাশের আগেই এটা দিলে বেশি কাজ করে।

২০১৪ সালেও লাইবেরিয়াতে ইবোলায় আক্রান্ত এক নার্সের শরীরে এটা কাজ করেছিল বলে রিপোর্ট হয়েছিল। গিনিতেও এটা দেয়া হয়েছিল । কিন্তু সেসবই ইবোলা কেসে। কোভিড এর বেলায় এটার পরীক্ষা এখনো সন্তোষজনক না।

অ্যাভিগান কিভাবে কাজ করে?

এটা আরএনএ ভাইরাসের আরএনএ পলিমারেজ নামের এনজাইমকে বাধা দেয়। ফলে ভাইরাসটি দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। তখন আমাদের শরীর ভাইরাল লোড কম থাকায় সহজে এটাকে মারতে পারে। এর কর্মপদ্ধতি থেকেই কিন্তু বোঝা যাচ্ছে যে যার শরীরে অনেক ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করেছে ও নিউমোনিয়া করে ফেলেছে, তাদের বেলায় এটা বেশি কাজ করবে না।

তার মানে হলো যে দেশে প্রচুর টেস্ট হচ্ছে এবং আক্রান্তদের রোগের লক্ষ্মণ প্রকাশের আগেই সনাক্ত করা যাচ্ছে তাদের বেলায় এটা দেয়া সহজ। টেস্ট ছাড়া এমনি এমনি এটা খাওয়া যাবে না। এটা হাসপাতাল ছাড়া জাপানেও কাউকে দেয়া হয় না।

নতুনভাবে ফেজ থ্রি ট্রায়াল আবার শুরু করেছে জাপান। আমেরিকাও এটা করবে।

এবার বুঝে নেন ফেজ গুলি কি?

ফেজ ওয়ানে ঔষধের ডোজ, সেফটি ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সনাক্ত করা হয়।
ফেজ টু তে আরো গভীর ভাবে ঔষধ কাজ করে কিনা সেটা দেখা হয় ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা হয়।
ফেজ থ্রি তে দেখা হয় যেসব ঔষধ এরই মধ্যে আছে সেটার চেয়ে এটা ভালো কিনা বা সমান কিনা।
আর ফেজ ফোরে দেখা হয় আর কি রয়ে গেছে যা জানা হয় নাই।

যেসব ঔষধ ট্রায়ালে যায় ফেজ ওয়ানে তার মধ্যে মাত্র ১৪% ঔষধ সবগুলি ফেজ পার হয়ে বাজারে আসতে পারে। তার মানে বুঝেছেন তো, দুই চারটা রোগী আর দুয়েকদিনের বিষয় না। এটা বেশ সময়, শ্রম ও অর্থের বিষয়। ফেজ থ্রি থেকে প্রতি ৫ টা ঔষধের ২ টা বাদ পড়ে যায়।

অ্যাভিগানের বিষয়টা অন্য রকম। এটা একবার ফেজ থ্রি শেষ করেছে সাধারন ফ্লু তে এর কাজের পরীক্ষা দিয়ে। সাধারনত ১ থেকে ৪ বছর লাগে একটা ঔষধের ফেজ থ্রি ট্রায়াল শেষ করতে। ধরে নিলাম এটা এবার সবচেয়ে তাড়াতাড়ি হবে। তাহলেও এটার ফেজ থ্রি ট্রায়াল শেষ করতে ৬ মাস তো লাগবেই।

অথচ ২৯ টা গবেষণা পত্র নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে কোয়ারেন্টিন, টেস্ট, সামাজিক দূরত্ব ও সাবান এই ভাইরাসকে ঠেকাতে পারে। তারপরেও আমরা বসে থাকি ঔষধ খাবোই খাবো এমন একটা পণ করে।

সেই পৃথিবীর কথা কল্পনা করেন যেখানে কোন অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টি ভাইরাল ছিল না। মানুষ কিন্তু টিকে গেছে। কিভাবে?

তখন মানুষে মানুষে এত যোগাযোগ ছিল না। ২৪ ঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা যাওয়া যেতো না। আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াকে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার মানুষ চিনতো না। ফলে ওই মহাদেশ দুটি এমনিতেই কোয়ারেন্টিন ছিল। আমাদের সভ্যতা আমাদের এত কাছে এনেছে যে উহান থেকে নিউইয়র্ক যেতে আর ১৪ দিন লাগে না। আগে জাহাজে যেতে হতো। চিন্তা করেন জাহাজে গেলে ১৪ দিন হয়ে যেতো জাহাজের ভেতরেই। অসুখ বিসুখ হয়ে যারা মরার মরে যেতো। নিউইয়র্ক এ রোগ ঢুকতো না। উড়োজাহাজ সব বিগড়ে দিয়েছে।

প্রকৃতি আমাদের সংক্রমনের সময় যা করতে বলেছে সেটাই সবচেয়ে নিরাপদ। অ্যাভিগান নিয়ে হাহুতাশ না করে, মরিচিকার পেছনে না দৌড়ে প্রমাণিত কাজটি করুন। অ্যাভিগান আমাদের দেশে এমনিতেও ভালোভাবে ব্যবহার করা যাবে না, কারন আমাদের দেশে টেস্টের সুবিধা সীমিত। লক্ষণওয়ালাদেরই অনেকের টেষ্ট হয় না, আর রোগীর সংস্পর্শে আসাদের টেস্টতো বহু পরের বিষয়।

এবার কিছু ভালো খবর দেই।

চাইনিজরা টাকা ঢালছে টিকা বানাতে। জাপানীরা টাকা ঢালছে পলিক্লোনাল ইমিউনোগ্লোবিউলিন বা অ্যান্টিবডি সিরাম তৈরীর পেছনে। জাপানীরা অ্যভিগানকেও ট্রায়াল দিচ্ছে। জাপানীরা জিন থেরাপী করারও চেষ্টা করছে যার মাধ্যমে ভাইরাল স্ট্রেইনটিকে একটা ডিকয় রিসেপ্টর দিয়ে নিষ্ক্রিয় করা যায়। জিএসকে ও ইনোভ্যাক্সও টিকা তৈরির চেষ্টা করছে। তার মানে একটা কিছু হয়ে যাবে। ততো দিন আমাদের টিকে থাকতে হবে। টিকে থাকার উপায় হলো সংক্রমনটিকে দেরী করানো। যতো দেরি ততই ঔষধ/ টিকা পাবার সম্ভাবনা। তাই অ্যাভিগান বাদ দিয়ে জ্ঞান সঞ্চয় করেন। এটা ডাক্তারদের বুঝতে দেন।

যা কিছু দেখেন সেটাই শেয়ার না দিয়ে পড়াশোনা করেন। ভালো ছাত্র কে হয় জানেন?
যে ভালো শিক্ষকের কাছে যায়।

Fahmida Hoque Miti

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড -১৯ সেবাদানকারী স্বাস্থ্যকর্মীদের অধিকার ও দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা

Sun Apr 12 , 2020
১২ এপ্রিল, ২০২০ স্বাস্থ্য কর্মীরা করোনা ভাইরাস জনিত রোগে (COVID-19) সংক্রমণের সর্বাধিক ঝুঁকিতে রয়েছেন। ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, মানসিক অবসন্নতা, পেশাগত চাপ এবং শারীরিক ও মানসিক সহিংসতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই নির্দেশনাটিতে পেশাগত সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট করণীয়সমূূহ, স্বাস্থ্যকর্মীদের অধিকার এবং দায়িত্ব তুলে ধরা হয়েছে। […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo