আইসিইউ ডায়েরি – ৩

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৯ মে, ২০২০, শনিবার
ডা. মেহেদী হাসান

আইসিইউকে মৃত্যুপুরিও বলা যায়। করোনাকাল অথবা স্বাভাবিক সময় – এখানে মালেকুল মউতের অবাধ যাতায়াত। এই ছোট্ট ঘরটা বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয় অকাল মৃত্যু বলে কিছু নেই। মৃত্যু অবধারিত – এক নির্মম বাস্তবতা। আজরাইলের কাছে কোন ভিআইপি নেই, বয়স ১৮ বছরের নীচে হলেও কোন ছাড় নেই। তিনি ধনীকে কিছু সময় বেশি দেন না, আবার গরীবের জানটা নিয়ে নিতে তাড়াহুড়োও করেন না।

এখানে মুখোমুখি দাঁড়ায় জীবন এবং মৃত্যু। এখানে আবাল বৃদ্ধ বনিতা একই সমান্তরালে দাঁড়িয়ে একই সুরে নীরব হয়ে যায়। নিথর দেহগুলোর নতুন পরিচয় হয় লাশ। ইসিজির স্ট্রেট লাইনটা জীবন ও মৃত্যুর মাঝে সীমারেখা এঁকে দেয়। আমরা মৃত্যুসনদ লিখে দেই।

মৃত্যু দেখতে দেখতে আমাদের ভিতর এক ধরনের অভ্যস্ততা চলে আসে। অনুভূতিগুলোর ধার কমতে কমতে ফর্মালিটিতে পর্যবসিত হয়। ডেথ ডিক্লেয়ার করে আমরা স্বাভাবিকভাবেই খাই দাই, গল্প করি। মাঝে সাঝে আফসোসও করি। কী ভীষণ একটা ঘটনা ঘটে গেল! অথচ সংগত কারণেই আমরা ভাবনার গভীরে তলিয়ে যাই না, কেননা নতুন রোগী চলে আসে, মনিটরগুলো প্যা-পু করে জীবনের অস্তিত্ব জানিয়ে দেয় – মেমরি সেলগুলো মৃত লাশের স্মৃতি মুছে ফেলে জীবনের প্রয়োজনে।

এক সময় মৃত্যু আমাকে ভাবাতো না, এখন ভাবায়। এক সময় তাকাতাম শুধু – দেখতাম না, এখন দেখি। কথা বলতে বলতে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া দেখি, বরাদ্দকৃত শ্বাস শেষ হয়ে যাওয়ার হাহাকার দেখি, বিস্ফোরিত চোখ দেখি, যুদ্ধ করতে করতে পরাজয় মেনে নিয়ে স্থির হয়ে যাওয়া দৃষ্টি দেখি।
আহারে! উষ্ণ দেহ কিভাবে শীতল হয়ে যায়!

ডেথ ডিক্লেয়ারের সময় লাশের স্বজনদের দেখি। মায়ের বুকফাটা কান্না দেখি, সোনার মানিক হারানোর বেদনায় নীল হওয়া মায়ের মুখ দেখি, বাবার ভেঙে যাওয়া বুক দেখি, শোকে পাথর হওয়া দুমড়ানো হৃদয় দেখি।
আহারে! সন্তানের লাশ না জানি কত ভারি হবে!

তারপর দেখি সদ্য বিধবা হওয়া রমনীর চোখ। সেখানে বৃষ্টির সাথে থাকে গাঢ় কালো মেঘ। অনিশ্চয়তার মেঘ। বাচ্চাটাকে নিয়ে এই বৃষ্টির দিনে দাঁড়াবে কোথায়? স্মৃতিরাও বৃষ্টিতে ভিজে যায়। হৃদয়ের ব্যথা আর অনাগত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা যে চোখের দৃষ্টিতে সেই চোখে চোখ রেখে বলতে পারি না বৃষ্টির দিনে আর আপনার জন্য কোন ছাতা থাকবে না। অন্য কোন স্বজনকে ডেকে নিয়ে সত্যটা বলি।

জীবন এমনই। মৃত্যু আমাদের শিয়রে দাড়িয়ে থাকে, ঘুম ভাঙলেই দেখা হয়ে যাবে আর শুরু হয়ে যাবে নেভার এন্ডিং এক জীবন। তাই ফিরে যাবার আগেই ফিরে আসা দরকার ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। রমাদান মাস – ফিরে আসার মাস। দুই বছর আগে এমনই এক রামাদানে আল্লাহ হঠাৎ করেই, কোন কারণ ছাড়াই, আল্লাহ পাক এ পাপী বান্দার হৃদয়ে দ্বীনের মোহাব্বত ঢেলে দিয়েছিলেন। সেই থেকে চেষ্টা করছি ভাল মানুষ হয়ে যাবার।

আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হওয়া যাবে না। পাহাড় সমান গুনাহ নিয়ে রবের দরবারে কড়া নাড়লে, আমাদের রব সাগর সমান ক্ষমা নিয়ে সাড়া দিবেন আমাদের ডাকে। এই রাতগুলো রবের দরবারে আকুতি জানানোর রাত, গুনাহ মাফ করিয়ে ক্লিন শ্লেট হওয়ার রাত।

গুনাহ করা ইবলিশের খাসলত আর গুনাহ না করা ফেরেশতাদের সিফাত। আমরা উভয়টার কম্বিনেশন।
কখনো ফেরেশতার সিফাত আপারহ্যান্ড নেয়, কখনো ইবলিশি খাসলত প্রকাশ পায়।

যাই হোক, গুনাহ করার পর আমরা সাধারণত আদম আঃ অথবা ইবলিশের তরিকা গ্রহণ করি। ইবলিশ দায় চাপাল আল্লাহর উপর। বলল, “ইয়া রব! আপনিই যেহেতু আমাকে গোমরাহ করেছেন।” (হিজর-৪০)
অনেকেই পাপ করতে থাকি আর বলি আল্লাহ হেদায়েত দিচ্ছেন না, আমার কি দোষ? এটা আসলে ইবলিশের তরিকা। আল্লাহ দোষারোপ করা অনেক বড় আস্পর্ধার কাজ। অহংকার একমাত্র আল্লাহর সিফাত, বান্দার নয়। দাসের সিফাত আনুগত্য।

আবার কেউ কেউ আদম আঃ এর তরিকা গ্রহণ করি। পাপ করে ফেললে কাচুমাচু হয়ে বলি, “রব্বানা জলামনা আংফুসিনা।”

অনুতপ্ত বান্দার চোখের জল আল্লাহর কাছে বড় প্রিয়। আল্লাহ আমাদেরকে আদম আঃ এর মত কাচুমাচু হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার তৌফিক দিন।

নসিহত নিজের জন্য। চলুক তাহলে।

ডিউটিতে আছি।

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

চিকিৎসা সেবা বনাম রোগীর মনোভাব

Sat May 9 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৯ মে ২০২০, শনিবার হেলথ বিডির এডমিন খন্দকার মুহাম্মাদ হালিম কাজ করেন স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে, এই দুর্যোগে চিকিৎসা সেবা নিয়ে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে করা হয়েছে প্রতিবেদনটি। ঘটনা প্রবাহ- ০১ হঠাৎ ছোট ভাইয়ের এপেনডিক্স এর মারাত্মক ব্যথা শুরু হলে তাকে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো সার্জারী ওয়ার্ডে। […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo