তারিখ: ৭ই এপ্রিল, ২০২০
সন্দেহ নেই, অপ্রতুল টেস্ট ই বাংলাদেশের এই রক্ত হিম করা তথ্যের জন্য দায়ী।
উপরের গ্রাফগুলো লক্ষ্য করুন।
প্রতিটি গ্রাফই সেই দেশের ১ম সংক্রমণ রিপোর্টেড হওয়ার সময় থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত সংক্রমণ হারের একটি চিত্র তুলে ধরছে।
প্রতিটি গ্রাফের প্যাটার্ন বা নকশা একই রকম- ১ম সংক্রমণ রিপোর্টেড হওয়ার পর ৪র্থ ও ৫ম সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়ে গ্রাফগুলোর কার্ভ বা রেখাটি ঠিক খাড়া হয়ে উপরে উঠে গেছে প্রায় ৯০° এঙ্গেল বা সমকোণে যার মানে দাঁড়ায়- ইতিমধ্যেই এই প্যান্ডেমিক টি নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে ছড়িয়ে পড়া শুরু করেছে।
তবে বাংলাদেশের গ্রাফটি লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে রেখাটি এখন পর্যন্ত সমতলেই রয়েছে যার অর্থ সংক্রমণ হার বাড়েনি।
কিন্তু দুটি কারণে এই উপাত্তটি আমাদের স্বস্তি দিতে পারছেনা।
১. মাত্র গতকাল আমরা তৃতীয় সপ্তাহ অতিক্রম করে সংকটপূর্ণ চতুর্থ সপ্তাহে পা দিয়েছি। এরইমধ্যে বিশ্বের অন্যন্য দেশগুলো যে ইঙ্গিত দিচ্ছে তাতে এখন থেকে নিয়ে আগামী ১৪ দিনের মাঝের সময়টুকুতে গ্রাফের রেখাটির সমকোণে বা ৯০° এঙ্গেল এ খাড়া হয়ে উপরে উঠে যাবার কথা। সংক্রমণ সমস্যা মোকাবিলায় মূল চ্যালেঞ্জ তখনই আসবে আমাদের সামনে।
২. এতদিন পর্যন্ত যে কয়টি টেস্ট করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য এবং তাই বাংলাদেশের সত্যিকার অবস্থা আমরা সত্যিই জানি না।
আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা গতকাল আরও একবার দাবি করেন বাংলাদেশ ডব্লিউএইচও গাইডলাইন অনুসরণ করছে এবং দেশে পর্যাপ্ত টেস্ট করা হচ্ছে।
তবে সংখ্যাগুলোর চিত্র কিন্তু ভিন্ন গল্প দেখাচ্ছে।
গত দুই মাসে ৮ লাখের ও বেশি মানুষ টেস্ট করার জন্য কোভিড-১৯ হটলাইন গুলোতে কল করেছে। শুধুমাত্র আইইডিসিআর এর হটলাইন গুলো ৭০ হাজারের বেশি কল রিসিভ করেছে। এর মধ্যে মাত্র ১১০০ টি টেস্ট করা হয় এবং এতে ৪৮ টি কেইস এর ফলাফল পজিটিভ আসে।
এর অর্থ, বাংলাদেশ সর্বনিম্ন টেস্ট সম্পাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে একটি যেখানে ডব্লিউএইচও বারংবার প্রতিটি দেশকে তাগাদা দিয়ে আসছে এবং যত মানুষ সম্ভব সবার টেস্ট করার নির্দেশ দিয়েছে যাতে সংক্রমণের প্রকৃতি এবং অঞ্চল অনুযায়ী সংক্রমণের ঘনত্বের সঠিক চিত্রটি পাওয়া যায়।
অপ্রতুল টেস্টিং শুধু যে সংক্রমণ সংক্রান্ত তথ্য উপাত্তে গোলযোগ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে তাই নয়, এটি আরও অন্যন্য তথ্যে অনিচ্ছাকৃত প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশের বর্তমান কোভিড-১৯ এ মৃত্যুহার বলছে করোনা ভাইরাসে বিধ্বস্ত ইতালি থেকেও এ মৃত্যুহার বেশি। ইতালিতে মৃত্যুহার যেখানে ১০.২, আমাদের সেটি ১০.৪।
সন্দেহের অবকাশ নেই, অপ্রতুল টেস্ট ই বাংলাদেশের এই হিমকর তথ্যের জন্য দায়ী।
এরইমাঝে মীরজাদী বলেছেন, মৃত্যুহার হিসেব করার সময় এখনো আসেনি।
জিরো কেইস সিমিলারিটি:
১ম সংক্রমণ টি রিপোর্ট করার পর বাংলাদেশে এর পরের ৫টি দিনে কোনো নতুন সংক্রমণ রিপোর্ট করা হয়নি।
তারপর ১৪ই মার্চ, ২টি কেইস রিপোর্টেড হয়। তার পরের দিন কোনো কেইস রিপোর্টেড হয়নি।
১৬ই মার্চ থেকে ২৪শে মার্চ এর মাঝে নতুন রোগী সনাক্ত করা হয়েছে কিন্তু তার পরের দিন ২৫শে মার্চ এ কোনো কেইস পাওয়া যায়নি।
এবং গতকাল আবারও কোনো কেইস রিপোর্টেড হয়নি। উপরের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২৩ ও ২৪শে মার্চ এই দুই দিনে সর্বোচ্চ ৬ টি কেইস সনাক্ত করা হয়।
এরকম শূন্য কেইস রিপোর্টিং কোনোভাবেই স্বস্তিদায়ক নয় যেহেতু সর্বোচ্চ আক্রান্ত ইতালি, আমেরিকা এবং অন্যন্য দেশ যেমন স্পেন, ফ্রান্স, সাউথ কোরিয়া এবং জার্মানিতেও ১ম ৩-৪ সপ্তাহ সহ বেশ অনেকদিন শূন্য কেইস রিপোর্ট হয়েছিলো।
ইতালি, ইউরোপের যে দেশে বর্তমানে সর্বোচ্চ সংখ্যক সংক্রমণ ও মৃত্যু হচ্ছে, সেখানে ১ম সংক্রমণ কেইস রিপোর্টের পর ক্রমাগত ৬ দিন শূন্য কেইস রিপোর্টেড হয়েছে।
৮ম দিনে ইতালিতে ১টি নতুন কেইস রিপোর্ট করা হয় এবং আবারও তার পরের ২ সপ্তাহে কোনো কেইস তারা পাননি।
কিন্তু তার পরপরই সংখ্যাগুলো হতবুদ্ধি হয়ে যাবার মতো তীব্র গতিতে উপরে উঠা শুরু করেছিলো।
আজ ইতালি ৮৬ হাজারের ও অধিক কেইস এবং ৯ হাজারের অধিক মৃত্যু নিয়ে লড়ছে। এমনকি গতকাল ইতালিতে ৯০০ জন মানুষ মারা যান।
বাংলাদেশের মতো ইতালিও অপ্রতুল টেস্ট সম্পাদনকারী দেশ ছিলো তারা তাদের ঝুঁকিপূর্ন অঞ্চলগুলো ও সময়মত সনাক্ত করতে পারেনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (রোগতত্ব নিয়ন্ত্রণ বিভাগ) সাবেক পরিচালক প্রফেসর বেনজির আহমেদ বলেন, “গত ২৪ ঘন্টায় কেউই সংক্রমিত হননি, তা আমরা বলতে পারিনা, বরং আমাদের বলা উচিত আমরা নতুন রোগী সনাক্ত করতে পারিনি।এর কারণ স্বল্প সংখ্যক পরীক্ষা সম্পাদন।”
তিনি বলেন, “মহামারী সংক্রান্ত তথ্য উপাত্তের আলোকে, প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ টি করে সংক্রমণ কেইস সনাক্ত হবার কথা ছিলো যদি সারাদেশে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পরীক্ষা সম্পাদন করা হত।”
তিনি আরও বলেন, “এর মানে আমরা সঠিক সংখ্যক সংক্রমণ কেইস সনাক্ত করবার সুযোগ হারাচ্ছি এবং সেই সাথে ভাইরাসের ব্যাপকহারে ছড়ানোর আশঙ্কাও বাড়াচ্ছি।”
টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট:
অন্যন্য দেশের উদাহরণ অনুযায়ী, ভাইরাসটির গতি সীমাবদ্ধ করায় সফলতা ও ব্যর্থতা প্রায় পুরোপুরিই নির্ভর করে টেস্ট পরিচালনার সক্ষমতার উপর।
ভাইরাস ছড়ানো ঠেকাতে করোনার সংক্রমণ শুরু হবার সাথে সাথেই ব্যাপক আকারে করোনা পরীক্ষা করে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সাউথ কোরিয়া। সেখানে ৩ লাখ এর বেশি পরীক্ষা করা হয় এবং প্রতি ১০০০ জনে ৬ জনের বেশি মানুষেমানুষের পরীক্ষা করা হয়।
ইতালি, স্পেন এবং ইরান প্রয়োজন অনুযায়ী পরীক্ষা সম্পাদনে ব্যর্থ হওয়ায় এর খেসারত দিচ্ছে ভয়ঙ্করভাবে।
নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে ভাইরাসটি ছড়িয়ে যাওয়ায়, ইউরোপীয়ান দেশগুলো এখন পরীক্ষা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং এতে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে কেইস সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
ইতোমধ্যে, বাংলাদেশে যতগুলো পরীক্ষা করা হচ্ছে তা নিতান্তই নগন্য, ১০ লাখে মাত্র ৬ জনের একটু বেশি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইসচ্যান্সেলর, ভাইরোলজিস্ট প্রফেসর নজরুল ইসলাম ও স্বল্প সংখ্যক টেস্ট করা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এবং সতর্ক করেছেন এই বলে যে যদি পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি না করা হয় তবে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা হেরে যেতে পারি।
তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত ১০০০ টির বেশি পরীক্ষা করা হয় যা খুবই স্বল্প সংখ্যক। বৃহৎ পরিসরে পরীক্ষা করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা না হলে এটি ভয়ানক একটি বিপর্যয়ে পরিনত হতে পারে।
যাঁরা বিভিন্ন দেশের করোনা সংক্রান্ত তথ্য উপাত্তের তুলনা ও বিশ্লেষণ করছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, বিভিন্ন দেশের রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড, পরীক্ষার রীতি, কেইস-ট্রেসিং পদ্ধতি ভিন্ন যার প্রতিটিই তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।
ব্যতিক্রম সাউথ কোরিয়া :
ব্যতিক্রম শুধুমাত্র সাউথ কোরিয়া। ১ম সপ্তাহে প্রতিদিন এখানে একক সংখ্যক কেইস সনাক্ত হয়েছে। পরবর্তী ৩ সপ্তাহ ধরে দুই-সংখ্যার কেইস রিপোর্ট হয়েছে। কিন্তু ৫ম সপ্তাহে এ চিত্র পাল্টে যায়। সংক্রমিতের সংখ্যা এক লাফে শত থেকে হাজারে চলে যায়।
এই ব্যপক সনাক্তকরণ সম্ভব হয়েছে বৃহৎ পরিসরে টেস্ট পরিচালনা করার কারণে। প্রতিদিন প্রায় ২০,০০০ মানুষের পরীক্ষা করা হচ্ছে, মাথাপিছু পরীক্ষা সংখ্যায় বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশকে ছাড়িয়ে গেছে সাউথ কোরিয়া।
সাউথ কোরিয়ায় ৯৬ টি সরকারি বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে করোনাভাইরাস এর টেস্ট করা হয় যেখানে টেস্ট কিটের কোনো স্বল্পতা ছিলো না এবং সেই সাথে ৪ টি কোম্পানিকে টেস্টিং কিট উৎপাদনের অনুমতি দেয়া হয়, যার অর্থ প্রতি সপ্তাহে সাউথ কোরিয়ার ১৪০,০০০ টি নমুনা পরীক্ষা করার সামর্থ্য রয়েছে।
সাউথ কোরিয়ার এই সক্ষমতাই দেশটিকে অন্যন্য দেশের করোনা ভাইরাস এর ব্যাপকতার বিরুদ্ধে লড়াই করবার ক্ষেত্রে রোল মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
মার্চ এর মাঝামাঝি সময়ে সাউথ কোরিয়ায় মৃত্যুহার ছিলো ০.৭ শতাংশ। ডব্লিউএইচও বিশ্বব্যাপি এই মৃত্যুহার ৩.৪ শতাংশ হিসেবে রিপোর্ট করেছে। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, কোরিয়ার মৃত্যুহার আরও কম কারণ এত কিছুর পরও সব কেইস রিপোর্ট হচ্ছে না।
তা সত্বেও, সাউথ কোরিয়ার স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের বিশ্বাস, ব্যাপক পরিসরে টেস্টিং ই প্রধানত তাদের জীবন বাঁচাচ্ছে।
সূত্র: ইনাম আহমেদ ও সাখাওয়াত লিটন
স্টাফ রিপোর্টার: সায়েদা নাফিসা ইসলাম