প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -৩৯
” আজ বৃহস্পতিবার রাত ”
লেখকঃ
আজম ইকবাল খান
টি এম এস এস মেডিকেল কলেজ ,বগুড়া ।
প্রিয়তমা,
বৃহস্পতিবার এর রাত আসলে সারা সপ্তাহের ক্লান্তি ভর করে দেহে। দেহ যেন এক প্রকার নিশ্চল হয়ে যায়। প্রতিদিনের মত সকালে ঘুম থেকে উঠে কর্মময় ব্যস্তজীবনের কাজে লেগে পড়ার চিন্তা থাকে না। এক শ্রান্তিময় প্রশান্তি বিরাজ করে দেহের প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রে।
অন্যান্য দিনের মত চিন্তায় থাকে না,পরবর্তী দিনের শুরুতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কতগুলো অসুস্থ মানুষের মুখ দেখতে হবে। কেউবা মৃত্যু পথযাত্রী,তাদের কেউ জীবনী শক্তির শেষটুকু দিয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে থাকে, পৃথিবী আর কয়েকটি দিন নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য। তাদের নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও হাসিমুখে সান্তনা দিতে হয় পরিবার পরিজনদের। তুমি বুঝবে না, নিজের সাথে কতটুকু যুদ্ধ করে এই মৃত্যু পথযাত্রীদের পরিবার পরিজনকে শান্তনা দিতে হয়।
আর কিছু মানুষ থাকে, যারা আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ। কিন্তু তাদের অভ্যন্তরীণ তন্ত্রগুলো আর স্বাভাবিক থাকে না। জন্মের সময় যতটা স্বাভাবিকত্ব নিয়ে প্রতিটা অঙ্গ জন্ম নেয়, একটা নির্দিষ্ট সময় তাদের সেই স্বাভাবিকত্ব আর থাকে না। মানুষ চোখে দেখে একজন স্বাভাবিক মানুষ, অথচ তার দেহ বয়ে বেড়ায় কিছু অস্বাভাবিক কোষ, কলা আর অঙ্গতন্ত্র। তাদের সুস্থ দেহের মধ্যকার অসুস্থতা কে প্রকাশ করতে যেতে নিজের সাথেও কিছুটা যুদ্ধ করতে হয়।
একটা স্বাভাবিক মানুষ।হয়ত সামান্য একটু দুর্বলতা কিংবা অসুস্থতা নিয়ে আসে আমাদের কাছে। সামান্য পরীক্ষা নিরীক্ষার পর হয়ত দেখা যায় মানুষটি ডায়াবেটিকস রোগে আক্রান্ত। তারপর চোখের সামনে দেখতে হয়, জীবন যাত্রার আকষ্মিক পরিবর্তন। শুরু হয় জীবনের এক নতুন সংগ্রাম। বহুদিনের লালিত খাদ্যাভ্যাস, প্রাত্যহিক নিয়মমাফিক জীবন যাত্রা সব পরিবর্তন হয়, অনেকটা একপ্রকার বাধ্য হয়েই। শুধুমাত্র আমাদের একটা কথায়। এভাবে কতগুলো মানুষ যে আমাদের কাছে এসে কত অনাকাংখিত রোগের খবর বয়ে নিয়ে যায় নিজ বাড়িতে, বুঝবে না তুমি। সামান্য অসুস্থতার অভিযোগ এনে ক্যান্সার, হার্ট ফেইলিওর, স্ট্রোক নিংবা অন্যান্য অর্গান ফেইলিওর এর মত বড় বড় রোগের সংবাদ নিয়ে কত মানুষকে বাড়ি ফিরতে হয়।
কখনও বা চোখের সামনে দেখতে হয় কতগুলো মানুষকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে। চোখের সামনেই দেখি আপন জনদের হৃদয় বিদারক চিৎকার। নিজের চোখেই জল চলে আসে অনেক সময়, আবার অনেক সময় পাষানের মত জলহীন চোখে দেখতে হয় এক হৃদয়বিদারক চিরবিদায়ের খেলা। তারপর, এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসতে হয় পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া ব্যক্তির মৃত্যু সনদ লিখতে। এভাবে নিজের জীবন্ত হাতে, প্রতিনিয়ত লিখতে হয় শত শত দুনিয়াত্যাগী মানুষের মৃত্যুসনদ।
মাঝে মাঝে কিছু রোগী আসে। চুড়ান্ত পর্যায়ের পানিশূন্যতা নিয়ে।হাতের শিরা উপশিরা গুলো অনেকটা লুকোচুরি খেলে দেহের সাথে।তবুও অনেকটা আন্দাজ করে রোগীর দেহে বার বার সুই ফোটাতে থাকি, শিরার সন্ধানে।তার দেহে তখন পানি আর লবনের অনেক প্রয়োজন তার দেহে।দেহে সুই ফুটিয়ে স্যালাইন না দিতে পারলে হয়ত রোগীটিকে মৃত্যু সনদ দেওয়ার মত অবস্থায় চলে যেতে পারে। ভাবছ কতটা অমানবিক আমরা। আসলে নিজের সাথে যুদ্ধ করেই চিকিৎসক দের এমন অমানবিক হতে হয়, শুধু রোগীদের জীবন রক্ষার্থে।
এভাবে কেটে যায় সপ্তাহের প্রতিটা দিন। কর্মব্যস্ততার সাথে অগনিত মানুষের কষ্টের গল্প জড়িয়ে থাকে আমাদের নিত্যদিনের প্রতিটা মুহূর্তের সাথে। চোখের সামনের মুমূর্ষু মানুষগুলো প্রতিনিয়ত ভাবায়, কখন কে দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়। একটা অসুস্থ মানুষ আর কতটুকু সেবা পেলে সুস্থতার দেখা পাবে, এই ভাবনা নিত্যদিনের অবসর সময়গুলোও চিন্তিত আর ক্লান্তিময় করে রাখে।
প্রিয়তমা, আজ সেই কাংখিত বৃহস্পতিবার রাত। শুক্রবার দিনটা আমার জন্য ছুটি এ সপ্তাহে। অন্য কোন সপ্তাহে হয়তবা এই ছুটির দিনেও থাকতে হবে অসুস্থ মানুষগুলোর সাথে। তবে কাল দিনটা ছুটি। জানি তোমার অভিমান অনেক। হাজার ব্যস্ততা, তোমার কোন খোজই নেওয়া হয় না। দিনে দিনে অনেক অভিমান জমা হচ্ছে তোমার হৃদয়ে।আমি জানি, প্রতিদিনের ক্ষনিক অবসরের কল্পনা গুলো তোমার অভিমানের খবর বয়ে আনে আমার হৃদয়ে। আমি ভাবি মাঝে মাঝে, ছুটে যাব তোমার দুই হাতের বন্ধনে। কিন্তু কতগুলো অসুস্থ আর মৃত্যু পথযাত্রীদের সেবার আহবানে প্রতিটা মুহুর্তে বাধ্য হয়েই নিজেকে দূরে রাখতে হচ্ছে তোমার থেকে।
ভাবছি, সামনের কোন একদিন নিজেকে একটু কর্মব্যস্ততা থেকে বের করে তোমার হাতে সপে দিব ক্ষনিকের তরে। আমার ওয়ার্ডে কিছু অসুস্থ মানুষ আছে।দেখি সামনের সপ্তাহে একটু সুস্থতার সাথে তাদের বাড়ি পাঠানো যায় কিনা। কিছু মানুষ ভর্তি আছে, মুমূর্ষু অবস্থায় মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে চলেছে। হয়তবা আমার হাতের মৃত্যু সনদের অপেক্ষায়। দেখি এই মানুষগুলোর একটা চুড়ান্ত ফায়সালা হলে কিছুটা সময় বের করব তোমার জন্য।
অন্তত আজকের রাতটা আমাকে ছুটি দেও। নিজের শরীরটাই প্রতি মুহূর্তে একটু বিশ্রাম চায়।আমার নিজের সাথে, দেহটারও শ্রম কম হয়না। নিজেকে একটু মুক্তি দিই, অন্তত একটা দিনের জন্য। না হলে, কবে না জানি আবার আমার সাথেই বিদ্রোহ করে বসে। আজ বৃহস্পতিবার রাত, কাল দিনটা ছুটি। শুধু নিজের জন্যই আজকের রাতটা তোমার কাছ থেকে চেয়ে নিলাম।
ভাল থেক।
ইতি,
মানব সেবায় নিয়োজিত তোমার চিকিৎসক প্রিয়তম