আপনার সন্তান খেতে চায় না , কি করণীয় ?

 

যে কোন শিশু চিকিৎসককে আপনি যদি প্রশ্ন করেন পেশাগত জীবনে শিশুর মায়েদের কোন সমস্যার সমাধান দিতে হয় সবচেয়ে বেশি? দেশ, জাতি, সীমানা পেরিয়ে যেখানেই গেছি, একটা প্রশ্ন আর উদ্বেগ দেখেছি ঘুরে ফিরে মায়েদের চোখে আর মুখে, ‘আমার বাচ্চা কিছুই খায় না’! বয়স, পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক অবস্থান ভেদে ভাষার প্রয়োগ ভিন্ন হতে পারে, তবে মূল বক্তব্য কিন্তু এক ও অভিন্ন l আসলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, বাচ্চা কিছু খায় না বলতে তারা বোঝাতে চান, আমি যে ভাবে চাই সেভাবে খায় না l

অনেক শিশুই আজকাল, চকোলেট, চিপস, আইসক্রিম সহ নানা হালকা খাবারে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে l এগুলো যে শিশুর মূল খাবারের অভ্যাস তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে – ব্যাপারটা মাকে অনেক সময় বোঝানো কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়ে l

শিশুকে সুষম পারিবারিক খাদ্যে অভ্যস্ত করতে হলে মা বাবা সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে একটু চিন্তাশীল হতে হয়, ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয় l শিশুর সাথে অতি আবেগ না দেখিয়ে, যৌক্তিক হতে হবে, ক্ষেত্র বিশেষে কিছুটা কঠোরও হতে হবে l

আসুন এ সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা যাক :

এক l শিশুর খাবার পরিবারের সবার খাবারের সাথে যথা সম্ভব মিল রাখা ভালো, শিশু যেন নিজেকে অন্যরকম বা ব্যতিক্রম ভাবার সুযোগ না পায় l শিশু কতটুকু খাবে সেটা প্রধানত তার নিজের ব্যপার, এতে আপনার করণীয় সামান্যই l সবার সাথে ওকে খাওয়াতে বসান, নিজ হাতে খেতে দিন l গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র আঠারো মাস বয়সেই শিশুকে পারিবারিক আবহে খাদ্যের অভ্যাস গড়ে তোলা সম্ভব l প্রথম প্রথম গালে, শরীরে, কাপড় চোপড়ে লাগিয়ে নানা চেহারায় অবতীর্ণ হবে বটে, তবে এভাবেই খেলতে খেলতে খাওয়া শিখবে l

দুই l শিশু একই ধরনের খাবারে এক ঘেয়ে হয়ে ওঠে l তাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্বাদের, রঙের খাবার দিন, খাবারে বৈচিত্র মানে জীবনেও বৈচিত্র!

তিন l শিশুর সামনে কথা বার্তায় সতর্ক হোন, বিশেষ করে যাকে সে বেশি পছন্দ করে l খাবার টেবিলে বসেই বলে দিলেন, আজ কি শুধুই সব্জি, মাছ/মাংস নেই? এসব দিয়ে খাওয়া যায় নাকি! এ ধরনের কথায় শিশু ভীষণ ভাবে প্রভাবিত হয় l পরদিন হয়তো কিছু না বুঝেই একই কথা বলতে শুরু করবে! শিশুর জন্যই কেবল সংযত আচরণ করতে হবে শুধু তাই নয়, প্রকৃতপক্ষে সুষম খাবার পরিবারের সবার জন্যই প্রয়োজন এবং সবাইকে তা উপলব্ধি করতে হবে l ছোটরা তো শিখবে বড়দের থেকেই l

চার l খাবারের সময় টেলিভিশন, কম্পিউটার, ফোনে কথা বলা, মেসেজ পাঠানো বন্ধ রাখুন l খাবারের টেবিলে গম্ভীর পরিবেশ পরিহার করে শিশুর সাথে আনন্দময় পরিবেশ গড়ে তুলুন l সবার অংশগ্রহণে গল্প জমিয়ে তুলুন, একে অন্যের নানা বিষয়ে জানতে চাইতে পারেন l স্কুল, বন্ধু, দিনের কোন ঘটনা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা চলতে পারে l খাওয়া তার আপন নিয়মেই চলবে l

পাঁচ l শিশুর পছন্দমত হালকা খাবারের আইটেম যেমন, মজার সালাদ, ফল সমৃদ্ধ কাস্টার্ড, দই ইত্যাদি তৈরী করে ওদের নাগালের মধ্যে রাখুন l মাঝে মধ্যেই ওদেরকে নিজ থেকে খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করুন l

ছয় l কাঁচা বাজারে শিশুকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন l তার খাবারটি তাকেই পছন্দ করতে বলতে পারেন l এতে সে উৎসাহিত বোধ করবে পছন্দে ক্রয় করা খাবারটি খাওয়ার একটা দায়িত্বও তৈরী হতে পারে l

সাত l শিশুর বয়স যখন ছয় মাস : এ সময় শিশুকে বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার দেয়া শুরু করতে হয় l প্রথমে একেবারে তরল করেই খাবার তৈরী করুন, ধীরে ধীরে গাঢ় করুন এবং শক্ত খাবারের দিকে অগ্রসর হোন l মায়ের দুধের তুলনায় বাড়তি খাবারের স্বাদ একেবারেই ভিন্ন, তাই এতে তার অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে, প্রথম দিন থেকেই সে খাবে না l এ সময় আপনার উদ্দেশ্য থাকবে ওকে খাবার শিখানো, পেট ভরানো নয় l প্রথমেই রকমারি খাবার না দিয়ে সহজ সাধারন খাবার যেমন নরম ভাত দিতে পারেন l তিন চার দিন পর পর নতুন উপাদান যোগ করুন l চাল ডাল তেল আলু সব্জি মাছ ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে সব খাবারই দিবেন l কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এক পর্যায়ে মাংস যোগ হবে l তবে গরুর দুধ এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে নয় l নতুন কোন খাবার যোগ করার পর শরীরে এলার্জির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা লক্ষ্য রাখুন l তেমন কিছু দেখা গেলে ওই খাবারটি পরিহার করুন l

প্রথম প্রথম শক্ত খাবার শুরুর পর শিশুর পায়খানা কিছুটা নরম কিংবা বিভিন্ন রঙের হতে পারে যা স্বাভাবিক, এতে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই l
আপনার সকল উত্তেজনা, পরিকল্পনা, স্বপ্ন ভুল প্রমাণ করে শিশু খাবারের প্রতি একদম অনীহা দেখাতে পারে l অবাক অথবা হতাশ হবেন না, যেকোন স্বাভাবিক শিশুর ক্ষেত্রেই এমনটি হতে পারে l ধৈর্য হারানোর কোন সুযোগ নেই, চেষ্টা চালিয়ে যান, আপনি সফল হবেন, হতেই হবে l

মনে রাখবেন, খাবার টা খেতে হবে আনন্দের সাথে, জোর জবরদস্তি করে লাভ হয় না, বরং বুমেরাং হয়ে শিশু খাবারের প্রতি চরম বিমুখ হয়ে উঠতে পারে l

দ্রষ্টব্য: শিশুর খাওয়া নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তা থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন, শারীরিক কোন সমস্যা আছে কিনা যাচাই করে নিন l যদি কোন অসুস্থতা থাকে তার যথাযথ ব্যবস্থাপনা করতে হবে সবার আগে l আর যদি শিশু অন্য সব দিক দিয়ে সুস্থ থাকে তবেই আমার আলোচনা গুলো কাজে আসতে পারে l

পরিশেষে : এত অল্প পরিসরে বিষয়টি গুছিয়ে লেখা অন্ততঃ আমার পক্ষে সহজ নয়, চেষ্টা করলাম অধিক গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রসংগে আলোচনা করতে l

লেখকঃ  অর্জুন সি দে  (Arjun C Dey)

এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর নিওনেটলজি
বিএসএমএমইউ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

সিউডো সাইকিয়াট্রি : বিস্তারিত জানুন

Fri Aug 31 , 2018
 মনোরোগ পরিমিতি একনাগাড়ে অনেকক্ষন কথা বলে তিনি থামলেন , আমার দিকে তাকিয়ে পানি চাইলেন ৷ পানি দেয়া হল ৷ তার দীর্ঘক্ষণের দেয়া আবেগঘন এই ইতিহাসের মধ্যে মূলত কিছুই নেই, আছে শুধু তার মাদ্রাসায় পড়ার কারণে অন্যভাইবোনদের চেয়ে সে যে ভিন্নভাবে বড় হয়েছে এটা পরিবারের সদস্যরা মানতে চায় না ৷ দ্বন্দ্বটা […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo