আবারো চিকিৎসক প্রহৃত : বিচার তবে চাইবে কার কাছে?

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ০৯ মে ২০২০, শনিবার

০৮ মে, শুক্রবারে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ইমার্জেন্সীতে দায়িত্বরত ছিলেন মেডিকেল অফিসার ডা. তৈয়েবুর রহমান গালিব৷ দায়িত্বরত অবস্থায় একজন গরীব রোগীর ঔষুধ লিখে দেন যা হাসপাতালে মজুদ না থাকায় সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের সামনে একটি ফার্মেসী থেকে নিতে যায় রোগী৷ কিন্তু ফার্মেসীর দোকানী নিম্নমানের ভিন্ন কোম্পানীর ঔষুধ দেয় যা দেখে পরবর্তীতে ডা. তৈয়েবুর রহমান রোগীকে সাথে নিয়ে ফার্মেসীতে গেলে, ফার্মেসীর মালিক ডাক্তারকে শারীরিকভাবে হেনস্থা করে৷ নিজেকে স্থানীয় প্রভাবশালী বলে উল্লেখ করেন।

ডাঃ তৈয়েবুর রহমান গালিবের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি নিম্নে সরাসরি দেওয়া হল,
“ইমার্জেন্সিতে ছিলাম। ছয় মাস বাড়ি যাই না। সেই যে সরকারি চাকরি পেলাম, আর ছুটি নেই। করোনার সময় থেকে একদিন জীবনের নিরাপত্তা পেলাম না। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আমার পোস্টিং। আজ টানা আঠারো ঘন্টা ডিউটি ছিল। বিকাল তিনটা থেকে পরদিন সকাল নয়টা। এক রোগি এসে বললো, স্যার একটা ঔষধ একটা লিখছে, দোকানি আরেকটা দিছে। নার্সরা চেঞ্জ করে আনতে বলছে। চেঞ্জ করতে গেলে দোকানি বললো, বিক্রিত জিনিস ফেরত হয় না।

আমি বললাম, আবার যান, বলেন ইমার্জেন্সী ডাক্তার বলছেন।

গরীব রোগী আবার গিয়েও ঔষধ চেঞ্জ বা টাকা ফেরত পেল না। আমি মানুষটার দিকে তাকালাম। নিতান্ত গরীব মানুষ। কত কষ্ট করে কিছু টাকা জোগাড় করে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাচ্ছে।

আমি বললাম, এটা ত ঠিক না। চলেন ত দেখি। হাসপাতালের উল্টোদিকে দোকান। ইমার্জেন্সীতে একজনকে বসিয়ে অই দোকানে গেলাম। দোকানে একজন লম্বা মানুষ। পাশে আরেকজন। জিজ্ঞেস করলাম, ঔষধটা সম্ভব হলে চেঞ্জ করে দেন। দোকানের মালিক বললেন, বিক্রিত জিনিস আমরা ফেরত নেই না। আমি বললাম, দেখেন গরীব মানুষ। আর যে ঔষুধ লিখেছে, অইটা ত দেন নাই।

দোকানি ক্ষেপে গেলেন, আপনি কে?
-আমি ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার।
উনি তাচ্ছিল্য করে বললেন, ও কমিশন খেতে আসছেন?
আমি বললাম, দেখেন টাকাটা ফেরত দেন ঔষুধ না থাকলে।
দোকানি চিৎকার করে উঠলেন, বাড়ি কই আপনার?
আমি বললাম, ফরিদপুর।
– ফরিদপুর থেকে এসে সাতক্ষীরায় রংবাজি করেন!

বলেই আমাকে বুকে একটা ধাক্কা দিলেন।
এরপর বললেন, আমাকে চিনেন? যান যান। ক্যাশে টাকা নাই।
আমি বললাম, এত বড় দোকানে ক্যাশে টাকা নেই? দ্বিতীয়বার ধাক্কা দেয়ায় আমার একটা শার্টের বোতাম ছিড়ে গেলো। আমি আর কথা না বাড়িয়ে বৃদ্ধকে বললাম চলেন যাই।

তখন বাজে পাঁচটা। আমি ইমার্জেন্সিতে এসে সাড়ে পাঁচটায় সিভিল সার্জন স্যারকে ফোন দিলাম। উনি বললেন ইফতার শেষে কথা বলবেন। ইফতার শেষে আবার ফোন দিলাম, উনি বললেন দোকানি বেশ ক্ষমতাশালী। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। স্যারকে বললাম, তাই বলে আমাকে মারবে! উনি বললেন তুমি থাকো। আমি দেখতেছি। আমি এরপর আরো কয়েকবার তাকে ফোন দিয়েছি। কিন্তু নয়টায় আমার ইভিনিং ডিউটি শেষ হবার আগে পর্যন্ত তিনি আমাকে দেখতে আসেন নি। আমার প্রতিষ্ঠানের আরএমও হাসপাতালেই ছিলেন। তিনিও একবারও আমাকে দেখতে আসেন নি। আমি আহত হৃদয়ে ইমার্জেন্সি থেকে নয়টায় বের হয়ে আসি। এরপর খেয়াল করলাম, জামার দুইটা বোতাম ছিড়ে গেছে।

আমি ছোট একজন মেডিকেল অফিসার। এজন্য আমার খোঁজ নিলো না। জানি একজন বড় সিভিল সার্জন আমি নই। তাকে মারলে হয়ত দুনিয়া উল্টে যেত। হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যেত। আমার জন্য কিছুই হয়নি। সবই চলছে।
হয়ত কালও চলবে।

এই ত সেদিনও মা ফোন দিয়ে বললেন, তুমি বাসায় চলে আসো। আমি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে বসে বলি, আর যে কবে দেখা হবে! আম্মা আবেগি কন্ঠে বলেন, কাজ করতে হবে না। তুমি বেচে থাকো। ছোট ছেলেটা দেশের বাইরে। তোমার কিছু হয়ে গেলে… শুনি আর হাসি। এক জীবনে এমন কত ভালোবাসা যে আমাদের ঘিরে থাকে, আমরা তা টেরও পাই না। আমি ধরা গলায় বলি, চলে আসবো ঠিক একদিন দেইখেন। বলেই বুকে ধক করে ওঠে। মনে ভয় জাগে, যদি না ফিরতে পারি! যদি এমন হয় আমার কাছে আমার মা কে আসতে না দেয়া হয়! আঞ্জুমানের কাছে চলে যায় দেহটা! বাবার সাথে শেষ দেখাটা নাও হতে পারে।
কিন্তু শত ভয়ের মধ্যেও আমরা ডিউটি করি।

আমার একজন বড়ভাই ছিলো। দুই বছর বয়সে হাইড্রোকেফালাস নিয়ে মারা গেছেন। আজ ভাবি, তিনি বেচে থাকলে হয়ত এভাবে মার খেতে হতো না। দুঃখ একটা আমার ঢাকা মেডিকেলের বড় ভাই যিনি আমার সিভিল সার্জন তাকে আমি বড় ভাই বলতে পারলাম না। চারঘন্টায় তিনি এক কিলোমিটার রাস্তা গাড়িতে বসে আমাকে দেখতে আসেন নি। আমার জীবনে আমি প্রথমবারের মত নিজের বড়ভাইকে মিস করলাম।
একসময় দেখেছিলাম, বাংলাদেশ নামের দেশটির বেশিরভাগ শিশুরই রাস্তায় জন্ম হয়। কোন পিতামাতা থাকে না।

আজ জানলাম, আমি একজন সরকারি মেডিকেল অফিসার। আমারও কোন পিতামাতা নাই। হয়ত করোনার এই দিনে আর কোনদিন বেচে থাকবো না। কিন্তু জেনে গেলাম এদেশের সবার জীবনের মূল্য আছে বলেই আমি ঈদের ছুটি পাইনি। কিন্তু আমার জীবনের মূল্য নেই।
মাগো, ভাল থেকো, জেনে রেখো, তোমার ছেলে বলে কেউ নাই। যেদিন সাতক্ষিরায় সিভিল সার্জন হুসাইন শাফায়েতের সাথে কাজ করতে এসেছি, সেদিন থেকে তোমার আর কোন ছেলে নেই। মরে গেছে।”

এদিকে সামাজিকমাধ্যমে এ ঘটনা নিয়ে ডাক্তার সমাজের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে৷ করোনা পরিস্থিতিতে দেশ যখন চরম অবস্থায়, স্বাস্থ্যসৈনিকরা সামনে থেকে লড়ে যাচ্ছে তখন এরকম একটি আঘাত মেনে নিতে পারছেন না ডাক্তার সমাজ৷ সব জায়গা থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

একজন ডাক্তার সামাজিক মাধ্যমে আফসোস করে বলেন, “অভিভাবকহীন এ ডাক্তার সমাজের হাল ধরবে কে?”

আবার ডা. আরিফ হোসাইন নামে একজন মন্তব্যের ঘরে লিখেন “ডাক্তার নিগ্রহের অনেক ঘটনা শুনেছি। কিন্তু আজকের মত এত অপমান কখনো লাগে নি। মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেল। ”

নিজস্ব প্রতিবেদক

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

করোনামুক্ত হলেন ৮ জন চিকিৎসক

Sat May 9 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ০৯ মে ২০২০, শনিবার সারাবিশ্ব কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ে খুব খারাপ সময় পার করছে৷ বাংলাদেশে ছড়িয়ে গেছে এ রোগ। সম্মুখভাবে এ রোগের সাথে মোকাবেলা করতে গিয়ে এতে আক্রান্ত হয়েছেন ইতিমধ্যে অর্ধহাজারেরও বেশী চিকিৎসক। তাদের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন দুইজন। এরমধ্যেই একটি খুশির সংবাদ দিলেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ইসমাইল হাসান৷ কোভিড-১৯ […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo