আবু রায়হান, ১০৯ নং ওয়ার্ডময় ঘুরে বেড়াচ্ছে।ঘুরে বেড়াচ্ছে বললে আসলে ভুল হবে।
একটু আগে একজন নার্স রোগীকে ইনজেকশান পুশ করলো ,আবু রায়হান সেই সিরিঞ্জ এর খোসা এবং ব্যাবহারিত ইনজেকশানের ভায়াল আলাদা করে ময়লার বক্সে ফেললো।আরেকজন রোগীর ড্রেন টিউব খালি করা দরকার , ওয়ার্ড বয় আর খালা্রা অন্য কাজে ব্যাস্ত থাকায় আবু রায়হান বীরদর্পে এগিয়ে গিয়ে নিখুঁতভাবে ড্রেন টিউব খালি করে দিলো।
কে এই আবু রায়হান? সে কি ওয়ার্ড বয়?
না , সে ৮ বছর বয়সি এক বালক। মাদ্রাসায় ২য় শ্রেনীর ছাত্র।তার মা ১০৯ নং ওয়ার্ডের একজন রোগী।চলুন ,আবু রায়হানের মায়ের গল্পটা আগে শুনি ।
হাতুড়ে দ্বারা এম আর করতে গিয়েছিলেন আবু রায়হানের মা রাজিয়া।যথারিতি প্রচুর রক্তক্ষরন নিয়ে ভর্তি হয় ঢাকা মেডিকেলের গাইনী বিভাগে।গাইনী বিভাগে তার রক্তক্ষরন বন্ধের চিকিৎসা দেয়া হয়।৫ দিন পর রাজিয়ার পেট ফুলতে শুরু করলে গাইনী বিভাগ হতে আমাদের কাছে রেফারাল পাঠানো হয়।স্যার রোগী দেখে নিমিষেই ধরে ফেলেন গাট(অন্ত্র) ইনজুরি হয়েছে। অর্থাৎ এম আর করতে গিয়ে হাতুড়ে রোগীর জরায়ু ফুটো করে তার অন্ত্রের দেয়ালে ক্ষত করেছে।গাইনী বিভাগ দ্রুত অপারেশান থিয়েটার ম্যানেজ করলো।আমাদের সার্জারী টিম অপারেশান শুরু করলাম।রোগীকে অজ্ঞান করার আগে তার ব্লাড প্রেশার পাওয়া যাচ্ছিলো না। রোগী ছিলো শকে।এনেস্থেটিস্ট বলেই দিলেন এই রোগী অজ্ঞান করার পর পুনরায় ফিরে আসার সম্ভবনা খুবই কম। আল্লাহ্ ভরসা বলে অপারেশান শুরু করলাম।পেট খোলার পর দেখা গেলো পুরো পেট জুড়ে পায়খানা ছড়িয়ে আছে। এক জায়গায় অন্ত্রের দেয়ালে ইনজুরি খুজে পেলাম।সেখানে সেলাই দিতে গেলেও ছিড়ে আসছিলো।। ৫ দিনের পুরোনো কেস তাই পেটের নীচের অংশে প্রায় ১ লিটেরের মত পুজ জমা
ছিলো। যা হোক অন্ত্রের খারাপ অংশের প্রায় অনেকটা ফেলে দিয়ে জোড়া দেয়া হল।আমরা নিজেরাও সন্দিহান আদৌ অপারেশান সফল হবে কিনা।সফল হলেও ,অজ্ঞান অবস্থা থেকে রোগীর জ্ঞান ফিরবে কিনা।এনেস্থেসিয়ার ডাক্তারের ঘাম ঝড়ানো চেস্টায় রোগীর জ্ঞান ফিরলেও , রোগীর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। ওটি থেকে রাজিয়াকে সরাসরি আই সি ইউ তে ট্রান্সফার করা হল।
আই সি ইউ(ICU) তে টানা ৪ দিন থেকে কিছুটা উন্নতি হলে তাকে এইচ ডি ইউ(HDU) তে পাঠানো হয়।সেখানে কাটে আরো ৩ দিন। ইনফেকশান কন্ট্রল করতে আমরা তাকে ভালো একটা এন্টিবায়োটিক আর দ্রুত ক্ষত সারাতে ভিটামিন ঔষুধ এড করলাম। মানুষের বাড়িতে কাজ করে রোজগার করা রাজিয়ার পক্ষে এই ওষুধগুলো বাইরে থেকে কেনা স্বম্ভব ছিলো না।রাজিয়ার স্বামী হাসপাতালে আসার ২য় দিনেই চিকিৎসার খরচ যোগানোর ভয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেছে।যে বোনটা এতোদিন তাকে দেখে রেখেছিলো সেও একদিন বলে বসলো “রোগী মরলে মরুক , ছুটি দিয়া দেন আমরা বাড়িত নিয়া যাই” ।একজন মৃতপ্রায় রোগীকে আবারো জীবনের আলো দেখানোর আশায় হার মানলো না কতিপয় তরুন ডাক্তার।তারা ওষুধ কেনার জন্যে অর্থের জোগাড় করে দিলো, হাসপাতালের সমাজ কল্যান বিভাগে সকাল দুপুর দৌড়াদৌড়ি করে পথ্যের ব্যাবস্থা করে দিলো।বোন চলে যাওয়ায় রাজিয়াকে দেখভাল করার আর কেউ ছিলো না। তরুন ডাক্তাররা , নার্স আর খালাদের সহোযোগিতায় রাজিয়ার চিকিৎসা চালিয়ে নিলো। অপারেশানের জায়গায় ইনফেকশান থাকায় রাজিয়ার
উন্নতি হতে দেরি হচ্ছিলো। এতো সব খারাপ অবস্থা পার করে এতোদিন পর্যন্ত রজিয়ার বেঁচে থাকাটা আমাদের কাছে চিকিৎসা শাস্ত্রে্র একটা বড় মিরাকল।
একদিন সকালে রাউন্ড দিতে গিয়ে রাজিয়ার বেডের পাশে মিষ্টি চেহারার এক ছেলেকে আবিষ্কার করলাম।বেড ডক্টর বললো এই ছেলে রাজিয়ার একমাত্র সন্তান। রাজিয়া মানুষের বাড়ি গিয়ে কাজ করে এই ছেলেটার মুখে দুই বেলা ভাত তুলে দেয়ার জন্যেই। রাজিয়ার এই দশার কথা এতোদিন তার সন্তানকে জানানো হয় নাই। মায়ের সাথে সন্তানের অদৃশ্য সেই সুতোর টানেই হয়তো সন্তান ঠিকই খুজে খুজে চলে এসেছে ঢাকা মেডিকেলে হাসপাতালে। নাম জিজ্ঞেস করতেই লাজুক গলায় ছেলেটা জবাব দিলো “আবু রায়হান”। পরের কয়টা দিন যা করার আবু রায়হানই করলো আর আমরা অবিশ্বাস নিয়ে এই ৩ ফুটি ছেলেটার কার্যকলাপ দেখতে থাকলাম। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ঢাকা মেডিকেলের অলি গলি চিনতে খাবি খায়।আর ,আবু রায়হান এক দৌড়ে হাসপাতালের সামনের দোকানে গিয়ে ওষুধ কিনে আবার ঠিকমত ওয়ার্ডে ফিরে আসে।
মায়ের জন্যে খাবার এনে নিজ হাতে বেড়ে খাওয়ায়। ফল কেটে মায়ের মুখে তুলে দেয়। ড্রেসিং করার সময় মায়ের চিৎকার শুনে ছলছল চোখে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শুধু আমরা ডাক্তাররাই না ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডের সকল রোগী,নার্স,ওয়ার্ড বয় সবার প্রিয় হয়ে উঠে আবু রায়হান। অবশেষে সকল প্রতিকুলতা জয় করে রাজিয়া সম্পুর্ন সুস্থ হয়ে উঠলো।হাসিমুখে আমরা মা আর ছেলেকে বিদায় জানালাম।মাঝখানে কেটে যায় প্রায় দেড়টি মাস।
আবু রায়হানকে ঠিক যেনো ছোটোবেলায় পড়া রবীন্দ্রনাথের “বীরপুরুষ” কবিতার খোকা মনে হয় , যে কিনা বলছে-
এতো লোকের সঙ্গে লড়াই করে
ভাবছো খোকা গেলই বুঝি মরে।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে
বলছি এসে,লড়াই গেছে থেমে,
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে
বলছো, “ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিলো”
কি দুর্দশাই হত তা না হলে!!!!
লিখেছেন ঃ ডাঃ তানভির শুভ