প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৬ জুন ২০২০, শনিবার
সায়লা আক্তার রিমি
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (ডেন্টাল ইউনিট)
সেশনঃ ২০১৬-১৭
গত ১১ই মে ২০২০, ১৭ তম রোজার সেহেরী করতে উঠি। আম্মু বললো আব্বুর জ্বর, সেহেরী করবে না। আমি ভাত খেয়ে ডাবল মাস্ক,গ্লাভস আর চশমা পরে আব্বুর রুমে গেলাম, সাথে একটা থার্মোমিটার নিলাম। আব্বুর জ্বর মেপে দেখি ১০১° ফারেনহাইট। সেই মুহূর্তে মাথায় অনেককিছু ঘুরতে শুরু করে।
আব্বু ২ দিন আগে অফিস থেকে আম্মুকে কল করে বলছিলো গলাব্যথা হচ্ছে, গরম পানি দিয়ে রাখো। আব্বুর কাশিও ছিলো, যেটা এই ঠান্ডা-গরম সিজনের শুরু থেকে হওয়ার কারণে প্রথমে এত গুরুত্ব দেয় নাই। কিন্তু এবার জ্বর ওঠার পর কেমন যেনো কোভিড-১৯ সাসপেক্ট করতে থাকলাম।
আম্মুকে ওই রুম থেকে নিয়ে আমার রুমে রাখলাম, আর সিএমসিএসইউ (চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শিক্ষাথী সংগঠন) তে পোস্ট দিলাম আব্বুর কোভিড১৯ টেস্ট করাতে চাই আর এরজন্য সাহায্য চেয়ে৷ খুবই জলদি সেখান থেকে রেসপন্স পেলাম। এরজন্য আমি সিএমসিএসইউ এর আর এম. এ. কাইয়ুম ইমন এর কাছে সবসময় কৃতজ্ঞ থাকবো।
ইমনের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলাম পরেরদিন সকালে চমেকে আব্বুর টেস্ট করাবো। এরজন্য ইমন, ডাঃ আসাদ ভাইয়ের সাথে কথা বলে যা যা করা দরকার সব করলো। সেই সাথে পরের দিন সকালে আমাদের বাসায় কাজ করা আপুকে আসতে মানা করে দিলো আম্মু। আমার আপুর ছোট মেয়েটা আমাদের সাথে থাকতো আপু অফিসে গেলে,ওকেও আসতে মানা করে দেয়া হলো।
সেই রাতটা কীভাবে পার করেছি আল্লাহ জানেন।
১১ই মে সকাল,
সকাল নয়টায় আব্বুকে ডাবল মাস্ক-গ্লাভস-চশমা পরায়ে,আমিও ডাবল মাস্ক-গ্লাভস-চশমা পরে বের হয়ে গেলাম চমেকের উদ্দেশ্যে।চমেকের ইমার্জেন্সির বাইরের বুথ থেকে টিকিট কেটে ভেতরে গিয়ে রুম নং-১০২ এ কথা বললাম আমি। আব্বু বাইরে দাঁড়ানো ছিলো। ওনাকে আব্বুর সিম্পটম সব জানাই আর বলি কোভিড-১৯ টেস্ট করাতে চাই। মেডিকেল স্টুডেন্ট পরিচয় দিলে তা উনি লিখে দিলেন টিকিটে। এরপর চলে গেলাম অবজারভেশন ইউনিটে। অবজারভেশনের ডিউটি ডক্টর রুমে গিয়ে টেস্ট করানোর জন্য টিকিটটা দিলে উনি বলেন ফ্লু কর্ণারে গিয়ে ইএমও কে দেখানো লাগবে। ওখানে উনি প্রয়োজন মনে হলে লিখে দিলে টেস্ট করানো হবে। আমি চলে আসলাম আবার ইমার্জেন্সিতে। ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসারের সাথে কথা বলতে। উনি অন্য রোগী এটেন্ড করছিলেন দেখে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা লাগলো। ডক্টর আসলে আমি আবার ডক্টর রুমে যাই,আব্বুর সব সিম্পটমস বলি আর বলি কোভিড১৯ টেস্ট করাবো। উনি সব শুনেন আর টিকিটে অর্ডার লিখে দেন সাথে জ্বরের জন্য ঔষধ দিলেন আর চেস্ট-এক্সরে করতে দিলেন।
এরপর আবার চলে আসি অবজারভেশনে। সেখানে টিকিট দেখানোর পর ডিউটি ডক্টর ফর্ম ফিলাপ করেন। মেডিকেল স্টুডেন্ট বুঝতে পারায় পরিচয় জানতে চান আর সেখানে দেখা যায় আমার পরিচিত এক ভাই ডাঃ ইফতেখার আলমকে। আমাকে আর আব্বুকে দুজনকেই তিনি চেনেন। এমন অবস্থা যে উনিও ফুল পিপিইতে,আমিও মাস্ক আর চশমা পরা বিধায় কেউ কাউকে চিনি নাই প্রথমে। ফর্ম ফিলাপ করার পর ভাইয়া বলেন,”কালেক্টর এখনো আসে নায়,এখানে থাকা রিস্কি। তুমি আংকেলকে নিয়ে বাইরে কোথাও বসো। কালেক্টর আসলে আমি ফোন দিবো। আর এরমধ্যে এক্সরে করে আনো।”
আমি আব্বু কে নিয়ে এক্সরে করিয়ে আনি। আব্বুকে বাহিরে রেখে প্রথমে ইমার্জেন্সিতে দেখাই এক্সরে। নরমাল আসছে বলে জানান আর ভয়ের কারণ নাই বলেন। ডাঃ ইফতেখার ভাইকে দেখালে উনিও একি কথা বলেন। তারপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য টেস্টটা করতে বললেন আর আমরা টেস্টের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।
সকাল ১১ঃ৩০ এর দিকে কালেক্টর আসে আর আমি আব্বুর টেস্ট করিয়ে বাসায় চলে আসি। এরপর শুরু হয় আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে শুধু একটা নেগেটিভ রিপোর্ট চাইতে থাকার পালা।
এদিকে বাসায় আম্মু আর কৌশিককে বলে আসছিলাম আব্বুর জন্য সামনের দিকের এটাচ বাথ সহ বেডরুম টা রেডি রাখার জন্য। সাথে মাস্ক গ্লাভস পরে আব্বু যে রুমে ছিলো সে রুমের সব ফার্নিচার ডিসইনফেক্টেড করার জন্য,চাদর বালিশের কভার ধুয়ে বালিশগুলো রোদে দেয়ার জন্য। আম্মুরা সেগুলো সব করে রাখে।
বাসায় এসে আব্বু তার জন্য প্রস্তুত করা রুমটায় চলে যায় সম্পূর্ণ আইসোলেশনে আর আমরা দোয়া করতে থাকি রিপোর্টটা যাতে নেগেটিভ আসে আর আব্বু আইসোলেশন থেকে বের হয়ে আসতে পারে।
আম্মু আর কৌশিককে আব্বুর রুমে যাইতে মানা করে দিলাম। আব্বুকে খাবার দাবার আমি দিতাম। রুম মুছে ডিসইনফেক্টেন্ট স্প্রে করতাম সবকিছুতে। প্রতিবার ডাবল মাস্ক গ্লাভস পরে যাইতাম। সেসময় আব্বুও মাস্ক পরে থাকতো। খাবার নেওয়ার সময়, আমাদের সাথে কথা বলার জন্য দরজার কাছে আসলে, আর কাশি হলে আব্বু রুমে মাস্ক পরে থাকতো প্রায় সবসময়ই।
যেহেতু আমি আব্বুর কন্টাক্টে যাচ্ছি সেজন্য আমিও আইসোলেটেড হয়ে গেলাম। নিজেকে আম্মু আর ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে দূরে রাখতাম। প্রতিবার মাস্ক পরে রুম থেকে বের হতাম। নিজের সব ব্যবহারের জিনিস আলাদা করে রুমে রাখলাম। আমার রুমে আসা বা আমার কোনো জিনিস কেউ যাতে স্পর্শ না করে সেটা বলে দিলাম। আমিও আমার রুমের বাহিরের কোনো কিছু স্পর্শ করতাম না। করা লাগলেও হ্যান্ড স্যানিটাইজ করে গ্লাভস পরতাম, না হয় ২০সেকেন্ড ধরে সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে হ্যান্ডরাব ইউজ করতাম। আর এরপর যে জিনিসটা আমি টাচ করেছি সেটা ডিসইনফেক্ট করে ফেলতাম সঙ্গে সঙ্গে।আব্বুর খাবার প্লেট, গ্লাস,পানির জগ, চা খাওয়ার কাপ, চামচ, বাটি, পেস্ট ব্রাশ, থার্মোমিটার, ফ্লাস্ক সব আলাদা করা হলো। খাওয়াদাওয়ার পর প্লেট-মগ এসব গ্লাভস পরে ধুয়ে আলাদা করে রাখতাম আমি। আর প্রতিবার হ্যান্ড স্যানিটাইজ করা অভ্যাসে নিয়ে আসলাম।
সাথে আব্বুকে দেয়া হলো জ্বরের ঔষধ সহ আরও কিছু ট্যাবলেট ,সাথে আব্বুর হাইপারটেনশনের ওষুধ আর বাকি ঔষধ যা আগে থেকেই নিয়মিত নিতো।
একটু পরপর গরম পানি খাওয়া,৩-৪বার লেবু-আদা চা খাওয়া,লবণ গরম পানির গার্গল করা,গরম পানির ভাপ নেয়া এসবও চলতে থাকলো। ভিটামিন-সি যুক্ত ফল,স্যুপ,বেশি বেশি প্রোটিন যুক্ত খাবার দেওয়া হলো আব্বুকে।
এভাবে ২দিন গেলো,আর আমি বারবার ইমনের সাথে যোগাযোগ করে রিপোর্ট আসছে কি না খবর নিতে থাকলাম। ইমনও ডাঃ ফয়সাল ভাইয়ের সাথে কথা বলতে থাকলো। ফয়সাল ভাইয়ের কাছে আমি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকবো। উনি উনার অবস্থান থেকে সবরকম সাহায্য করেন আমাকে। আর আমরা প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে থাকলাম।
অনেকদিন ধরে পরিচিত মানুষরা বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাচ্ছেন৷ যখন যেভাবে পারছি সবাইকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। অনেককে তা পারছি না। এজন্য এভাবে লিখা। সবাই যাতে সাবধানে থাকে, মোটামুটি একটা নলেজ নিয়ে রাখে।