[প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৮জুন, ২০২০, সোমবার]
২২শে মে,২০২০, আব্বুর আইসোলেশনের ১২তম দিন। আমাদের পাঁচ রুমের বাসাটা ছোটখাটো একটা আইসোলেশন ইউনিটে পরিণত হলো। প্রতিদিন নিয়ম করে ৪-৫বার ঘর মুছে ডিসইনফেক্ট করা হয় সব আসবাবপত্র।
এই ১২টা দিন ১২টা বছরের মত করে কাটলো। আম্মু সারাটা দিন অসম্ভব চাপে কাটাতো। কিন্তু আমাদের কখনো বুঝতে দেয় নাই। আম্মু সবসময় স্ট্রং ছিল। আব্বুও নিজের সব শক্তি দিয়ে এই মহামারির সাথে যুদ্ধ করতে থাকল। রাতে ঘুম ভেঙে যেত, ক্ষুধা লাগত। আম্মু উঠে কিছু বানিয়ে দিত, আমি মাস্ক গ্লাভস পরে রুমের সামনে রেখে আসতাম। কত রাত স্বপ্ন দেখছে, কত নামাজে বসে কান্না করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছে আমাদের কখনো বুঝতে দেয় নাই। আমরা একজন আরেকজনকে দেখতাম, কথা বলতে পারতাম। আব্বু সেটাও পারতো না। আব্বু অনেক মানসিক শক্তি নিয়ে সব ফেইস করে। আমাদের সাহস দেয়। সবসময় আব্বু কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করলে বলতো,
“মা আঁই ঠিক আছি। আঁরে নি টেনশন ন’গরিস!”
আম্মু-আব্বু-ভাই সবাই মেন্টালি শক্ত থাকে। আমিই মনে হয় বেশি চিন্তা করতে থাকি। আম্মু আব্বুর কো-মরবিডিটি নিয়ে সবসময় ভয়ে থাকতাম। পরিচিত মানুষরা খোঁজ নিলে আমার এংজাইটি আরো বাড়তে থাকত। এক রাতে প্যানিক এটাকে পড়ে গেলাম। বিপি বেড়ে গেলো,প্যালপিটিশন হওয়া শুরু হলো,পুরো রাত ঘুমাই নাই। পরেরদিন সকালে রব স্যারের সাথে কথা বলি, টেস্ট করানোর জন্য। স্যার বলেন,টেনশনের কারণে এমন লাগছে। আর ঘুমের ওষুধ দেন। স্যার আর ইফতেখার ভাইয়ার সাথে কথা বলে আশ্বাস পাই। নিজেকে শান্ত করতে পারি। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে থাকি। পরে আর ওষুধ নেয়া লাগে নাই।
শুরু থেকে আব্বুর উপসর্গ বলতে শুধু জ্বর ১০০°ফারেনহাইট আর কাশি ছিলো। ৪-৫ম দিনে ২-৩বার পাতলা পায়খানা হয়। তবে পরে আর সমস্যা হয় নি,নিজ থেকেই ঠিক হয়ে যায়। শুরুর একরাতে আব্বুর পেট ব্যথা শুরু হলে সকালে স্যারকে কল দেই আর স্যার একটা ঔষধ দেন। এতে ২দিনেই আব্বুর পেট ব্যথা রিজল্ভ করে। মাঝে কাশির পরিমাণ বেড়ে যায়, যার জন্য কাশতে গেলে বুকে ব্যথা করত। তখন আবার স্যারের সাথে কথা বলি। স্যার আব্বুকে কাশির ঔষধ দেন আর ইনহেলার দিতে বলেন। এতে আব্বু কিছু টা আরাম পেত। আল্লাহর রহমতে আব্বুর কখনো শ্বাসকষ্ট হয় নাই। নিজের সব কাজ নিজে করতে পারত। ঘরে বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজও করত।
এভাবে প্রতিদিনই নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হতে থাকে আর সে অনুযায়ী সবকিছু গুছাতে থাকি আমরা।
২১শে মে থেকে অর্থাৎ ১১তম দিন থেকে আব্বুর জ্বর নেমে যায়,টেম্পারেচার ৯৭-৯৮° ফারেনহাইট এ চলে আসে। নাপা খাওয়ানো বন্ধ করলাম। আগের থেকে আল্লাহর রহমতে আব্বু সুস্থ অনেক। আর আমাদের তিনজনেরও এই ১২দিনে কোনোরকমের সিম্পটম দেখা দেয় নাই। সবাই সুস্থ ছিলাম আল্লাহর রহমতে। তবে দূরত্ব তখনও মেইনটেইন করে চলি সবাই। আমি আইসোলেটেড থাকি।
১৪তম দিনে আব্বুর সব সিম্পটম রিজলভ করে ফেলে প্রায়ই। ওষুধ বন্ধ করার পরও জ্বর আর ওঠে নাই লাস্ট ৪দিন ধরে। বাসার বাকি সবাইও সুস্থ।
রব স্যারের সাথে কথা বলি। স্যার সব শুনে বললেন আর চিন্তার কোনো কারণ নাই। কালকে আব্বু ওই রুম থেকে বের হতে পারবে। আমাদেরও আর রিস্ক নাই। ঈদের পরে করে জেনারেল হাসপাতালে যেতে। টেস্ট করে নেগেটিভ আসলে সার্টিফিকেট দিবে আর আব্বু ফ্রিলি চলাচল করতে পারবে। সাথে আমাদেরও যেহেতু ১৪দিনের কোয়ারেন্টিন শেষ আর কোনো প্রকার সিম্পটম এরাইজ করে নাই কারো,আমাদের আর টেস্ট করার প্রয়োজন নাই।
২৫ই মে,২০২০। আজ ঈদ।
আমাদের বাসায়ও ঈদ আজকে। আব্বু সেই ১৪ দিনের জেলখানা থেকে বের হয়ে আসবে। আমরা ড্রয়িং রুমটায় আব্বুর থাকার জন্য বেড বিছালাম,সব পরিষ্কার করলাম,ব্লিচিংপাউডার-পানি স্প্রে করলাম। আব্বু নিজের রুম, বাথরুম ডিসইনফেক্ট করে গোসল করলো। বাহির থেকে নতুন কাপড় দেয়া হলো সেটা পরে আব্বু ওই রুম থেকে বের হয়ে সামনের রুম টায় আসলো। আর আমাদের ঈদ শুরু হলো।
আম্মু সেমাই করলো। সবাই খেলো। ঈদের দিন নাকি মিষ্টি খাওয়া লাগে সবার৷ পোলাও রান্না করলো। সবাই খেলো একসাথে৷ তবে দূরত্ব রেখে। আমি তখনও নিজের রুমে থাকতে লাগলাম। কাজে বের হলে মাস্ক গ্লাভস পরতাম। কারণ কেয়ার গিভার হিসেবে নিজের জন্য কোয়ারেন্টিনের মেয়াদটা বাড়ায়ে নিই। এদিকে আব্বু খুলশী থানাতে কল দিয়ে জানায় আব্বুর ১৪দিনের আইসোলেশন শেষ আর আল্লাহর রহমতে শারীরিক ভাবে সুস্থ আছে। ওরা জানায় ডাক্তার থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে থানায় জমা দিলে বাকিটা ওরা করে দিবে।
আব্বু যে রুমে ছিলো এই ১৪দিন সেই রুম পরবর্তী চারদিন খালি রাখি। রুমের কিছু বের করি নাই। সব ওখানেই ছিলো। আব্বুর প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস যা বের করা লাগলো সব ৭০% আইসো প্রোপাইল এলকোহল স্প্রে করে ডিসইনফেক্ট করে নেই। চারদিন পর রুমটা পরিষ্কার করি। ব্লিচিং পাউডার পানি দিয়ে ফ্লোর মুছি, সাবান পানি দিয়ে সব ফার্নিচার মুছি, ডিসইনফেক্টেন্ট স্প্রে করি। রুমের সব চাদর,বালিশের কভার,আব্বুর জামাকাপড়, কাঁথা সব ওয়াশিং মেশিনে ধুয়ে রোদে দেয়া হয়। সাথে বালিশ, তোষকও রোদে দেয়া হলো।
আল্লাহর কাছে বারবার শুকরিয়া করলেও কম হবে।
আল্লাহর রহমত ছাড়া আমরা সবাই এতদিন পর্যন্ত সুস্থ থেকে ফিরতে পারতাম না৷ আর সাথে ছিলো আমাদের আত্মীয় স্বজন,আমার কাছের মানুষরা, আব্বুর কলিগরা, আমার ফ্রেন্ডরা,ক্লাসমেটরা সবার দোয়া। সবার দোয়া সাথে না থাকলে আর আব্বু আম্মু শক্ত না থাকলে আজকে এসব লিখতে পারতাম না। এই ভয়ংকর সিচুয়েশনে যে বা যারা আমাদের জন্য একবার হইলেও দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়েছেন আপনাদের প্রত্যেকের কাছে আমরা সবসময় ঋণী থাকব। সবসময়।
২৭ই মে,২০২০। ১৭তম দিন। আব্বু জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে ২য় টেস্ট করে আসে। রিপোর্ট পেতে নাকি ৫-৭দিন সময় লাগবে। আমরা এখনো কোয়ারেন্টিনে আছি। কেউ বাসা থেকে বের হই না। ৩দিন পরপর রাতে মাস্ক-গ্লাভস পরে কৌশিক ময়লা ফেলে আসে। ময়লা ফেলার ক্ষেত্রেও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি প্রটোকল মেনে চলার। ওয়েস্ট গুলো যে প্যাকেটে থাকতো সেটা গ্লাভস পরে নিয়ে বেঁধে অন্য আরেকটা প্যাকেট রাখা হতো। সেটা আবার আরেকটা প্যাকেটে নিয়ে ডিসইনফেক্ট করে এরপর সবার শেষে ডাস্টবিনে রেখে আসা হতো। যাতে পরেরদিন সকালেই সেগুলো সিটি কর্পোরেশন থেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
৩১ই মে,২০২০। জেনারেল হাসপাতালে রিপোর্ট নিতে যায় আব্বু। কেননা তখনো মেসেজ আসে নাই আর সার্টিফিকেটও নেওয়া লাগবে। আব্বুর টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। আলহামদুলিল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ। জেনারেল হাসপাতালের RMO স্যার আব্বুকে সুস্থতার সার্টিফিকেট দেন।
সার্টিফিকেট ফটোকপি করে এক কপি দেন বাড়িওয়ালাকে(ওনারা চাইছিলেন) আরেক কপি পরেরদিন দিয়ে আসেন খুলশী থানায়। কাছের মানুষদের আব্বুর সুস্থতার কথা জানালে সবাই অনেক সন্তুষ্ট হন আর দোয়া করেন। সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
আজকে ২৫তম দিন। আব্বু, আমি,আম্মু, আর আমার ছোট ভাই আমরা সবাই আল্লাহর রহমতে সুস্থ আছি।
এই লিখাটা আমি লিখলাম শুধুমাত্র আমার বাস্তব অভিজ্ঞতাটা শেয়ার করার জন্য। আমাদের দেশের যে অবস্থা, এখন ঘরে ঘরে এই পরিস্থিতি। আমার লিখা গুলো পড়ে একজনেরও যদি উপকার হয় আমি অনেক শান্তি পাব।
আর সেইসব মানুষ গুলোকে ধন্যবাদ দেয়ার জন্য যারা আমাকে আর আমার পরিবারকে সাহায্য করছেন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ এম এ কাইয়ুম ইমন, ডা. আব্দুর রব স্যার, ডা. ইফতেখার ভাইয়া, ডা. আনোয়ার সায়েদ স্যার,ডা. মইনুল স্যার, ডাঃ আশিক ভাই। আপনাদের সবার জন্য সবসময় মন থেকে দোয়া করি আর করে যাবো।
নোট : করোনায় আক্রান্ত মানেই সব শেষ না। Early diagnosis খুব প্রয়োজন এখানে। যত জলদি আপনি রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা শুরু করে দিবেন তত তাড়াতাড়ি আপনার viral load কমবে আর তত আপনার সুস্থতার হার বাড়বে। এরজন্য উপসর্গ গুলোকে এলার্মিং হিসেবে চিন্তা করতে হবে। আপনি টেস্ট করতে না পারেন তবে চিকিৎসা নিতে দেরি করবেন না। অবহেলা করবেন না। যেকোনো জ্বর, কাশির সমস্যায় টেলিমেডিসিন সেবা নিন। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ডিসপেনসারি থেকে যা তা ওষুধ কিনে খাবেন না। এতে ভালো কিছু পাবেন না।
আমাদের দেশে রিসোর্স কম,সেটার দোষ হেল্থ কেয়ার প্রোভাইডারদের না। কথায় কথায় ডাক্তারদের গালি দিবেন না। এর জায়গায় হন্য হয়ে ঘুরাঘুরি বন্ধ করেন। আপনাদের মত কিছু মানুষ আর আমার সরকারের কিছু উটকো ডিসিশনের জন্য আমার আব্বুর মত মানুষ যারা সর্বোচ্চ সচেতনতা মেনে চলেও শুধুমাত্র অফিসে যাওয়া থেকে আক্রান্ত হচ্ছে।
করোনা আক্রান্ত রোগী আর তার পরিবারকে হেয় করবেন না। বিপদে ফেলবেন না। আজকের এই রোগীই সুস্থ হয়ে কিছুদিন পর প্লাজমা ডোনেশনের মাধ্যমে আপনার বা আপনার আপনজনেরই পাশে দাঁড়াবে। আপনি হলফ করে বলতে পারবেন না যে আপনি আক্রান্ত হবে না। এখন কমিউনিটি লেভেলে ট্রান্সমিশন হচ্ছে যেহেতু, যেকোনো সময় যে কেউই আক্রান্ত হতে পারে। এর জন্য সহানুভব হন।
সবাই সুস্থ থাকেন, আর একে অপরের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতে থাকেন।