১৭ এপ্রিল, ২০২০
ডাঃ শারমিন আখতার চৌধুরী
এসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার, গাইনি ও অবস
মিটফোর্ড হাসপাতাল
গাইনীর সি এ মানেই সে এক অস্থির জীবন৷ তারপরেও সব কিছু ভালোই চলছিল। ১৩ মাসের বাচ্চা নিয়ে সি এ পোস্টে জয়েন করি। প্রতিটা রোগী নিজের হাতে দেখি, নিজের মনে করে দেখি। পুরো বাংলাদেশে যখন কোভিড ১৯ নিয়ে হাহাকার শুরু হলো তখনো নির্বিকার ভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে ডিউটি করে যাচ্ছিলাম, ভেবেছিলাম আমরা তো গাইনীতে কাজ করি হয়তো খারাপ এরকম রোগী আসবে না৷
একদিন হঠাৎ শুনি গাইনী সিজার ওটির সিস্টার ফুল ফ্যামিলিসহ পজিটিভ৷ মনে কিছুটা ভয় আসলেও ধামাচাপা দিয়ে রাখলাম এই ভেবে যে ওটি তো আমরা ৩ তলা গাইনী রুটিন ওটিতেই করতে পারব৷ সিজার ওটি বন্ধ তো কি হইছে? এই পোস্টে আসার পর কখনো কোন খারাপ পেশেন্ট ফিরায়ে দেই নাই এই কথা আমি বুকে হাত দিয়ে আমি বলতে পারি। কিন্তু আবার শুনলাম সার্জারী সিগ্ময়েড ভলভুলাস যেই পেশেন্ট এর ওটি হয়েছে, সে করোনা পজিটিভ। আর সার্জারী ওটি রুমের পাশেই গাইনী রুটিন ওটি রুম।
আবার সোমবার দিন জানলাম গাইনী ইউনিট-১ এ Ruptured ectopic pregnancy এর এক পেশেন্ট এর ইমার্জেন্সি ওটি হয়েছে, সে করোনা সাস্পেক্টেড। মঙ্গলবার এডমিশন করতে আসার একটু আগেই জানলাম সেই পেশেন্ট করোনা পজিটিভ আসছে! ইউনিট ১ এর সিএ পেশেন্ট এর ওটি করেছে। অন্য সব ডাক্তারেরা এসিস্ট করছে, রিসিভ করা ফলো আপ করা সব কিছুতে যুক্ত ছিল। ওয়ার্ড ডিস ইনফেকশন করা নাই, এডমিশন রুমে যেখানে পেশেন্ট রিসিভড হয়েছে, সেখানেই আমরাও এডমিশন করলাম। যেই ওয়ার্ড এ রোগীটা ছিল, সেটা খোলা ছিল। সেখানে আমাদের এক রোগী করোনা সাস্পেক্টেড পেশেন্ট ছিল। আমরা তার এক্সামিনেশন, ডেলিভারী সব করেছি। আরেকটা সাস্পেক্টেড পেশেন্ট এর পিভি রুমে এক্সামিনেশন করার পর জানাই ওটি লাগবে। ওটি লকড শোনার পরেই তাকে আর খুঁজে পাই নাই। তার জ্বর ছিল, হিস্ট্রি ভালো ভাবে নেয়ার আগেই সে নাই।
কাল রাত ৮ঃ২০ এ একজন brought dead পেশেন্ট গাইনী ইউনিট ৫ এ আসে। রোগীর লোক হিস্ট্রি দেয় রোগীর খিচুনি ছিল। এটা শুনে ইউনিট ৫ এর ডাক্তার রা রোগীকে এক্সামিনেশন করেন। ভালো ভাবে হিস্ট্রি নিতে গিয়ে হঠাৎ করে সি এ আপু জানতে পারেন রোগীর ৩ দিনের শ্বাসকষ্ট ছিল৷ এটা জেনে আপুর হাত পা অবশ হয়ে আসে, এটি কেনো আগে বলে নি রোগীর লোক! সাথে সাথে আপু প্রোটোকল অনুযায়ী সবাইকে জানায় এবং পেশেন্ট এর আজকে দুপুর দুইটায় করোনা পজিটিভ আসে! গতকাল তিনি নিজের পরিবারে ফিরে গিয়েছিলেন আজ আতংকিত হয়ে হতবাক হয়ে আছেন৷
অনেকে বলতে পারেন, কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ডিউটি থাকলে কি করতেন? সে তুলনায় ভালো না? আমি তাদের বলতে চাই, ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে তো আমি জানি যে এরা পজিটিভ কিন্তু এখানে আমাদের সেটা জানার ও সুযোগ নাই। আমাদের মিটফোর্ড হাসপাতালের শতকরা ৯০ ভাগ রোগী পুরান ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের। এরা সবাই হাই রিস্ক জোনের মানুষ। আপনারা যদি মনে করেন, নকল বাজারের কাপড়ের পিপিই ও নকল মাস্ক পড়ে আমরা যোদ্ধার মত করোনা ঠেকিয়ে দিব, তবে আপনারা ভুল ভাবেন। আমাদের পরিবার আছে, সন্তান আছে। আমরা ৬ ইউনিটের সবারই ছোট বাচ্চা আছে৷ প্রতিটা দিন আমরা আতংকে সময় পার করছি। মানসিক ভাবে ভয়াবহ বিপর্যস্ত। দুইদিন হলো পরিবার ও বাচ্চা থেকে দূরে থাকছি। নিজের সাথে যুদ্ধ করে সময় পার করছি। একটা রোডে যদি একটা পেশেন্ট পাওয়া যায় তবুও সেই জায়গা লকডাউন হয়। আমাদের সিস্টার, ডাক্তার, পেশেন্টসহ অনেকেই পজিটিভ, সাস্পেক্টেড। সেই একই জায়গায় প্রোপার ডিসিনফেকশন ছাড়াই আমরা ডিউটি করে গেছি আর যাচ্ছি৷ এখনও প্রতিটা দিন করোনা সাস্পেক্টেড পেশেন্ট আসছেই৷ আমাদের কি জীবনের কোন মূল্য নেই? এভাবে আনপ্রোটেক্টেডভাবে আমরা ডিউটি করেই যাব? প্রতিটা ডাক্তার ইনফেক্টেড না হওয়া পর্যন্ত কি আমরা কাজ করেই যাব?
প্রশ্ন রেখে গেলাম।