০৩ মে ২০২০, রবিবার
চারপাশ থইথই করছে বৃষ্টিতে। রেইনকোট না পিপিই পরেছি, এই দু’য়ের তফাৎটা বুঝতেই পারছি না। অতলান্ত শহরটাকে দেখছি। তবুও বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না,
“এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘন ঘোর বরিষায়।”
কৃষ্ণচূড়ায় তবুও একটু কম রং ধরেনি। সবুজের ছায়ায় ভরে উঠছে এই রুগ্ন পৃথিবী। পাখীর কলতানে মুগ্দ্ধ এ শহর।
মানুষের মৃত্যুর মিছিল কি অবিশ্বাস্য ভাবে প্রকৃতিকে সাজিয়েছে, তা না দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না। তবে কি আমরা প্রকৃতিকে কেবল আহতই করে গেছি? তাই সে সুযোগ বুঝে হাসছে আমাদের দিকে তাকিয়ে?
নাকি তার রং, রূপ, স্পর্শ দিয়ে আমাদের আহত বুকে বোলাতে চাইছে ভালোবাসার চাবিকাঠি? অপেক্ষা করে আছে মানুষ কবে তার বুকে ফিরে আসবে সবটুকু কোমলতা অথবা পেলবতা নিয়ে?
নগন্য আমার জানা হয় না এই প্রশ্নোত্তর।
আমি কেবল ভয়ার্ত মুখগুলোর অসহায়ত্ত্ব দেখি। গিজগিজ করে রোগী, রোগীর লোক। ওদের চোখমুখের অস্ফুট আশংকা আমাকে নাড়া দিতে থাকে ক্রমশ। ওদের বেঢপ উচু পেট থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ পাই। যেন ফিসফিস করে আমাকে বলছে “আন্টি আমাকে তাড়াতাড়ি বের করো। আমি আম্মুকে দেখতে চাই।”
সে চাওয়ায় কখনও কোল ভরে হাসে চন্দ্র-সূর্য। কখন ও বা কাঁদে সন্তান হারানোর বিমর্ষ বেদনা। সেই বেদনাটুকু কতখানি গভীর ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকে আমাদের হৃদয়ে, কখনো বলা হয় না সেই দূঃখী মা গুলোকে।
অভ্যস্ত হাতে রোগীর চোখ দেখি। পালস্ মাপি। মাপা হয় না ওদের হৃদয়ের গভীর সমুদ্র। যেই সমুদ্র থেকে ওরা আনে একটা লাউ/কুমড়া অথবা এক হালি লেবু কিংবা একবাটি পায়েস। বিশ্বেস করো, এইটুকুর লোভে আমি ডাক্তার হয়েই জন্মাতে চাই। পায়ের তলার চটি খয়ে গেছে হাটতে হাটতে। গায়ের ঘামে কখনো জমে অবাধ্য অশ্রু। মেধাহীনদের কপট দাপটে মুচড়ে গেছি বহুদিন। ক্লাশের নিচের সারির ছাত্রছাত্রীদের হাকিয়ে যাওয়া গাড়ীর কাদা মুছেছি অনেকবার। তবুও এই ভয়ংকর শ্বাপদের দেশের কালো কাদা ছুরিকাচি দিয়ে ঘষেছি বারবার।
বিশ্বেস করো, সেখানে লেখা নেই ঝা চকচকে গাড়ী, ডুপ্লেক্স বাড়ী কিংবা আলিশান কিংবদন্তি সুখের গল্প। সেখানে ফুলস্টপের মত বেঁচে আছে তোমাদের দেয়া পুইশাক, কচুশাক আর একবাটি পায়েসের গন্ধ। সে গন্ধই আমাদের বাচিয়ে রাখে। অবসরে বুকের কোনে জমায় ভালোবাসার অবাধ্য পলিমাটি।হয়ত এজন্যই দেশ ছাড়ার ছাড়পত্র টাও ফেলে দিই কুচিকুচি করে।
জানি এই অনুভবটা কখনো পৌঁছুবে না তোমাদের অভিমানের পৃথিবীতে। তবুও সময় করে একটু জড়িয়ে ধরে দেখো আমরা কোন আলাদা গ্রহের নই।বরং তোমাদের হৃদয় গচ্ছিত আমাদের হৃদয়ের রাজসভাতে।
ডিউটি থেকে বের হয়েছি অনেকক্ষণ। হাপিত্যেশ হয়ে দাড়িয়ে আছি একটি রিক্সা কিংবা সিএনজির আশায়। চারপাশে কেবল ঝুম বৃষ্টি। আমার পাশের কলিগ সাতমাসের প্রেগনেন্ট। সারাক্ষণ ডিউটি করতে করতে নাকি রিক্সার অপেক্ষা করতে করতে ওর শুষ্ক চোখের নীচে জমেছে কালি। মনে হচ্ছে বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাচ্ছে আমাদের চোখের কাজল। অথবা হৃদয়ের বাদল। কাজল বিহীন চোখ মুছতে মুছতে ওর বাচ্চাটা বলছে,
“মা,আমার খুব ঠাণ্ডা লাগছে। বাড়ী যাবো।”
আমরা বাড়ী ফিরি, ফিরতে হয় বলে। ভাইরাসের থাবা কেড়ে নেয় আমাদের জীবন, স্বপ্ন কিংবা বেঁচে থাকার বেমানান ইচ্ছাগুলোকে।
তবুও আমরা বেঁচে থাকতে চাই তোমাদের সাথে কৃষ্ণচূড়ার উৎসব দেখবো বলে। তোমাদের উঠোনের জোৎস্নায় ভাসবো বলে। তোমাদের ভালোবাসায় বাচবো বলে।
ডা. সেলিনা সুলতানা স্মৃতি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়