১….
বিয়ে বাড়ী টাইপের যেকোনো অনুষ্ঠান আমি সাধারণত অ্যাভয়েড করি। তবে সে বিয়ে যদি হয় নিজের ওয়াইফের আদরের কাজিনের, তখন তা অ্যাভয়েড করা নিতান্তই কঠিন।যারা বিবাহিত তারা জানেন, এ ধরণের অনুষ্ঠানে অনুপস্থিতি নিজের ঘরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে….
নিজের কাজিনের বিয়ে, তাই বউ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আগেই চলে গেছে।আমি একটা আর্টিকেল পড়ছিলাম, জানলাম-সমগ্র জীবনে সম্রাট আকবর পাঁচবার তার রাজসভায় যোগ দেন নি, সেই পাঁচ বারের একবার হলো বীরবলের মৃত্যুপরবর্তী সময়টি। ইন্টারেস্টিং টপিক পড়া শেষ করে আস্তে ধীরে পাঞ্জাবী পড়ে রেডি হচ্ছি ।এমন সময় উপরের ফ্ল্যাটের এক ছেলে এসে হাজির, তার মা কেমন যেন করছে। ছেলেটির সাথে যেতে হলো…..
অবস্থা আসলেই খারাপ, হাই ব্লাড প্রেসার, উল্টাপাল্টা বকছে, অতিরিক্ত রক্তচাপ মেজর অর্গানগুলোকে ঝামেলায় ফেলছে। মেডিকেল টার্মিনোলজীতে ব্রড সেন্সে একে Hypertensive Emergency বলে।এই অবস্থায় এক ছোট ছেলের কাছে তার মাকে রেখে যাওয়া কাজের কথা না।প্রাথমিক ব্যবস্থা নিলাম, হাসপাতালে শিফট্ করার ব্যবস্থা করলাম। ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলে হাসিহাসি মুখ নিয়ে এরপর যখন অনুষ্ঠানে হাজির হলাম, তখন বউয়ের ঝাড়ি একটাও মাটিতে পড়ে নাই….
২….
অনুষ্ঠানের সাথে সাথে আরেকটা জিনিস আমি এড়িয়ে চলি, সেটা হলো ক্ষমতাধর লোক।’আপাত’ ক্ষমতাবান লোকদের কেনো আমি এড়িয়ে চলি, সে ব্যাপারে আমার নিজের একটা ফিলোসফি আছে….
মানুষের জন্ম হয় অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে, মৃত্যুর সময়টা সে থাকে আরো অসহায়।এ ধ্রুব সত্য জানার পরও যারা মাঝের সময়টায় ক্ষমতা প্রদর্শন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে, তাদের বিচারবুদ্ধি নিয়ে আমি শঙ্কিত।এদের সংস্পর্শে তাই আমি ডিসকমফোর্ট ফিল করি….
যাই হোক, মূল ঘটনায় আসি।প্রতি শুক্রবার আমি ঢাকার বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে যাই, ভোরে রওনা দেই, কাজেই বৃহস্পতিবার রাতটা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি।প্রায়ই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম, এমন সময় ক্লোজ এক ফ্রেন্ড ফোন দিলো, আঙ্কেল নাকি বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে রক্তারক্তি কান্ড ঘটিয়েছেন, আমি যাতে কষ্ট করে একটু তাদের বাসায় যাই।রাত তখন সাড়ে এগারোটা….
আঙ্কেল এডিশনাল সেক্রেটারি, তবে তথাকথিত ক্ষমতার অপব্যবহার তাকে কখনো করতে দেখি নাই। যেই আঙ্কেলের স্নেহ স্কুলজীবন থেকে সবসময় পেয়েছি, তিনি এক্সিডেন্ট ঘটিয়েছেন, এ অবস্থায় আমার বসে থাকা সাজে না। প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যাগ রেডী করছি, বউ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চোখে তাকিয়ে রইলো।রেডী হতে হতে বিড়বিড় করে বললামঃ” ছোটকালের বন্ধু, তার আব্বাকে না দেখতে যাই কেমন করে, বলো?”
চিকিৎসা দিয়ে যখন বাসায় ফিরি তখন রাত ১:৪৫। রাতে আর ঘুম হয়নি, ভোর ৫:৩০ টায় বাসা থেকে ঢাকার বাইরের চেম্বারের দিকে রওনা হলাম…..
৩….
রিসেন্ট ঘটনা বলি।সারাদিনের কাজ শেষে ইফতারী সামনে নিয়ে আজানের জন্য বসে আছি, মিনিট দুই পরেই আজান দিবে।পিপাসায় গলা শুকিয়ে আছে, আজান দিলেই ঢকঢক করে লিটার খানেক Foster Clark এর শরবত খাবো, সেই আশায় শুকনো জিহ্বা দিয়ে বারবার শুকনো ঠোঁট ভেজানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছি। আমি পেটুক মানুষ,হরেক রকম আইটেম সামনে নিয়ে চকচকে চোখে প্ল্যান করছি-কোনটার পর কোনটা খাবো। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো…
এক আঙ্কেল আর আন্টি হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকে পড়লেন।একটা রিপোর্ট আমার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বললেনঃ” দেখ তো বাবা, রিপোর্টে কি আছে? অবস্থা কি বেশী সিরিয়াস? আজই কি হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে?”…..
এ অবস্থায় যে কারো মেজাজ খারাপ হবার কথা।কিছুটা বয়স হয়েছে, অভিজ্ঞতা হয়েছে, কাজেই নিজেকে শান্ত করে নিলাম, মেজাজ ঠান্ডা রাখলাম। এরমধ্যে আজান দিলো।রিপোর্ট বুঝিয়ে দিলাম।উনারা অকস্মাৎ যেমন এসেছিলেন, তেমনি হঠাৎ করে চলে গেলেন। ইফতারী করে গেলেন না, রোযাদার লোককে ইফতারী করানো মিস করলাম, নিজেরই কিছুটা মন খারাপ হলো….
৪….
একটা সময় ছিলো, যখন এ ধরণের ঘটনায় খুব বিরক্ত হতাম, মেজাজ খারাপ হতো।এখন আর মেজাজ খারাপ হয় না। কেনো হয় না, সেটা বলি…
ইন্টার্ণী কমপ্লিট করার পর নানা মানুষ নানারকম শারীরিক ঝামেলা নিয়ে বাসায় আসা শুরু করলো, সকালে ঘুম ভাঙে পরিচিত-অপরিচিত লোকের নানারকম শারীরিক সমস্যার ফোনকলে।সবসময় লেখাপড়া নিয়ে থাকাতে সোশালী আইসোলেটেড জীবন নিয়ে বেড়ে উঠেছি, কাজেই এগুলো তখন আমার কাছে উটকো ঝামেলার মত লাগে। বাসায় বলে দিলাম, আমাকে কেউ খোঁজ করলে যাতে বলে আমি বাসায় নেই, কিংবা যাতে বলে আমি ঘুমিয়ে আছি, মোবাইলে ব্লকিং অপশনটাও চালু করলাম….
একদিনকার ঘটনা, অপরিচিত এক নাম্বার থেকে ফোন আসলো।পরিচয় দিলো আমার দেশের বাড়ী একজন লোক বলে।তার মায়ের কোনো একধরণের ক্যান্সার, ঢাকা মেডিকেল থেকে বলে দেয়া হয়েছে -‘সময় শেষ, বাড়ী নিয়া যান’।বাড়ী নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু লোকটি চান আমি যাতে একবার তার মা’কে দেখে আসি….
আমি তখন ইমোশনলেস স্মার্ট যুবক, বড় হয়েছি কাঠিন্যে ঘেরা ঢাকা শহরে।দেশের বাড়ী বলতে যা বোঝানো হয়, সেটা আসলে আমার জন্য খাটে না, আমার পিতার জন্য খাটতে পারে, তাঁর জীবনের একাংশ ঐ জায়গায় কেটেছে।যেখানে ঢাকা মেডিকেল রেড কার্ড দিয়ে দিয়েছে, যে লোককে কখনো দেখিনি, তার মায়ের জন্য ঢাকা থেকে দেশের বাড়ী যেতে হবে, এতোটা ইমোশনাল আমি তখন ছিলাম না। আমি স্মার্টলি মোবাইল নাম্বার ব্লক করলাম….
দিন পার হয়, ঘটনা ভুলে গেলাম। নিজের আত্মীয়ের কোনো এক আলো ঝলমলে অনুষ্ঠানে খাওয়া দাওয়ার পর ইতঃস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছি, সুযোগ বুঝে ঝট করে সটকে পড়বো, এই হলো প্ল্যান। এমন সময় এক লোক এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন।আমার দেশের বাড়ীর লোক পরিচয় দিয়ে তার মা কিভাবে ক্যান্সারে মারা গেলেন সেটা বললেন, আমাকে সে সময় ফোন করে বিরক্ত করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন।আমি বিব্রত বোধ করলাম, উনি আসলে সেই লোক যার মোবাইল নাম্বার আমি ব্লক লিস্টে রেখেছিলাম।যাবার আগে বললেন, তার মা মৃত্যুর আগে বারবার জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ “মোস্তফার পোলাডা কি আইছে? ওরে ক আমারে এট্টু দেইখা যাইতে….”
লোকটি অশ্রুসিক্ত অবস্থায় চলে গেলেন।আমি ঝিম মেরে বসে পড়লাম, চারপাশের গান-বাজনার শব্দ আমাকে আর স্পর্শ করলো না। আমার কানে খালি বাজছেঃ” মোস্তফার পোলাডা কি আইছে…”
কি অদ্ভুত!কি আশ্চর্য ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়েছে! যে বৃদ্ধাকে এই জীবনে কোনোদিন দেখিনি, সেই বৃদ্ধা তার জীবনের শেষ মুহূর্ত কাটিয়েছে আমার আগমনের পথ চেয়ে!আমাকে না দেখেও শুধুমাত্র আমার প্রোফেশনের কারণে এক মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধা তার হৃদয়ের গহীণ কোণে আমাকে ঠাঁই দিয়েছিলেন।আমি আমার ক্ষমতার মূল্যায়ন করতে পারি নাই। এ ছিলো আমার ব্যর্থতা….
সেই দিন থেকে আমি পারতপক্ষে চিকিৎসার ব্যাপারে কাউকে বিমুখ করি না। যে ক্ষমতা আমাদের চিকিৎসককে দেয়া হয়েছে, সেটার মূল্যায়ন আমাদেরই করতে হবে, সেই দায়দায়িত্বও আমাদের।হাজার বছর আগে কুনফুসিয়াসের একটি দর্শন এখন তাই সতত আমাকে আলোড়িত করেঃ “Wherever you go, go with all your heart… ”
৫…..
আমার এক পরিচিত জুনিয়র আই.ইউ.টি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এখন দেশের বাইরে যাবার চেষ্টায় আছে, ইউরোপিয়ান এক কান্ট্রিতে স্কলারশিপের ব্যবস্থাও হয়েছে।যাবার আগে তার ছোট ভাইকে নিয়ে আমার কাছে এলো। ছোট ভাইয়ের ইচ্ছা সে ডাক্তারী পড়বে, আমার কাছে নিয়ে আসার কারণ-আমি যাতে তার ছোট ভাইকে চিকিৎসক হবার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করি, এদেশে ডাক্তারদের অবস্থা কতটা খারাপ সেটা যেন আমি আমার মুখ থেকে তার ছোট ভাইকে শোনাই….
এরকম অবস্থায় আমি সাধারণত এদেশে ডাক্তারদের করুণ অবস্থা তুলে ধরি,চিকিৎসক যাতে না হয় তার জন্য একটার পর একটা ব্যারিয়ার ক্রিয়েট করি, বিশাল অলঙ্ঘনীয় মানসিক এক দেয়াল তৈরি করি।অধিকাংশই এ অদৃশ্য দেয়ালটা টপকাতে সাহস করে না।কিছু কিছু ছেলেমেয়ে এ দেয়ালটা টপকায়, আমি বুঝি এরা জাত সৈনিক।অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে অপার্থিব আনন্দ, সে আনন্দের ফল্গুধারা একমাত্র তখনই আমি তাদের সামনে উন্মোচন করি….
যেহেতু ছেলেটি চিকিৎসক হবার ব্যাপারে ডিটারমাইনড্, সেহেতু ছেলেটিকে চিকিৎসক হিসেবে নিজের ব্যক্তিগত একটার পর একটা আনন্দময় ঘটনা বলেছিলাম।ছেলেটি মুগ্ধ হয়ে আমার কথা শুনেছিলো।ছেলেটি বেশ চটপটে।যাবার আগে জিজ্ঞেস করলোঃ ‘এত কষ্ট, এত অবহেলা, এরপরও এই পেশার প্রতি আপনার এত ভালোবাসা কেনো? এই আনন্দগুলোই কি ভালোবাসার কারণ?’
আমি হো হো করে কিছুক্ষণ হেসেছিলাম।প্রশ্নের উত্তর দেইনি, কিছু প্রশ্নের উত্তর কখনো দিতে হয় না। সত্যিকার অর্থে মানুষকে ভালোবেসে এই পেশায় যদি সে এগিয়ে যায়, তবে একসময় সে নিজেই তার উত্তর খুঁজে পাবে। সসীম সত্ত্বার যে সৃষ্টি অসীমতাকে খুঁজেফেরে, তার কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করা আনন্দময়, পবিত্রময়। এই পথ চলাতেই আমার, আমাদের আনন্দ– চিকিৎসকদের জীবনের এই সিক্রেটটা আপাতত না হয় আমার কাছেই রাখি..
…………
ডা. জামান অ্যালেক্স এর ফেসবুক পাতা থেকে লেখাটি সংগৃহীত ।