আমার লাশটা অনেক কষ্ট পাচ্ছে। এখানে দম বন্ধ লাগছে আমার। এটা মনে হয় একটা ফ্রিজ। অনেক ঠান্ডা এখানে। ওদের নখর কাটার জায়গা গুলোর রক্ত জেলির মত জমে গেছে। আর কতক্ষন থাকবো আমি এখানে!
বাইরে বুক চাপরিয়ে কাঁদতে থাকা বৃদ্ধ লোকটা আমার বাবা। তার পাশে নিথর হয়ে চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়া আমার ভাই। দূরে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল কামড়িয়ে যেই মানুষটি তার বুক ফাটা আহাজারি আটকিয়ে রেখে অঝোরে চোখের পানি ফেলতেসেন তিনি আর কেও নন, আমার মা।
এবার হয়তো ওরা আমায় এখান থেকে বের করবে।
জানোয়ার গুলো আমাকে বাঁচতে দিলো না। যেই শরীর নিয়ে আমি সারাজীবন পর্দার সাথে চললাম, সেই শরীরে তাদের হায়েনার মত আচরগুলো দয়াকরে আমার বৃদ্ধ বাবা মা কে দেখাইও না তোমরা। বাঁচতে পারবেনা তারা।
আমার আহাজারি সেদিন কারো কানে পৌছেনি। চলন্ত বাসটি কেন জানি আল্লাহ আমার জন্য আরো বড় করে দিলেন না। তাহলে আরো কিছুক্ষণ ওই জানোয়ারগুলোর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতাম।
আমারও একটা স্বপ্ন ছিল একটা ছোট পরিবার হবে। কয়েকটি ছোট ছোট আঙ্গুল এসে আমার গালগুলো টেনে মা বলে ডেকে আদর করবে। হায়েনাগুলো সেই স্বপ্ন কেড়ে নিলো। বাসটি আরেকটু কেনো বড় হলো না!!!
হ্যালো বাবা, এইতো আর পাঁচ মিনিট লাগবে। আমি পৌছে গেছি। তুমি বেশি চিন্তা না করে তারাবির নামাজে যাও।
হ্যা এটাই শেষ কথা ছিল। সারাদিন ডিউটি শেষে আমার পরিবার বলতে এই রোগীগুলো আর আমার সাথে কাজ করা আমার ভাইবোন। কিন্তু আজ প্রথম রোজা। বাবাকে অনেক দেখেতে ইচ্ছা করতেছে। প্রথম রোজার সেহেরি আমি আজ উনাদের সাথেই করবো। মানুষগুলো যে কতবার করে ফোন দিলো আমায়। আমার পথপানে চেয়ে মা হয়তো দড়জা থেকেই নড়তে চাইছেনা। কিন্তু আমি জানি, এই অপেক্ষার প্রহর কখনো শেষ হবার নয়। বাসটি আর একটু কেনো বড় হলো না। ওরা আমাকে বাঁচতে দিলো না।
আমি জানি, আমার মতো আরো অনেক শাহিনুর আসবে, যাবে। আমাদের আহাজারি বাসের হর্নের শব্দের সাথে মিলিয়ে যাবে। রক্তের পুরনো দাগগুলো আবার জেলির মত হয়ে যাবে। দরজার এক পাশে দাড়িয়ে আমাদের মায়েরা আমদের জন্য আবার অপেক্ষা করতে থাকবে। এই অপেক্ষা অনন্ত কালের অপেক্ষা। তারাবি শেষ করে আসা বৃদ্ধ বাবা বাচ্চার মতো আবার তার স্নেহের মেয়েকে খুজবে বাসায়, ফিরেছে কিনা। কিন্তু আমরা আর ফিরবোনা।
আমার ভাই বোনেরা আজ আমার জন্য রাস্তায় নেমেছে। আমি কি সত্যিই ন্যায়বিচার পাবো? এই সমাজ কি আমার আর্তনাদ শুনবে? জানিনা। কারন আমরা একটি আবর্জনায় বসবাস করি। আর এই সমাজের প্রতিটি মানুষ সেই আবর্জনার কীট। এরা অনেক ক্ষুধার্ত। যেই ক্ষুধায় এই পিশাচ গুলো প্রতিদিন ভক্ষণ করে তার মা, বোন, স্ত্রী, মেয়ে কে।
আমি চাইনা আমার মত আর কোন শাহিনুরের মৃত্যুকে তোমরা তোমাদের পত্রিকার প্রথম পাতার উদাহরণ করে রাখো। হইতে চাই না কোন টকশো র আলোচনার বিষয়বস্তু। সমাজের কাছে আমি আমার মৃত্যুর ন্যায়বিচার চাই।
রাফিদ আদনান
ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ
প্ল্যাটফর্ম ফিচার রাইটার:
সামিউন ফাতীহা
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর