০৬ এপ্রিল, ২০২০
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। ধন্যবাদ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা আপনাকে। জাতির এহেন দুর্যোগকালীন সময়ে আপনার মূল্যবান এবং দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য জাতিকে সাহস যোগায়।
শুরুতেই আমি অত্যন্ত বিনীতভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বিগত বছরগুলোতে যে আন্তর্জাতিক পুরস্কারসমূহ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অর্জন করেছিলেন তা Health Sector এরই পরিশ্রমের ফসল।
অর্থনীতির খুঁটিনাটি আমি বুঝি না, প্রণোদনা আমার কাছে এক কঠিন শব্দ। ‘অনুপ্রেরণা’ চেয়েছিলাম; কিন্তু জাতীয় ভিলেন হওয়াতে সেই ধন্যবাদটুকুও কপালে জোটেনি।
২/৪ হাজার টাকার ঝুঁকি ভাতার আশায় কেউ বসে নেই। সামর্থ্য যাদের আছে তাঁরা সবাই মানসম্মত পিপিই কিনে ফেলেছেন (যদিও সেটা ডিসপোজেবল)। যাদের নাই তারা রেইনকোট/ ছাতার কাপড়েরটাকেই আঁকড়ে ধরেছেন (তাদেরও তো পরিবার আছে!)। কারণ, আমরা জানি করোনা প্রথমে আমাদেরকেই ছোঁবে (৫ জন ডাক্তার অলরেডী আক্রান্ত, স্বাস্থ্যকর্মীদের হিসাব বাদ দিলাম) তারপর বাঁকী সবাইকে ছুঁইয়ে দেবে। আমি যেহেতু জাতীয় ভিলেন তাই আমারটা আমি যোগাড় করে ফেলেছি। কারা PPE পরে সেল্ফি তুলছে এসব ভাবার সময় নেই।
ডাক্তার রা বরাবরই প্রচার বিমুখ, তারা বরাবর নিভৃতে দায়িত্ব পালন করে চলে। কত শত সহস্র ডাক্তার নিজের পরিবারকে ঝুঁকির মধ্যে রেখেই নিয়মিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে! কারণ, এরা জাতীয় ভিলেন।
ইতিহাসে প্রথমবারের মত সাংবাদিক, ভিজিটর, মেডিকেল-রিপ্রেজেন্টেটিভ ছাড়া ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কাজ চলছে। কোথাও এসব ফলাও করে বলা হয়না।
আমাদের কাজের সমালোচনার লোকের অভাব নেই। মিডিয়াগুলো ডাক্তারদের (সরি জাতীয় ভিলেনদের) নিয়ে নেগেটিভ নিউজ করেই চলেছে তাদের কাটতির জন্য। জনগণও একেকটা কোয়ারান্টাইন বিনোদন পেয়ে খুশী থাকছে। জাতির এমন ক্রান্তিলগ্নে আপনার ‘ধন্যবাদ’ পেয়েছে সাংবাদিকগণও। আমি/ আমরা কি জাতির কেউই না? ( হ্যাঁ, আমরা জাতীয় ভিলেন)
মাননীয় নেত্রী, বাংলাদেশের ডাক্তারদের মাথার উপর তো অনেক খড়্গ। কিন্তু যারা টেলিমেডিসিনের সুবাদে লেডী ডাক্তারদের (হোক সে মা’র বয়সী/ খালার বয়সী) সাথে অর্থহীন কুরুচিপূর্ন বাক্যালাপ চালাতে আসছে তাদের জন্য কেন কোনই আইন/শাস্তি নেই এদেশে? না কি তার প্রয়োগ হবে না আমরা জাতীয় ভিলেন বলে?
যারা সত্য গোপন করে সমাজকে করোনা ঝুঁকিতে ফেলছে তারা কোন আইনে মাফ পেয়ে যাচ্ছে? তাদের জন্যই তো হাসপাতালগুলো একের পর এক লকডাউন হয়ে যাচ্ছে, তাদের জন্যই ডাক্তার-নার্স সহ প্রচুর স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রতিদিন কোয়ারান্টাইনে যেতে হচ্ছে। জাতীয় ভিলেনদের বিরাট অংশ এভাবে চলে গেলে প্রণোদনা পাওয়া খাতের হিরোরা এসে কি হাসপাতাল চালাবে মাননীয় নেত্রী? আমাকে মাফ করবেন, আমি ভিলেন গ্রুপের সদস্য হওয়াতে মুখ ফসকে হয়ত বেফাঁস কিছু বলে ফেললাম।
খাল কেটে কুমির আনার মত করে হাজার হাজার করোনা প্লেনে করে এনে দেশে যারা ছড়িয়ে দিলো সেই মন্ত্রণালয় গুলোর কি বিচার হয়েছে মাননীয় নেত্রী?সালিশ-নালিশ সব আমাকে/আমাদেরকেই নিয়ে কেন? আমরা ‘ব্যক্তিগত’ চেম্বার (পড়ুন কসাইখানা) খোলা রাখছিনা কেন সেই ব্যাখ্যা আমাদের মুখ থেকে না শুনেই আপনার উজির-নাজির-দেওয়ান-কোতয়াল সবাই আংগুল তুলে শাসানো শুরু করলো। এই চেম্বার বন্ধ রেখে ৮০% ডাক্তার (পড়ুন ছোট ডাক্তার অথবা ‘সিম্পল’ এমবিবিএস) অর্থনৈতিক কষ্টে আছেন। এদের এই সেক্রিফাইজ সমাজের বৃহত্তর স্বার্থেই- এটা যারা বোঝাতে গেলেন শুরু হয়ে গেলো তাদেরকে গালাগালি। কারণ, আমরা জাতীয় ভিলেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মন্ডলীর মধ্যে কোনও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কি আছেন? (আমার অজ্ঞতার জন্য আমি দুঃখিত) থাকলে হয়ত পরিস্থিতি কম খারাপ হত। আমি আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর নিতে যাওয়াটা ভুল হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। Moreover আমি জাতীয় ভিলেন।
মাননীয় নেত্রী, আমাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।মনটা বড়ই ভারাক্রান্ত আজ। আমার মুক্তিযাদ্ধা বাবা বরাবরের মত আজকেও সকাল ন’টা থেকে টিভি সেটের সামনে বসে ছিলেন (কখন ১০ টা বাজবে!)।জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া আপনার ভাষণের কোনও খুঁটি-নাটি তিনি মিস করতে চান না; তাঁর ইনসুলিন নিতে ভুল হয় কিন্তু আপনার ভাষণের সময়-দিন-ক্ষণ তিনি ভোলেন না (কারণ, তিনি তাঁর ঘোলাটে চোখে এখনও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ দেখেন), আপনার ভাষণ শেষ হবার পর পর তিনি আমাকে ফোন দিয়েছিলেন, বাসা থেকে অনেকদূরে তাঁর মেয়ে কেমন আছে-শুধু এটুকু জানতে। বেশীক্ষণ কথা বলতে পারলেন না, গলাটা বেশী ভারী/আর্দ্র মনেহলো (হয়ত ঠান্ডা লেগেছে, হয়ত বা আমার শোনার ভুল)। আমি বুঝলাম – তাঁর দুশ্চিন্তার ঝুলিতে আরেকটি বিষয় যোগ হলো। আজকে আমার মনেহলো তিনিও নিজেকে জাতীয় ভিলেনের ‘বাবা’ বলে ভাবতে শুরু করেছেন।
লেখকঃ
ডা. কোহিনুর পারভীন
সহকারী অধ্যাপক,
ফার্মাকোলজি ও থেরাপিউটিক্স
রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ।