প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৪ জুন ২০২০, রবিবার
ডা. মালিহা পারভিন
সায়েন্টিফিক সেক্রেটারি,
বাংলাদেশ সোসাইটি অফ আল্ট্রাসনোগ্রাফি
বাংলাদেশ এখন করোনা মহামারি সংক্রমনের চতুর্থ ধাপে অর্থাৎ Community transmission বা সম্প্রদায় সংক্রমন পর্যায়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে ধরে নিতে হবে প্রতিটা রোগী কোভিড – ১৯ পজিটিভ। তাই সুরক্ষার ব্যাপারে সনোলজিস্ট, সংশ্লিষ্ট স্টাফ ও রোগীদের বিশেষ করে ভাবতে হবে। সামাজিক দুরত্ব, মাস্ক ব্যবহার, হাত ধোঁয়া – এই বিষয় গুলো মনে রেখে আল্ট্রাসনোগ্রাম সেবা দানে বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। যেমনঃ
১) আল্ট্রাসনোগ্রাম সাধারনত ছোট ও সীমিত ভেন্টিলেশন ব্যবস্থাযুক্ত ঘরে করা হয়। এখানে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা সব সময় সম্ভব হয়ে উঠে না। “তাই সংস্পর্শ ও ড্রপলেট সাবধানতা (contact precaution and droplet precaution) বিবেচনা করে সনোলজিস্টকে মাস্ক, গ্লাভস পরতে হবে, হাত ও প্রোব পরিস্কার রাখতে হবে”। ( ref : ISUOG safety statement, 31.3.2020)
২) আল্ট্রাসনোগ্রাম রুমে মেশিন বা ডাক্তার এবং রোগী বা পরীক্ষার বিছানার মাঝে প্লাস্টিক স্বচ্ছ পর্দা ( নীচে ছবি দেয়া আছে) দেয়া যেতে পারে। যেহেতু আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে গেলে সনোলজিস্টকে রোগির খুব কাছাকাছি আসতে হয়। তাই আমার অভিজ্ঞতায় এই রোগী ও ডাক্তারের মাঝে এই স্বচ্ছ পর্দা একটি চমৎকার ও সহজ সুরক্ষা ব্যবস্থা।
৩) পিপিই ( PPE : Personal protection equipment) বা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম বলতে আমরা বিশেষ করে নন মেডিকেল লোকজন স্পেস স্যুটের মতন উপরের পোশাকটা বুঝি। মাস্ক, গ্লাভস, এপ্রোন, ফেসশিল্ড, সবকিছুই পিপিই এর অংশ নিজের সুরক্ষা নিজেকেই নিতে হবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা ক’রে।
http://ref : www.sor.org/covid19
৪) মাস্ক : সাধারনভাবে মান সম্মত তিন স্তর বিশিষ্ট সার্জিকাল মাস্ক হওয়া বাঞ্ছিনীয়। লক্ষ্য রাখতে হবে মাস্কটি যাতে নাক ভাল করে ঢেকে রাখে, সামনের দিক যাতে হাতের সংস্পর্শে না আসে এবং খোলার সময় পেছন দিক থেকে সরিয়ে নির্ধারিত জায়গায় ফেলে দেয়া হয়।
৫) বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কাজ করতে হলে পরিপূর্ণ পিপিইর সাথে সংগতি রেখে N 95 বা FP 3 মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। হাসপাতালের যে এলাকায় কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসায় উচ্চচাপের অক্সিজেন (High flow humidified oxygen), এন আই ডি (Non invesive like BPap, C-pap) বা কৃত্রিম শ্বাস- প্রশ্বাস যন্ত্র (Mechanical ventilator) এসব ব্যবহার হচ্ছে (এরোসল জেনারেটিং প্রসেস – AGP) সে এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত। (Ref : Royal college of Radiologists and SoR)
৬) আইসিইউ বা আই টি এ এই এলাকার মধ্যে পরে। এ এলাকার কোনো রোগীর আল্ট্রাসনোগ্রাম নিতান্ত জরুরি না হলে না করাই ভাল। করতে হলে পরিপূর্ণ পিপিই সহ এন ৯৫ মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। সে ক্ষেত্রে পিপিই ‘ পরা ও খুলে ফেলা’ র( যা ডানিং ও ডাফিং নামে পরিচিত) বিধিবদ্ধ নিয়ম অনুসরন করতে হবে। (Ref: Royal college of Radiologists and SoR)
৭) করোনা ভাইরাসটি মাস্কের সামনের ভাগে ১ সপ্তাহ এবং পিছনে ৩ দিন বেঁচে থাকতে পারে। মাস্ক “পুন:ব্যবহার বা Extended use” এ ২৮ মে, ২০২০ এ বাংলাদেশ সরকারের দেয়া গাইড লাইন অনুসরন করা যেতে পারে। সেখানে বলা হয়েছে কাপড়ের মাস্ক ছাড়া কোনো মাস্ক ধোঁয়া যাবেনা । এন ৯৫ বা কে এন ৯৫ মাস্ক বা ক্ষেত্র বিশেষে সার্জিকাল মাস্ক যাই হউক না কেন সপ্তাহে ৭ দিন ব্যবহারের জন্য ৭টা মাস্ক রাখতে হবে। প্লাস্টিক পলিব্যাগে মাস্কগুলি পৃথকভাবে রেখে ব্যাগে শুক্র, শনি, ইত্যাদি দিনের নাম লিখে রাখলে সুবিধা হয়। নির্দিষ্ট দিনের মাস্ক নির্দিষ্ট দিন ব্যবহার করতে হবে। কাজ থেকে ফিরে আবার তা নির্দিষ্ট নাম লিখা ব্যাগে মুখ আটকে খোলামেলা স্থানে রেখে দিতে হবে, এভাবে দুইমাস মাস্কগুলি ব্যবহার করা যাবে।
৮) গাউন যা পিপিই বা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীঃ পিপিই বলতে ইদানিং সর্বত্র দেখতে পাওয়া স্পেস সুট জাতীয় আবরনকেই বোঝায় না। মাস্ক, গ্লাভস, গগলস, ফেসশিল্ড, গাউন সবই পিপিই এর অংশ।
যেখানে নিশ্চিত ভাবে সক্রিয় কোভিড রোগী থাকে অথবা পুর্বে উল্লেখিত ব্যবস্থায় ‘এরোসল জেনারেটিং প্রসেস’ ব্যবস্থায় সম্পুর্ন পিপিই পরা অত্যাবশ্যক।
৯) গ্লাভস : যেহেতু এখন প্রতি রোগী কোভিড-১৯ পজিটিভ হবার সম্ভাবনা আছে এবং সনোলজিস্টকে রোগীর শরিরের স্পর্শের কাছে আসতে হয়। তাই প্রতিটি রোগীর আল্ট্রাসনোগ্রাম করার জন্য পৃথক গ্লাভস ব্যবহারই বিজ্ঞান সম্মত ও নিরাপদ। আর এইসব সুরক্ষা সামগ্রীর পর্যাপ্ত সরবরাহে কর্তৃপক্ষ, সনোলজিস্ট, রোগী সবাইকে সম্মিলিত সময়োপযোগী ব্যবস্থাপনার মধ্যে আসতে হবে। কাজ শেষ হলে যথাযথ ভাবে গ্লাভস খুলে নির্দিষ্ট ঢাকনাযুক্ত বিনে ফেলে দিতে হবে।
১০) এখনকার পরিস্থিতিতে ঘরে থাকার বিকল্প নেই। বিশেষ ক’রে যে সকল সনোলজিস্ট বয়স্ক, গর্ভবতি বা কোনো জটিলতায় ভুগছেন (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডিনি সমস্যা, ক্যান্সার ইত্যাদি) তাদের এই করোনা মহামারিতে সেবা না দেয়াই উচিত। (ref : ISUOG safety statement, 2020).
১১) সীমিত মানে সম্ভব হলে কার্যদিবস সীমিত করা যেতে পারে তাতে সনোলজিস্টদের মানসিক চাপ কম থাকে।
i) এখন সীমিত সংখ্যাক রোগী দেখা সমীচীন।
ii) Scanning time বা রোগী পরীক্ষার সময়সীমা যতটা সম্ভব সীমিত করা উচিত। যা রোগী ও সনোলজিস্ট সবার জন্যই মঙ্গলজনক। (ref : ISUOG safety statement, .2020)
১২) ফেসশিল্ড পরাই উচিত। বাসায় ফিরে ভাল স্যানিটাইজার দিয়ে মুছে স্বচ্ছ প্যাকেটে খোলা জায়গায় রেখে দিতে হবে।
১৩) TVS – Transvaginsl Sonography : গবেষনায় করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি Vaginal secretion, Fecal matter, Semen -এ পাওয়া গেলেও তা থেকে সংক্রমনের জোরালো কোনো প্রমান এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। তবুও সুরক্ষার কথা ভেবে খুব জরুরি না হলে এ সময়ে TVS না করাই উচিত।
১৪) অন্যান্য :
i) হাঁচি, কাশি, জ্বর থাকলে সেই রোগিকে নির্দিষ্ট হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে হবে রিসেপশন ডেস্ক থেকে। প্রতিষ্ঠানের স্টাফগনকে করোনা মহামারিতে করণীয় বিষয়ে সচেতন করতে হবে।
ii) ওয়েটিং রুমে রোগী ও রোগীর লোক নির্দিষ্ট দুরত্ব মেনে বসবেন। খুব প্রয়োজন ছাড়া নিজেরা বা অন্য কারো সাথে কথা বলা যাবে না। কারণ কথার মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ায়।
iii) রোগীর সাথে কেউ আল্ট্রাসনোগ্রাম রুমে ঢুকতে পারবেন না। রোগির জুতা, ব্যাগ, বাড়তি কাপড় (বোরখা, হিজাব, ওড়না ইত্যাদি) নির্দিষ্ট স্থানে রেখে প্রবেশ করা উচিত। কিছু কিছু জায়গায় রোগীর জন্য ডিস্পোজেবল গাউন ও নতুন মাস্কের ব্যবস্থা থাকে। সময়ে হয়তো এ ব্যবস্থা সব জায়গায় চালু করা হবে।
iv) রোগীর মাস্ক ব্যবহার : করোনা ভাইরাস যেহেতু নাক ও মুখ দিয়ে শ্বাসনালী মাধ্যমে প্রবেশ করে ও ছড়ায় তাই মাস্ক ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। মহিলা রোগীদের হিজাব বা হাত মোজা কখনোই মাস্ক বা গ্লাভস বা হাত ধোয়ার বিকল্প নয়। হাত দিয়ে মাস্ক, মুখ, মাথা ইত্যাদি স্পর্শ করা যাবে না।
v) রোগীকে শোয়ানোর আগে মেশিন, প্রোব (লাগানো তার সহ), জেল এর বোতল, পরীক্ষার বিছানা ইত্যাদি ৭০% এলকোহল দিয়ে মুছে বিছানায় ক্লিনিক্যাল টিস্যু বিছাতে হবে।
vi) রোগী পরিক্ষার বিছানাটি আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন ও ডাক্তারের চেয়ার থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে রাখতে হবে। রোগীর শরীর বা কাপড় কোনোভাবেই যেন এতে স্পর্শ করতে না পারে। হাত যত্রতত্র ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে।
vii) রোগী শোয়ার পর তার মুখ বাম দিকে কাত করে তার দুই হাত মাথার দুইপাশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য নির্দেশনা দিতে হবে। বাকি প্রস্তুতি রোগীর বাম দিকে দাঁড়ানো যথাযথ সুরক্ষা নেয়া আল্ট্রাসনোগ্রাম রুমের সহকারী করবেন।
viii) জেল দেয়ার সময় জেলের বোতল যেন রোগীর শরীরকে স্পর্শ না করে ।
ix) পরীক্ষা হয়ে গেলে রোগী তার হাতের বাম দিক দিয়ে নেমে ঘরের সবার সাথে দুরত্ব রেখে বের হয়ে যাবেন।
x) আল্ট্রাসনোগ্রাম রুমের সব স্টাফদেরকে মাস্ক পরা অত্যাবশ্যক। নিজেদের মধ্যে ও রোগীর সাথে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে হবে। কাজের মাঝে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। করোনা সংক্রমন বিষয়ে জানতে হবে, বুঝতে হবে।
xi) কাজের জায়গায় যথাসম্ভব আঁটসাট কাপড় পরা উচিত। নখ বড় রাখা যাবে না। আংটি, চুড়ি, ঘড়ি, নাকফুল, কানের দুল না পরাই ভাল। মোবাইল ফোন, মানি ব্যাগ ইত্যাদি ছোট কাপড় বা পলিব্যাগে ভরে সাথে নিলে পরে পরিস্কার করতে সুবিধা হয়।
xii) আল্ট্রাসনোগ্রাম রুমের বাইরে ও ভিতরের দেয়ালে মাস্ক পরা, জুতা – ব্যাগ বাইরে রাখা, নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রাখা, হাঁচিকাশি, কথাবলা শিষ্টাচার ইত্যাদি বজায় রাখার নির্দেশনা সমুহ লিখে রাখতে হবে।
xiii) টেবিলে রাখা কলম স্টেপলার, কাগজ, জেমস ক্লিপ, এসি রিমোট ইত্যাদি প্রয়োজন ছাড়া না ধরাই ভাল।
করোনা মহামারিকালে কর্মক্ষেত্র এখন যুদ্ধক্ষেত্র। তাই ব্যক্তিগত সুরক্ষায় সামান্য অবহেলা, উদাসীনতা আপনাকে ও পরিবারকে ভয়াবহ বিপদের মুখে ফেলে দিতে পারে। তাই আসুন সুরক্ষিত থাকি, সচেতন থাকি ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করি ।