প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩০ জুন ২০২০, মঙ্গলবার
ডা. গোলাম মাহাদী হাসান
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ ২০১৩-১৪
ছবির ফুটফুটে বাচ্চাটির নাম নাদিয়া ইসলাম, মাত্র এক বছর বয়স যার। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের বাসিন্দা নাছির উদ্দিনের কন্যা সন্তান। যাকে হারিয়ে আজ শোকে মুহ্যমান পিতা, তার ভাষ্য অনুযায়ী – দুইদিন যাবত পাতলা পায়খানা, বমি ছিলো। তার পরের দিন থেকে শুরু হয় বুক ব্যথা! তখন নাদিয়া কে নিয়ে রাত ১ টায় উপস্থিত হয় নোয়াখালী সদর হাসপাতালে। এই দুইদিন যাবত বাচ্চাটার শরীর থেকে যেভাবে ডায়রিয়া আর বমির মাধ্যমে প্রচুর পানি বেরিয়ে গেছে, ইতোমধ্যেই বাচ্চাটা শকে আছে! সাথে বুক ব্যথা! এই বাচ্চাটির তাই জরুরী ভিত্তিতে শিশু আইসিইউ বিভাগের প্রয়োজন, যা কিনা নেই পুরো একটা জেলার কোথাও! তাই আরও দু’জন চিকিৎসকের পরামর্শ জানতে চান পিতা নাছির উদ্দিন। সে দু’জন চিকিৎসকও বাচ্চার অবস্থা দেখে দ্রুত আইসিইউ সাপোর্টের কথাই জানান!
বাচ্চাকে তাই ঢাকায় শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসেন তিনি। এখানে এসেই যত বিপত্তি! বাচ্চার ডায়রিয়া, বমি – যা বর্তমানে করোনা রোগের অন্যতম একটা লক্ষণ! সাথে নাকি আবার বুকেও ব্যথা! এই বাচ্চাটার যদি করোনা হয়ে থাকে, তবে তাকে শিশু হাসপাতালের আইসিইউ সাপোর্টে ভর্তি করিয়ে নিলে অন্যান্য আইসিইউ বেড গুলোয় থাকা নাজুক শিশুর মাঝেও সংক্রমণ হবে এই ভাইরাস! যে বাচ্চা গুলোর এমনিতেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রায় নাই হয়ে আইসিইউতে ভর্তি আছে – নতুন করে তাদের মাঝে করোনা ভাইরাস প্রবেশ করলে, সে বাচ্চা গুলোর জীবন বাঁচিয়ে রাখার ঝুঁকি কে নেবে?
চিকিৎসক? নাকি পিতা নাছির উদ্দিন? নাকি রাষ্ট্র? নাকিই বা করোনা ভাইরাস?
আর যদি, নাদিয়ার করোনা ভাইরাস হয়েছে ধরে নিয়ে, করোনা পজিটিভ এমন বাচ্চা গুলোর সাথে রেখে চিকিৎসা শুরু করা হয় নাদিয়া’র, তখন কি তার পিতা রাজি হবেন? জেনেশুনেই তিনি তার কন্যাকে করোনা রোগীর পাশের বেডে শুইয়ে রেখে চিকিৎসা করাতে দেবেন কি? এইক্ষেত্রে, যদি নাদিয়ার এই ডায়রিয়া টি করোনা ভাইরাসের জন্যে না হয়ে অন্য কোন ভাইরাস, যেমন রোটা ভাইরাসের জন্যে হয়? সেক্ষেত্রে নাদিয়া তো নতুন করে ফের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবে, আশেপাশের অন্যান্য করোনা পজিটিভ বাচ্চার থেকে! একসাথে দু’টো ভাইরাসের ধকল নিয়ে কি বেঁচে ফেরা চারটে খানে কথা?
এই করে করে ঢাকার প্রায় ৩০ টা হাসপাতালে (পিতা নাছির উদ্দিনের ভাষ্য অনুযায়ী) নাদিয়া কে নিয়ে ঘুরে কোথাও আইসিইউ সাপোর্টের ব্যবস্থা করতে পারছিলেন না অসহায় পিতা…সবার’ই একটা কথা, করোনা টেস্টের রিপোর্ট লাগবে, রিপোর্ট নেগেটিভ আসলে আমরা এখনই ভর্তি করিয়ে নিচ্ছি ওকে। এভাবে একসময় যখন আশা প্রায় ছেড়েই দিচ্ছিলেন, তখন তিনি খবর পেলেন ঢাকায় ইউনিহেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ব্যাপারে। যারা নাদিয়া কে ভর্তি করিয়ে নেয় আইসিইউতে। ইউনিহেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালের নিকট আমার ব্যক্তিগত ভাবে কিছু জিজ্ঞাসা ছিলো – ধরুন, নাদিয়া’র করোনা পজিটিভ, রিপোর্ট না থাকায় আপনারা জানেন না নিশ্চিত ভাবে। এই যে, এখন যে তাকে ভর্তি করিয়ে নিলেন আইসিইউতে, একই সময়ে আইসিইউতে ভর্তি থাকা ছোট শিশু গুলো, যাদের করোনা হয়নি – তাদের জীবন গুলো আপনারা কি বুঝে-শুনেই বাঁজিতে উঠাননি? ঝুঁকিতে ফেলেননি? আপনারা মানুষ হোন, অনুগ্রহ করে মানুষের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করবেন… তবে সেটা কখনোই একজনকে সেইফ করতে গিয়ে আরো দশ জনের জীবনকে মৃত্যুর রিস্কে ফেলে নয়। আর না হয়, আপনাদের কাছে অন্য কারো বাচ্চাই আর নিরাপদ নাহ!
নাদিয়া কে আইসিইউতে ভর্তি করানো হলো, হাত-পা গজ-ব্যান্ডেজে বেঁধে, মুখে মাস্ক দেয়া হলো, নাকে দেয়া হলো অক্সিজেনের পাইপ। কেন হাত/পা বেঁধে রাখা হয় আইসিইউতে থাকা যেকোনো রোগীকেই, জানেন? এই যে অবুঝ, অচেতন শিশুটি কিংবা বয়স্ক কোন রোগী, যাদের হাত না বাঁধলে তারা অচেতন অবস্থাতেই হাতের ক্যানুলা টেনে খুলে ফেলতে পারে, খুলে ফেলতে পারে নাকে লাগানো খাবারের নল কিংবা অক্সিজেনের পাইপ টাও! যা খুলে নিলে রোগীর অবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়বে তাৎক্ষণিক ভাবে! আর পা কেন বাঁধা হয়? ঐ যে প্রস্রাবের রাস্তায় প্রস্রাব করানোর জন্যে যে ক্যাথেটার টা লাগানো হয়, তা ঠিক রাখতেই। রোগীর সার্বিক কল্যাণের জন্যেই এই হাত-পা বেঁধে রাখার মতো আপাতদৃষ্টিতে অমানবিক কাজ গুলোই করতে হয়। এছাড়া আর ভিন্ন কোন উপায় নেই, তা বাংলাদেশ’ই হোক বা বিদেশ!
আজ পিতা নাছির উদ্দিনের স্থানে একটা বার নিজেকে ভেবে দেখুন তো, যে অসহায়, দরিদ্র মানুষ টা দু’টো মিনিট ফোনে কথা বললেও এতোদিন যাবত ভ্যাট দিয়ে আসছেন, বাজারে খরচা করতে গিয়েও যে মানুষটা ট্যাক্স দিয়েছেন শুধুমাত্র নিজের বিপদের সময় যেন অল্প খরচে একটু ভালো, উন্নত চিকিৎসা সেবা তিনি নিতে পারেন, যেন তার আদরের কন্যা নাদিয়া ছ’ বছর বয়সে একটা ভালো সরকারি প্রাইমারি স্কুলে অল্প খরচে পড়াশোনা শুরু করতে পারে… কিন্তু কি ঘটলো তার সাথে? নিজের জেলায় নোয়াখালীতে পেলো না এতটুকু আইসিইউ সাপোর্ট, ঢাকায় এসেও নিশ্চিত করতে পারলো না আইসিইউতে ভর্তি – শুধুমাত্র করোনা’র মতো প্রাণঘাতী জীবাণু বাসা বেঁধেছে কিনা তার কন্যার শরীরে, তা না জানায়! থাক তো আর মৃত্যুবরণ করা এই নিষ্পাপ শিশুর প্রাইমারি স্কুলে ভর্তির আলোচনা!
আচ্ছা, আপনারা কি জানেন বৃহত্তম নোয়াখালীর (লক্ষীপুর, ফেনী, নোয়াখালী) জনসংখ্যা কতো? ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী ছিল ৩৩ লাখেরও বেশি! আর এখন এই ২০২০ সালে এসে কত হবে সেই সংখ্যাটা? ৪০ লাখের ধারেকাছেই নিশ্চয়! এই ৪০ লাখ মানুষের জন্যে নোয়াখালী সদর হাসপাতালের ২৫০ শয্যা কি আদৌ যথেষ্ট? এই ২৫০ শয্যা পরিপূর্ণ হয়েও যখন রোগীর অত্যধিক চাপে রোগীদের টয়লেটের সাথে পর্যন্ত ফ্লোরিং করে থাকতে হয়, তখন কি এই অসুস্থ মানুষ গুলো আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে না? নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই কবেই! ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া একটা মেডিকেল, কিন্তু এখনো পর্যন্ত কেন মেডিকেলের নিজস্ব কোন হাসপাতাল নেই? কেন এখনো আরো কমছে কম ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল উদ্ভোধন করা যায়নি? কেমন করে সদর হাসপাতালের রোডের পাশে থাকা বহুতল বিশিষ্ট প্রাইভেট হাসপাতাল গুলো একচেটিয়া ভাবে বিজনেস করে যাচ্ছে? কেন নোয়াখালীতে এখনো আইসিইউ, সিসিইউ ইউনিট সহ নিউরোসার্জারীর অটি উদ্ভোধন করা যায়নি? নাকি এই জেলার মানুষ গুলোর কখনোই হার্ট অ্যাটাক হয়না? কখনোই লাইফ সাপোর্টের প্রয়োজন পড়ে না? কখনোই তাদের ব্রেইন টিউমার সহ হেড ইঞ্জুরি হয়না? নাকি শুধু নোয়াখালীর গণ্যমান্য, প্রভাবশালী মানুষ গুলোর ই এই সমস্যা গুলো হয়? এবং এয়ার-এম্বুলেন্সে করে তারা ঢাকায় আসে এই চিকিৎসা গুলো নিতে? এখানে থাকা ৪০ লাখ মানুষ, যারা প্রতিনিয়ত প্রতিটি খরচায় ভ্যাট দিয়ে যাচ্ছে, কেন তাদের জন্যে এখনো পর্যন্ত উন্নত চিকিৎসার সুযোগ করে দেয়া যায়নি?
এই মানুষ গুলো এতোটাই বোকা, তারা কখনো এই বিষয়গুলো ভাবেনি হয়তো! ইট, বালি, সিমেন্ট, রড ছাড়া রাজমিস্ত্রী কে বাড়ি বানাতে দেয়া যেই কথা, রোগীর রোগ নির্ণয়ের জন্যে জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি (এন্ডস্কোপি, কোলনস্কপি সহ অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্ট) ব্যতীত, চিকিৎসার জন্যে আইসিইউ, সিসিইউ, নিউরোসার্জারী অটি ব্যতীত চিকিৎসক কে চিকিৎসা করতে বাধ্য করাও একই বিষয়! মানুষ গুলো এখনো পর্যন্ত তাদের সুস্থ, সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তার লক্ষ্যে একটা আধুনিকায়ন হাসপাতালের দাবি তুলতে পারেনি জোড়ালো ভাবে, আর তারাই কিনা অনলাইন মিডিয়ায় এসে “নোয়াখালী বিভাগ চাই” আন্দোলনের ঝড় তুলছে!
আর এটা আমাদের সামগ্রিক দুর্ভাগ্য যে, আমাদের এখনো করোনা টেস্টের রিপোর্টের জন্যে ২-৭ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়! এই সময়ের মাঝে করোনার লক্ষণ নিয়ে আসা রোগীদের কে হাসপাতালে ভর্তি করে ডাক্তারা না পারছে, করোনা পজিটিভ রোগীর সাথে রেখে চিকিৎসা দিতে, আর না পারছে, করোনা হয়নি এমন রোগীর সাথে রেখে সেবা নিশ্চিত করতে! কেন আমরা এখনো এই ২-৭ দিন সময়কে কমিয়ে ১-২ ঘন্টার ভেতর নিয়ে আসতে পারলাম না? কেন আমরা রোগীর রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে এখনো এখনো করোনা পজিটিভ/নেগেটিভ নির্ধারণ করতে পারছি না? এভাবে আর কত সাধারণ মানুষ, কত চিকিৎসক তাদের বাবা-মা কে নিয়ে হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বিশৃঙ্খল সিস্টেমের বলি হবে? কত প্রাণ এভাবে হারাবে আর?
তাই আসুন, মাঝে মাঝে মিঠু সিন্ডিকেটের পাশাপাশি স্থানীয় সিন্ডিকেট নিয়েও কথা বলি, পার্ক বেড়াতে যাওয়া প্রেমিক-প্রেমিকাকে জব্দ করায় এক্সট্রা সময় ব্যয় না করে এই সিন্ডিকেট গুলোকে গ্রেফতারে কিছু সময় ব্যয় করি। যে শহরের আলো-বাতাসে দীর্ঘ ১৫ টা বছর আমি জীবন কাটিয়েছি, সেই শহরের মানুষ গুলো উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগের অভাবে মারা যাচ্ছে – এটা কল্পনা করতেও আমার বুক ফেটে যায়, চিকিৎসকদের নিয়ে আপনাদের একটির পর একটি অভিযোগ শুনে আমি বরাবরই আহত হই! আসুন, অভিযোগ গুলো শোনাই উপযুক্ত স্থানে, উপযুক্ত মানুষে…!
আল্লাহ আপনাদের দীর্ঘজীবি করুন।