রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪
ফুসফুসের ক্যান্সার সারা বিশ্বেই একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে এর প্রভাব আরও তীব্র। ইংল্যান্ডে বসবাসরত বাংলাদেশি পুরুষদের মধ্যে এই ক্যানসারের উচ্চ হার আমাদের জন্য একটি উদ্বেগজনক বাস্তবতা। তাদের জীবনধারা, সাংস্কৃতিক প্রভাব, এবং স্বাস্থ্যসেবার অভিগম্যতা।
ইংল্যান্ডে বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রেক্ষাপট
ইংল্যান্ডে প্রায় ৪ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করেন, যাদের বেশিরভাগই লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস, নিউহ্যাম, এবং বার্মিংহামের মতো এলাকাগুলোতে কেন্দ্রীভূত। অধিকাংশ বাংলাদেশি পরিবার দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মে স্থানান্তরিত হলেও তাদের সংস্কৃতি এবং খাদ্যাভ্যাসে বাংলাদেশের ছোঁয়া রয়েছে।
যদিও এই অভিবাসী সম্প্রদায় অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তাদের স্বাস্থ্য সমস্যা বিশেষত উদ্বেগজনক। ফুসফুসের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এই চিত্র আরও গুরুতর। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশি পুরুষদের ধূমপান ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার, স্বাস্থ্যসেবা থেকে দূরত্ব এবং সচেতনতার অভাব তাদের এই ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণ
১. ধূমপানের প্রভাব
বাংলাদেশি পুরুষদের মধ্যে ধূমপানের হার অত্যন্ত বেশি। ধূমপানের কারণে ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি প্রায় ২৫ গুণ বৃদ্ধি পায়। তামাকজাত পণ্য যেমন পান, জর্দা বা গুলের ব্যবহারও একইভাবে ক্ষতিকারক। এ ধরনের অভ্যাস বিশেষত প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত
২. তামাক ও পান সংস্কৃতি
বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে তামাক মিশ্রিত পান খাওয়ার প্রচলন বহু পুরোনো। এটি শুধু একটি অভ্যাস নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এক পরিচায়ক। অথচ তামাকের সঙ্গে নিয়মিত সংস্পর্শ ধীরে ধীরে ফুসফুসের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
৩. পরিবেশগত কারণ
ইংল্যান্ডের বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের অনেকেই শহরের দূষিত এলাকায় বসবাস করেন। যানবাহনের ধোঁয়া, কর্মস্থলের বায়ু দূষণ এবং ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর।
৪. সচেতনতার অভাব
বাংলাদেশি পুরুষরা সাধারণত স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতি উদাসীন। ছোটখাটো শ্বাসকষ্ট বা কাশি দেখা দিলেও তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে চান না। ফলে ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হয় না।
ফুসফুসের ক্যান্সারের সামাজিক প্রভাব
১. অর্থনৈতিক চাপ
একজন অভিবাসী কর্মীর জন্য ক্যানসারের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অনেক বাংলাদেশি পরিবার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয়, ফলে চিকিৎসার ব্যয়ভার তাদের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে।
২. পারিবারিক ও মানসিক প্রভাব
একজন পুরুষ পরিবারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার অসুস্থতা পুরো পরিবারকে সামাজিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে।
৩. কমিউনিটির উপর প্রভাব
বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে এই রোগের ক্রমবর্ধমান হার সমাজে এক ধরনের ভীতি তৈরি করছে। তরুণ প্রজন্মও এতে উদ্বিগ্ন।
সমাধান এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
১. সচেতনতা বৃদ্ধি
ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য সচেতনতা খুবই জরুরি। স্কুল, মসজিদ এবং কমিউনিটি সেন্টারে নিয়মিত সচেতনতামূলক কর্মশালা আয়োজন করা যেতে পারে। এতে তামাকের ক্ষতিকর দিক এবং ধূমপান ছাড়ার উপায় নিয়ে আলোচনা করা উচিত।
২. স্বাস্থ্য পরীক্ষা সহজলভ্য করা
কমিউনিটির জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং পরামর্শদান কর্মসূচি চালু করা প্রয়োজন। NHS (National Health Service) এর মাধ্যমে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা যেতে পারে।
৩. ধূমপান বিরোধী প্রচারণা
ধূমপান ছাড়ার জন্য কাউন্সেলিং সেশন এবং নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি প্রোগ্রাম চালু করা দরকার।
৪. ক্রীড়া ও শারীরিক কার্যক্রম
ক্রীড়া ও শারীরিক কার্যক্রম ফুসফুসকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। বাংলাদেশি কমিউনিটিতে এ ধরনের কার্যক্রম উৎসাহিত করা প্রয়োজন।
সরকার ও কমিউনিটির ভূমিকা
ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যকার সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১. স্থানীয় উদ্যোগ
বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতা এবং মসজিদের ইমামরা যদি তামাকের বিরুদ্ধে প্রচারণায় অংশ নেন, তবে এর প্রভাব অনেক বেশি হতে পারে।
২. বাংলাদেশি সংস্কৃতির সাথে মানানসই কর্মসূচি
বাংলাদেশি সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় বিশ্বাস মাথায় রেখে স্বাস্থ্য কর্মসূচি চালানো গেলে তাতে অংশগ্রহণ বাড়বে।
উপসংহার
ইংল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশি পুরুষদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সারের উচ্চ হার শুধুই একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক সংকটও বটে। তবে সময়োপযোগী ব্যবস্থা নিলে এটি প্রতিরোধ সম্ভব। সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এবং জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলা করা যেতে পারে। আমাদের প্রয়োজন সরকার, স্বাস্থ্য সংস্থা এবং কমিউনিটির সম্মিলিত প্রচেষ্টা। কারণ প্রতিটি জীবন মূল্যবান, এবং এই রোগ প্রতিরোধযোগ্য।
নাম: এস. এম. এম. মুসাব্বির উদ্দিন
ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ