ইচ্ছা পূরণ | ছোটগল্প

1

হারু কাকা, পুরো নাম হারুনোর রশীদ। আমাদের গাঁয়ের মাঝি। আমরা হারু কাকা বলি। যেবার আমি মেডিকেলে চান্স পেলাম, সেবার পুরো গ্রাম উৎসবে মেতে উঠেছিল। সবাই বাড়িতে এসে আমাকে দেখে গেলো, দোয়া করে গেলো। সন্ধ্যা হয় হয়, তবুও হারু কাকা উঠানের এক পাশে বসে থাকলো। শেষে বাবা বললো, “কি রে হারু, বাড়ি যাবি না? আজ তো সারাদিন এ বাড়িতেই বসে থাকলি। ঘাটের লোকগুলো তোকে না পেয়ে বিপদে পড়েছে নিশ্চয়?” হারু কাকা বললো, “মাস্টার মশাই, আমি বেঁচে না থাকলি কি আর গিরামের লোকের চলবেন না? অনেকক্ষণ ধইরে একটা কতা কতি চাচ্ছিলাম। ভয় পায়ে কতি পাততিছিনে। যদি অভয় দেন, তালি কই।” বাবা বললো, “তোরা আবার কবে থেকে আমাকে ভয় পাওয়া শুরু করলি? যা বলবি, বলে ফেল।” হারু কাকা খুব সংকোচের সাথে বললো, “আমার খুব শখ নীতু মারে একটু বাসায় নিয়ে খাওয়াবানে। তা যদি অনুমতি দিতেন, তালি বাড়িতি নিয়ে একটু ডাল ভাত খাওয়াবানে। আর নীতু মা আমার ছেইলেডারে একটু দুয়া কইরে আসবেনে।” আমি মাকে বললাম, আমি যাবো না। আমি কি মুরুব্বী হয়ে গেছি যে, উনার ছেলেকে আমি দোয়া করতে যাবো? কিন্তু বাবা বললো, “যাও মা, কিছু কিছু সময়ে মানুষের ইচ্ছা পূরণ করতে হয়।”

আমি মা কে সাথে নিয়ে গেলাম হারু কাকার বাসায়। যেয়ে দেখি, বিশাল আয়োজন। বাড়ির মুরগী জবাই করেছে। হাটের থেকে মাছ কিনে নিয়ে আসছে। আর খেতের শাক। আমি অবাক হলাম। হারু কাকা তার সামর্থ্যের থেকে অনেক বেশি করেছে আমার জন্য। খাওয়া দাওয়া শেষে হারু কাকা বললো, “মারে, আমার খুব ইচ্ছে, আমার ছেইলে আসিফ রে তুমার মত ডাক্তার বানাবো। তুমি যদি একটু ওর মাথায় হাত দিয়ে দুয়া কইরে দেও, তালি ও ডাক্তার হতি পারবেনে।” আমি উনার কথা শুনে অবাক হলাম। মনে মনে একটু হাসি ও পেলো। গ্রামের লোকগুলো কত সহজ সরল হয়! কাকা ধরে নিয়েছে, আমি মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেই উনার ছেলে ডাক্তার হয়ে যাবে! আমি মার দিকে তাকালাম। মা ইশারা করলো, আমি যেন হারু কাকার ইচ্ছা পূরণ করি। আমি এবার আসিফের দিকে তাকালাম। বয়স আনুমানিক দুই তিন বছর হবে। ছেড়া একটা গেঞ্জি পরে আছে। প্যান্ট পরে নাই। নাক দিয়ে পানি ঝরছে । মাঝে মাঝেই হাত দিয়ে নাক পরিস্কার করে গেঞ্জিতে মুছছে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আমাকে দেখছে। আমি একটু ইতস্তত করে গেলাম ওর কাছে। ওর মাথায় হাত রেখে মনে মনে বললাম, “আল্লাহ, তুমি ওর বাবার ইচ্ছা পূরণ করো। ওকে ডাক্তার বানিয়ে দিও।”

যতবার ছুটিতে বাড়িতে যেতাম, ততবার হারু কাকা আমার কাছ থেকে নৌকা পারাপারের টাকা নিত না। জোর করলে বলতো, “তুমার কাছ থেকে টাকা নিতি পারি? তুমার দুয়াই আমার ছেইলেডা ডাক্তার যদি হতি পারে, তালি এরকম কত টাকা আয় করতি পারবেনে।” সন্ধ্যার সময় ছেলেকে নিয়ে যথারীতি আমাদের বাড়িতে হাজির হতো। সাথে পেয়ারা, আম, জামরুল যখন যেটা পারতো নিয়ে আসতো। আমার খুব মজা লাগতো। প্রতিবার ওর মাথায় হাত দিয়ে আমাকে দোয়া করতে হতো, আল্লাহ ওর বাবার ইচ্ছা যেন পূরণ হয়। ও যেন বড় হয়ে ডাক্তার হয়।

আমার MBBS পাশের পরে বিয়ে হয়ে গেলো। বাবা মাও ঢাকায় ভাইয়ার বাড়িতে থাকা আরম্ভ করলো। গ্রামে যাওয়া হয়নি দীর্ঘদিন। আমি সিলেটে থাকি। মেডিকেল কলেজে পোস্টিং। বাচ্চা কাচ্চা, সংসার, অফিস, পড়াশুনা নিয়ে নাজেহাল অবস্থা । নিজেকে সারাক্ষণ বকা দিই, কেন ডাক্তার হতে গিয়েছিলাম? এর চেয়ে শুধু housewife হতাম, তাহলে ভালো হতো। প্রতিবেশীর সাথে শাড়ি, গহনা, মুভি, সিরিয়াল নিয়ে খোশ গল্প করতে পারতাম। মাঝে মাঝে পার্টি হতো। মাঝে মাঝে বিদেশে বেড়াতে যেতাম। বিদেশ থেকে নানারকম শপিং করে ভাবীদের চমকে দিতাম। আহা! কি সুন্দর জীবন আমার হতে পারতো! মনে মনে ডাক্তারি জীবনের মুণ্ডপাত করি। আর আমার স্বামী কে মাঝে মাঝেই ধমকি ধামকি দিই, চাকরি ছেড়ে দেবো বলে। ও বলে, চাকরি ছেড়ে দিলে তো আমারই সবচেয়ে ভালো। রান্না বান্না করে , সুন্দর করে সাজুগুজু করে পথ চেয়ে বসে থাকবা, এরচেয়ে সুখ আর কি হতে পারে? আমি রান্না বান্না করার ভয়ে চাকরি ছাড়ি না ।

আজ অফিসে খুব ব্যস্ত ছিলাম। ওয়ার্ড এর এক মাসি এসে বললো, এক লোক তার ছেলে কে নিয়ে সকাল থেকে বসে আছে, আপনার সাথে দেখা করবে তাই। আপনি ব্যস্ত ছিলেন দেখে বলিনি। বললাম, নিয়ে আসো। ঘরে ঢুকলো হারু কাকা। অনেক বছর দেখা হয়নি কাকার সাথে। চেহারাটা অনেক পাল্টে গেছে। তবু চেনা যায়। চিনতে পারিনি, উনার ছেলে আসিফ কে। বেশ বড় হয়ে গেছে। শান্ত শিষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। পরনে কম দামী, কিন্তু রুচি সম্মত ড্রেস। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম (পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার মত মুরুব্বী এখনো হইনি মনে হয়)। হারু কাকা মাটির হাড়িতে করে মিষ্টি এনেছে আমার জন্য। বললো, “মা গো অনেক কষ্ট কইরে তুমার ঠিকানা জুগাড় করিছি। আমার ছেইলে আসিফ ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পায়েছে। কাল ভর্তি করতি নিয়ে যাবো। যাওয়ার আগে তুমার দুয়া না নিলি হয়? তুমি ওর মাথায় হাত দিয়ে দুয়া করলি ও তুমার মত ডাক্তার হতি পারবেনে।”

ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হকচকিয়ে গেলাম। ছেলেটাকে কাছে নিয়ে বসালাম। চোখে কেন জানি পানি চলে এলো। কাঁপা কাঁপা হাতে ওর মাথায় হাত রাখলাম। মনে মনে বললাম, “হে আল্লাহ, আমি জীবনে অনেক কিছুই করতে পারিনি। নিজের ইচ্ছা, বাবার ইচ্ছা, কারো ইচ্ছাই পূরণ করতে পারিনি। কিন্তু এই ছেলে যেন তার বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে পারে। তার বাবার স্বপ্ন দেখার যে সীমা আছে, সে যেন সেই সীমাকেও ছাড়িয়ে যায়।”

জানি না, আমার মত মানুষের দোয়া কাজে লাগবে কিনা। কিন্তু বহুদিন পরে আজ আমার মন অসম্ভব ভালো আছে। মনে মনে ভাবছি, বাসায় যেয়ে আমার ছেলে কে গল্প শোনাবো, কিভাবে এক বাবার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে!

ডা. সুমনা তনু শিলা
৩৭ তম ব্যাচ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ

প্ল্যাটফর্ম ফিচার:
সামিউন ফাতীহা
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর

Platform

One thought on “ইচ্ছা পূরণ | ছোটগল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অত্যাধুনিক ২৪ঘন্টার জরুরী বিভাগের উদ্বোধন

Sat Mar 2 , 2019
রংপুরের সিভিল সার্জন ডাঃ আবু মোঃ জাকিরুল ইসলাম লেলিন, আজ শনিবার দুপুর ১২টায় রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ডক্টরস কমিউনিটি হসপিটাল) এ অত্যাধুনিক ৬বেডের ইমার্জেন্সি ক্রিটিকাল ম্যানেজমেন্ট সুবিধা সম্বলিত জরুরী বিভাগের উদ্বোধন করেন। যেখানে ২৪ঘন্টা জরুরী সেবা প্রদান করা হবে। উদ্বোধনী অনুষ্টানে তিনি বলেন,বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রংপুরেও এখন বিশ্ব […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo