ইদ ও বিশেষ ডিউটি: ব্যক্তিগত স্মৃতি

সরকারি চাকরিজীবনের প্রথম দিকে, যখন আমি মেডিকেল অফিসার, চাকরি করছি সীমান্তপারের এক জেলায়, ইদের আগে আগে শুনতে পেলাম যারা মুসলিম নন, এমন চিকিৎসকদের জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ইদের বিশেষ ডিউটি করতে হবে। কিছুটা অস্বস্তি আর ভয়ও ছিলো। তবে শেষ অবধি অন্য উপজেলায় যেতে হয়নি, কর্মস্থলেই ডিউটি করেছিলাম।
এমনটা বারবার হয়নি। পরবর্তী বছরগুলিতে প্রায়ই পার্শ্ববর্তী উপজেলায় যেতে হয়েছে ইদের সময়, কোথাও ইদের সময়েও অসম্ভব রোগীর চাপ, ইনডোরের মেঝেতেও রোগীরা ভর্তি। কোথাওবা খাঁ খাঁ হাসপাতাল, দুই দিনে কেবল দুটি রোগী ভর্তি করেছি, এমনও হয়েছে।
শেষবার, চার বছর আগে, আমি তখন ব্যাক পেইনের রোগী, আমার ডিউটি পড়লো এমন এক উপজেলায়, নিজ কর্মস্থল থেকে যেখানে যেতে বাস, ট্রলার, হিউম্যান হলার, রিক্সা সব কিছুতে আরোহণ করতেই হবে। ঢাকায় আমার চিকিৎসা করছিলেন যিনি, তিনি আমাকে যতটা সম্ভব ঝাঁকুনি এড়িয়ে চলাফেরার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাই ধারেকাছের উপজেলায় যেন ইদের ডিউটি দেয়া হয়, এই আবেদন নিয়ে বাসে করেই জেলায় গেলাম। তখনও আমার হাতে ক্রাচ, কিন্তু সিভিল সার্জন মহোদয়ের অন্তর দ্রবীভূত হলো না। এমন নয় যে ডিউটি সামান্য পুনর্বিন্যাস করে আমাকে ঐ দুর্গম এলাকায় যাওয়া থেকে রক্ষা করা যেতো না, আমিও একেবারে ছুটি নয়, ডিউটি করতেই চাইছিলাম, তারপরও ঠিক ঐ দুর্গম স্থানে না গেলে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে- জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের অভিভাবকের কাছে এই বাণী শুনে ফিরে এলাম।
পরের কাহিনী কহতব্য নয়। ভোর ছ টায় রওনা দিয়ে পূর্বোল্লিখত বিচিত্র সব উপায়ে রাত প্রায় আটটায় পৌঁছলাম তো সেই উপজেলায়; আর এই যাত্রাই নির্ধারণ করে দিলো আমার বাকি জীবনের গতিপথ।
পুরো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শুধু নয়, পুরো উপজেলায় আর কোনো এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন না ইদের তিনটি দিন, এবং হাসপাতালেও অন্তত সত্তরটি রোগী ভর্তি। বিশ্রাম হয়নি, দুবেলা রাউন্ড দিয়ে ব্যাক পেইনে জেগে বসে ছিলাম তিনটি রাত, তারপর ডিউটি হস্তান্তর করে পথের মানুষদের সহায়তায় ঢাকায় এসে পৌঁছলাম। এই সহায়তাটি দরকার হয়েছিলো, কারণ আমার সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাই ছিলো না তখন। ঢাকায় অপারেশন হলো পরদিন, নার্ভরুট কাটা পড়লো সেই অপারেশনে, এখন আমি চিরস্থায়ী ফুটড্রপের রোগী।

ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ তো হলো। কথা আর বাড়াবো না। দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই একটি বিষয়ে। ইদের ছুটিতে আমি বিভিন্ন উপজেলায় বিশেষ ডিউটি করেছি, ঐ দিনগুলিতে কাজের চাপ বাড়ে, সবসময় তটস্থ থাকতে হয়, খাওয়াদাওয়ার ঠিক থাকে না- এসব কিছুই নয়৷ মাত্র তো ক’টা দিন। আমি প্রতিবার বিস্মিত ও ব্যথিত হয়েছি- আরএমও কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, যারা নিজেরাও ছুটিতে আছেন, কখনোই ফোন করে জানতে চাননি হাসপাতাল সম্পর্কে, ডিউটি ডাক্তারের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে। এগুলো তো আসলে শেখানোর ব্যাপার নয়। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের পাঠ্যসূচিতেও এটি নেই। এটি আসলে ভেতর থেকে আসতে হয়।
ইদের ছুটিতে যারা মুসলিম নন, তারা আন্তরিকতা দিয়েই কাজ করেন, এজন্য প্রশংসা করতে হবে- ব্যাপারটি এমন নয়। কারণ আমার ভাইবোনের ইদ যাতে নির্বিঘ্নে কাটে, সেজন্য আমি ডিউটি করছি, এ তো আমার কর্তব্য।
যদি কোনো আরএমও, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অথবা সিভিল সার্জন মহোদয়ের চোখে এ লেখা পড়ে, তাদের কাছে অনুরোধ- বিশেষ ডিউটি যিনি করছেন, তাকে অন্তত ডিউটি চলাকালীন একটিবার ফোন করুন, কেবল এই সৌজন্যটুকুতেই ডিউটি আর অতটা অসহনীয় মনে হবে না ডিউটিরত চিকিৎসকের কাছে- বিশ্বাস করুন!

ডা. অনির্বাণ সরকার
৩৮ ব্যাচ, সিওমেক

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বি: যে ক্ষতি অপূরণীয়

Sun Jun 9 , 2019
ছবিতে যাকে দেখছেন তিনি পাবনা জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। এরপর ভর্তি হন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। সময়টা ১৯৫৫ সাল, তখন বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিমের বড় ভাইয়েরা পূর্বের বাঙ্গালদের মানুষই মনে করে না, সফট কর্নার তো দূরের কথা। এসব বিষদৃষ্টি দমিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টাকে মধ্যমা […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo