জরুরী স্বাস্থ্যসেবা বা ইমার্জেন্সী মেডিকেল কেয়ার হল একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশে এই সিস্টেমটি বলতে গেলে প্রায় অবহেলিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষনায় দেখা গিয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মূলত প্রাইমারী কেয়ার ফ্যাসিলিটিতেই প্রাইমারী কেয়ারের মত করে ইমার্জেন্সী কেয়ার চলছে এবং যথাযথ ইমার্জেন্সী কেয়ার কোথাও সঠিকভাবে পাচ্ছেনা রোগীরা।
ইমার্জেন্সী মেডিকেল কেয়ার এর ৩ টি মূল কম্পোনেন্ট :
১. কমিউনিটিতে সেবা
২. পরিবহনকালীন সেবা
৩. স্বাস্থ্য স্থাপনায় সেবা
কমিউনিটিতে সেবা:
যে কোন ইমার্জেন্সী শুরু হয় কোথায়? কমিউনিটিতে বা সমাজে, যার অংশ হল ঘর-স্কুল-হাটবাজার-ইত্যাদি পারিপার্শ্বিক যেকোন সামাজিক স্থান। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক রেসপন্ডার বা ব্যবস্থা গ্রহনকারী হল কিন্তু সাধারন মানুষ। কিন্তু কি করছে তারা? প্রথমত, নিজেরা প্যানিক হয়ে যাচ্ছে, কারন তাদের এইসব বিষয় সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই! কখনো কখনো ফার্মাসী দোকানীকে ডেকে নিয়ে আসছে বাড়িতে, তারা কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছে, সেই সাথে কুসংস্কার তো আছেই, অনেক ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র কুসংস্কার জনিত কারনেই ঘরে বা রাস্তায়ই পড়ে থেকে অনেক রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।
তার মানে, যেকোন ইমার্জেন্সীতে কমিউনিটিতে বা সামাজিক ব্যবস্থায় আমাদের রোগীরা ব্যাসিক্যালি কোন সেবা তো পায়ই না, বরং নষ্ট করে মূল্যবান সময়, যা রোগীর মৃত্যুর কারন।
পরিবহনকালীন সেবা:
এটাও আমাদের দেশে খুব একটা পাওয়া যায় না। সবজায়গায় নেই ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিবহনও পাওয়া যায় না, পাওয়া গেলেও নেই ন্যুনতম পরিবহনকালীন সেবার সুযোগ সুবিধা। শহরগুলোতে যা ও এম্বুলেন্স পাওয়া যায়, থাকে শুধু নামে মাত্র একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার; সাথে থাকেনা অন্য কোন সুযোগ সুবিধা কিংবা ন্যুনতম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তো বাদই দিলাম, সাধারন একজন স্বাস্থ্যকর্মীও থাকে না। কার্ডিয়াক বা আই সি ইউ এম্বুলেন্স নামে যাও পাওয়া যায়, তার নেই স্ট্যান্ডার্ড, তার ওপর অত্যধিক ভাড়া। আর পুরো এম্বুলেন্স সার্ভিস সিস্টেমটাই এদেশে সিন্ডিকেট এর জালে আটকে পড়ে আছে, মাঝখান থেকে কষ্ট পাচ্ছে রোগীরা।
স্বাস্থ্য স্থাপনায় সেবা:
আমাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের স্তরগুলো ওয়ার্ড লেভেল থেকে শুরু হলেও কাগজে-কলমে প্রাথমিক মূল ইমার্জেন্সী সার্ভিস প্রচলিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এরপরে জেলা সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত ইন্সটিটিউট। প্রথম দুইটি লেভেলের অবস্থা খুব একটা সুবিধার না। স্থাপনাগুলো জরুরী সেবাদানের উপযোগী করে তৈরী করে করা হয়নি কোন লেভেলেই। নেই পর্যাপ্ত জনবল, নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি, নেই কোন জাতীয় গাইডলাইন!!
এর সাথে আছে জনসাধারনের অস্থির আচরণ আর সুবিধাবাদীদের দৌরাত্ম। যে রোগীকে উপজেলায়ই চিকিৎসা দেয়া যেত, সেই রোগী শেষ পর্যন্ত এসে উপস্থিত হয় মেডিকেল কলেজ ইমার্জেন্সীতে। সেখানে অফিসিয়াল রোস্টার ডিউটিতে থাকেন একজন মাত্র মেডিকেল অফিসার ও একজন ইন্টার্নী ডাক্তার!! আর রোগী আসতে থাকে মিনিটে মিনিটে কয়েকজন করে। তাই ম্যানেজমেন্ট সেখানে তো সম্ভব হয়ই না, বরং রোগী ভর্তি হয়ে চলে যায় ইনডোরে। মূল চিকিৎসা শুরু করা যায় কিন্তু আসল ঘটনার অনেক অনেক সময় পরে, ততক্ষনে অনেক রোগীর অবস্থা এম্নিতেই খুব খারাপ হয়ে যায়। সেই সাথে আছে ইনডোরে স্বল্প বেডের ও জনবলের তুলনায় তিন-চারগুন বেশী রোগী। যে সামান্য সমস্যার রোগীটি উপজেলা-জেলায় চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি চলে যেতে পারত, সে এসে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে কাজের লোড বাড়ায় আর জরুরী রোগী যাদের প্রতি বেশী নজর দেয়া প্রয়োজন ছিল, তারা আর যথাযথ সেবা পায় না।
এভাবেই চলছে এদেশের সরকারী সেক্টরের জরুরী স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম বা ইমার্জেন্সী মেডিকেল সার্ভিস!!
আর বেসরকারী সেক্টরের অবস্থা তো বলাই বাহুল্য। মুনাফাখোর লোকেদের হাতে পড়ে এদেশের বেসরকারী চিকিৎসা সেবা খাতের অবস্থা দিন দিন সঙ্গীন হতে চলেছে, যার জন্য হাইকোর্টের রুল জারি করতে হয় প্রাইভেট হাসপাতালে জরুরী সেবা নিশ্চিত করতে। মাঝখান থেকে পাব্লিক ব্লেইম দেয় ডাক্তারদের। শুধু সামান্য একটা ধারনা দেই, বেশিরভাগ প্রাইভেট আই সি ইউতে একটি বেড ও অন্যান্য সার্ভিসের একদিনের ভাড়া হল একজন মেডিকেল অফিসারের সারা মাসের বেতন!!
সেই সাথে আছে সাধারন মানুষের চিকিৎসকদের প্রতি অবিশ্বাস।
সব মিলিয়ে এদেশের জরুরী স্বাস্থ্যসেবাখাত ডেভেলপমেন্ট করাটা সত্যিই আমাদের জন্য বেশ বড় একটি চ্যালেঞ্জ।
মাল্টিসেক্টোরিয়াল এপ্রোচ ও যথাযথ প্ল্যানিং, সেই সাথে দক্ষ নেতৃত্ব এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এই চ্যালেঞ্জ জয় করা আমাদের জন্য অসম্ভব কিছু নয়।
লিখেছেন:
ডা. আহমেদ মেজবাহ অপু
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
বস্তুনিষ্ঠ, গঠনমূলক, সুন্দর লেখা।ধন্যবাদ
It’s a must for BD.