লেখকঃ ডাঃ মোঃ মারুফুর রহমান অপু
পাবলিক হেলথ নামটা শুনলেই অনেকের চোখ মুখ কুচকে ওঠে, মাইলখানেক লম্বা একটা সংজ্ঞার কথা চোখে ভাসে। কিন্তু আমি আপনি যেহেতু “পাবলিক” তাই সুস্থ থাকতে হলে পাবলিকের হেলথ নিয়ে তো চিন্তা করতেই হবে। চলুন দেখি ঈদের সাথে বিশেষ করে কুরবানীর ঈদের সাথে এর সম্পর্ক কি-
১) একদম প্রথম থেকে শুরু করলে ঈদের দিন শুরু হয় গোছল, নামাজ দিয়ে এরপর কিছু মিস্টি মুখ, যাদের ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স আছে, কিংবা আইবিএস এর সমস্যা আছে তারা সেমাই কিংবা অন্যান্য দুগ্ধজাত খাবার প রিহার করুন কারন পেটে আজাব দেবার জন্য আরো অনেক কিছু সামনে আসছে।
২) এরপর পশু জবাই, জনসম্মুখে রাস্তায় পশু জবাই নিয়ে অনেক সুশীল সমাজের মেম্বার নানারকম যুক্তি তর্ক দেন, তবে এটা আমাদের দেশের একটি সংস্কৃতি, সুতরাং এটা ভালো না মন্দ তা নিয়ে তর্ক চলে না তবে এটা যেন খারাপ প্রভাব না ফেলে সেটা লক্ষ্য রাখা যায়। কুরবানীর পশু নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় জবাই করুন কিংবা একটু পরিষ্কার যায়গায় আর রাস্তায় করতে হলে রাস্তার মাঝামাঝি না করে একটু পাশে করুন যেন নিজেরাই চলাচল করা যায়। পশু কুরবানীর যেহেতু নিজ এলাকাতেই দিচ্ছেন এবং সেখানে নিজেরাই থাকবেন তাই এই রাস্তাঘাট, বাড়ির আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখার দ্বায়িত্ব নিজেদেরই। কুরবানীর সাথে সাথে পশুর রক্ত যত সম্ভব পানি ঢেকে ধুয়ে ফেলুন, গোবর ও অন্যান্য বর্জ্য সরাসরি ড্রেনে না ফেলে আলাদাভাবে ডাস্টবিনে ফেলুন। কুরবানীর জবাই এবং মাংস কাটার স্থানে ব্লিচিং পাইডার ছিটিয়ে দিন (এটা সিটি কর্পোরেশন এর লোকেরাই এসে করার কথা না করলেও অন্তত নিজেরাই করুন) এই ছোট কাজগুলো খুব বিরক্তিকর কিন্তু অসম্ভব না, টাকা পয়সাও বেশি লাগে না, কিন্তু না করলে এই জমাট রক্ত, পচা মাংস, গোবর এর উপর দিয়ে নিজেদেরই হেটে যেতে হবে, ড্রেনে ময়লা ফেলে ব্লক করে রাখলে কিংবা আবর্জনা না সরালে সেখানে মশার জনসংখ্যা বিস্ফোরন ঘটবে, আল্লাহ না করুন তখন হয়ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী নিয়ে এই ময়লার উপর দিয়েই দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। নিজেদের গরু বা ছাগল কুরবানীর স্থানেই শুধু এই কাজটুকু করলে হবে না, পাশের জন্য, নিজের এলাকা, সম্ভব হলে পাশের এলাকায় যারা করছে না তাদেরকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে করার জন্য যেন সবাই মিলে একসাথে সুস্থ থাকা যায়।
৩) যতই ডায়াবেটিস আর হার্টের অসুখ থাকুক কুরবানীতে মাংস খাবেনা এমন বোধ হয় কেউ নেই। ভরপেট খাওয়া চলবে, পোলাও মাংস বার বার গরম করা চলবে, ব্যাসিলাস সিরিয়াস এর স্পোর ফেটে বের হবে এবং পেটে গিয়ে সিরিয়াস ফুড পয়জনিং শুরু করবে এইতো আর দু-একদিনের ভিতরেই। এমন কোন উপায় কি নেই যাতে সাপ ও মরে লাঠি ও না ভাঙ্গে মানে ভরপেট পোলাও মাংস খাওয়া চলে আবার পেটটাও ঠিক থাকে? আছে উপায় আছে, না দামী দামী এন্টিবায়োটিক সাথে নিয়ে ঘুরতে হবে না। যা আছে তার নাম প্রোবায়োটিক, অর্থাৎ বন্ধু ব্যাকটেরিয়া। কাটা দিয়ে কাটা তোলার মত এরা অন্ত্রে যেয়ে বংশবৃদ্ধি করে শত্রু ব্যাকটেরিয়াকে ভাগাবে। প্রোবায়োটিক পাওয়া যাবে কোথায়? এটাও নামী দামী ক্যাপসূলে পাওয়া যায় কিন্তু সবচেয়ে সহজ লভ্য হচ্ছে দই! হ্যা দই খুব ভালো একটি প্রোবায়োটিক খাবার, টক দই কিংবা মিস্টি দই দুটোতেই ল্যাক্টোব্যসিলাস, বিফিডোব্যাক্টেরিয়াম এইসব বন্ধুরা আছে। তাই ভরপেট খাবার পরে দু-চার কাপ দই সাবাড় করে দিন। আশা করা যায় এরা আপনাকে ঘন ঘন বাথরুমে যাওয়া থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করবে।
৪) ডায়াবেটিস ও হার্ট ডিজিজ এর রোগীরা যারা শত মানা করা সত্ত্বেও তেল চর্বি মাংস খাবেন তারা হিসেব করুন আপনার জীবনের উপরে আর কত জনের জীবন নির্ভরশীল। এরপর ওদের কথা চিন্তা করুন আর খান। যেহেতু লোড বাড়িয়ে দিয়েছেন তাই অন্য সময়ের চেয়ে বেশি ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করুন, মাংস খেলেও চর্বি, মজ্জা পরিহার করুন। ওষুধ ঠিকমত খাচ্ছেন কিনা খেয়াল রাখুন।
৫) এই অতিরিক্ত কোলেস্টেরল যেন শরীরে জমতে না পারে তাই কোলেস্টেরল লোয়ারিং ফুড (ওষুধ যারা খাচ্ছেন তারাতো সেটা খাবেনই সেই সাথে) যেমনঃ অলিভ ওয়েল, বাদাম, রাইস ব্রান ওয়েল, গ্রীন টি, রসূন ইত্যাদি বেশি করে খান।
৬) তিনবেলা মাংস খেলে আরেকটা সমস্যা যেটা হবে তা হল কনস্টিপেশন। যেহেতু খাবারে প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট বেশি, ফাইবার খুব কম তাই কনস্টিপেশোন হতে বাধ্য, আর এটা হলে যাদের আগে থেকে পাইলস এর সমস্যা আছে তারা কি কস্টে ভুগবেন তারাই আরো ভালো জানেন। কনস্টিপেশন এড়াতে প্রচুর সালাদ খান, খাবারে সবজি যোগ করুন আর তাও না পারলে অন্তত দুবেলা ইসুব গুলের ভুষি পানিতে ভিজিয়ে খান।
৭) গরু বা খাসীর সবটাই খারাপ না, গরুর কলিজা খুবই উচ্চমানের ভিটামিন বি-১২ এর উৎস, আমাদের শরীরের জন্য তো এটা দরকারই সব চেয়ে বেশি দরকার গর্ভবতী মায়েদের, বাচ্চার মস্তিষ্ক গঠন এর জন্য এটা খুবই জরুরী ভিটামিন। সুতরাং এই অংশটি সবাই খেতে পারেন (অতিরিক্ত নয়)।
৮) আরো একটা ব্যাপার যেটা ঈদের আগে চিন্তা করার দরকার ছিল সেটা হল বড় গরু, স্টেরয়েড গরু! সাম্প্রতিক এক গবেষনায় দেখা যায়, precocious puberty বা অল্প বয়সে বয়ঃপ্রাপ্ত হবার অন্যতম কারন হচ্ছে মাংসে স্টেরয়েড। বিশেষ করে সচ্ছল পরিবারে বড় গরু কেনার হার বেশি এবং সেখানের একটি বড় অংশই স্টেরয়েড দেয়া থাকে তাই সচ্ছল ফ্যামিলির ছেলে মেয়েরা অল্প বয়সেই পিউবারটি তে চলে আসে এবং ফলাফল হিসেবে আরো আগে তারা বার্ধক্যে ভোগে, সারভাইকাল ক্যান্সার, ব্রেস্ট ক্যান্সার ইত্যাদি রোগে ভোগে! সুতরাং পশু কেনার আগে ভালোভাবে দেখে কিনুন।
পরিশেষে নিজে সুস্থ থাকুন অন্য কেও সুস্থ থাকতে দিন! সবাইকে ঈদ মোবারক।