উপজেলা পর্যায়ে ‘মারামারির রোগী’- সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তারদের জন্য পরামর্শঃ পর্ব-২

লেখকঃ ডাঃ অনির্বাণ সরকার

আগের লেখায় আলোচনা করেছি উপজেলা পর্যায়ে আপনাকে কি কি ডিউটি পালন করতে হবে, সরকারী সেলফোন ব্যবহার করবেন কিভাবে এবং assault বা ‘মারামারির রোগী’ ইমার্জেন্সিতে আসলে দায়িত্বরত চিকিৎসক হিসেবে আপনার করণীয় কি। এ বিষয়ে আরো কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। এগুলো হলোঃ

১) কোনো রোগী এসে যদি বলে, তাকে আঘাত করা হয়েছে, কিন্তু আপনি পরীক্ষা করে দেখলেন- তার গায়ের কোথাও কোনো ক্ষতচিহ্ন নেই, সেক্ষেত্রে আপনি কি করবেন? আপনাকে এই রোগীর তথ্যও assault খাতায় লিপিবদ্ধ করতে হবে। বর্ণনার জায়গায় (History of physical assault লেখার নিচে) লিখবেন- No external injury was seen.

২) বাইরে আঘাতের চিহ্ন নেই, এমন রোগী এবং রোগীর বর্ণনা সহজ মনে হচ্ছে? জেনে রাখুন- এই কেসগুলোই সবচেয়ে ঝামেলার। আঘাতের চিহ্ন নেই, অথচ ব্যথার কথা বলার কারণ হতে পারে- হয় তাকে ‘চোরা মাইর’ দিয়ে soft tissue injury করা হয়েছে, কিংবা তার কোনো গুরুতর Internal injury আছে, কিংবা প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে সে ব্যথার অভিনয় করছে। এসব রোগীদের ক্ষেত্রে এই তিনটি ডি/ডি মাথায় রেখেই আপনাকে এগোতে হবে। প্রথমেই রোগীর appearance লক্ষ্য করুন, বয়স বিবেচনায় নিন। রোগীকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরীক্ষা করুন। যে জায়গায় ব্যথা, সেটি পুনরায় পরীক্ষা করুন। মাথায় আঘাতের কথা বললে এবং রোগী বমি করলে/ চোখে ঝাপসা দেখলে দেরী না করে তাকে সদর হাসপাতাল/ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করুন। পেটে আঘাতের কথা বললে দেখুন- পেট শক্ত (rigid) কিনা, বুকে আঘাতের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করুন রোগীর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কিনা। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রোগী রেফার করুন।

৩) বাইরে আঘাতের চিহ্নবিহীন রোগীকে হাসপাতালে রেখে বা ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দিয়ে চিকিৎসা করা সম্ভব হলে সেটি আপনি করতে পারেন। এসব রোগীকে Investigation দেবেন কিনা? প্রয়োজন মনে করলে দেবেন। প্রয়োজন ছাড়াও দেয়া লাগতে পারে। রোগী বা তার লোকজন দাবী করতে পারে- “অত ব্যথা, ডাক্তর একটা পরীক্ষাও দিলো না!” এসব ক্ষেত্রে Investigation দিয়ে দেয়া ভালো। তবে মনে রাখবেন- এক্ষেত্রে আপনাকে assault খাতা খুলে লিখে রাখতে হবে কেন Investigation দিয়েছেন। রোগীর দাবীটিই লিখুন। যেমন- The patient feels pain in the right side of the chest. A CXR P/A view is given.
এসব Investigation-এর রিপোর্টের ক্ষেত্রে আগের নিয়ম অনুসরণ করবেন, যেটা আগের লেখায় বলেছি।

৪) আবারও মনে করিয়ে দিই- গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই Ultrasonogram for pregnancy profile দেবেন; তার দৃশ্যমান আঘাত থাকুক বা না থাকুক।

৫) প্রয়োজন নেই, তারপরও মারামারির রোগীদের একটি বড় অংশ হাসপাতালে ভর্তি হতে চাইবে। এমনটা চায় কেন তারা? কারণ, মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে এই কথাটি রোগীর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, সালিশে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা সহজ হয়। বাংলাদেশের গ্রামে সরাসরি অনেকেই এখনো পুলিশের কাছে যায় না, মামলা করে না। গ্রামের মাতব্বর, চেয়ারম্যানরা পারমিশন দিলে তবে তারা মামলা করে, নাহলে একঘরে হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আপনারা যারা নাগরিক তরুণ-তরুণী, এসব জটিল রাজনীতি এখনই বুঝবেন না, ধীরে ধীরে বুঝবেন। একটা পরামর্শ আপনাদের দিচ্ছি- ভর্তি হতে চাইলে ভর্তি করে দেবেন, মাথা গরম করবেন না। কারণ- আপনি ভর্তি দিলেন না রোগীকে, ফোন চলে এলো আপনার ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কিংবা এম.পি.র কাছ থেকে;তারপর ঠিকই ভর্তি দিতে বাধ্য হলেন। তখন আপনার সম্মানটা কি কিছুটা হলেও কমবে না? এসব কথা লিখতে দুঃখ হচ্ছে ঠিকই, তবে আপনাকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে চলারই পরামর্শ দেবো আমি।

৬) সুস্থ-সবল রোগী- যারা জটিল সামাজিক/রাজনৈতিক কারণে হাসপাতালে ভর্তি হবে, তাদের আপনি আইএম থেরাপি (I/M therapy) দিতে পারেন। এতে রোগী তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে চাইবে। এটা কি জানতে চাইবেন না, এইখানে কওয়াটা ঠিক হইবো না। বুঝে যাবেন অন্য ডাক্তারদের কাছ থেকে।

৭) রোগীর লোকেরা/ নেতারা/ পাতিনেতারা/ নেতার চ্যালারা রোগী দেখার সময়ই আপনাকে বলতে পারে- “ডাক্তার সাব, ছাব্বিশ দেওয়া লাগবো”। ছাব্বিশ কি? আপনার কাছে কি তারা ছাব্বিশ টাকা চাইছে? না, ব্যাপারটি তা নয়। এটি বাংলাদেশ পেনাল কোডের ৩২৬ নম্বর ধারা, যেটি সম্পর্কে তারা জানে, অথচ আপনি জানেন না। উপজেলা পর্যায়ের সরকারী ডাক্তার হিসেবে আপনি যদি বাংলাদেশ পেনাল কোড সম্পর্কে জানেন, তা আপনার কাজকে সহজ করে দেবে।
এই লিংকে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন বাংলাদেশ পেনাল কোড ১৮৬০-এর ধারাগুলিঃ http://bdlaws.minlaw.gov.bd/print_sections_all.php?id=11
বাংলাদেশ পেনাল কোডের ধারা আছে ১ থেকে ৫১১। অত পড়তে হবে না আপনাকে। আপনি এটা প্রিন্ট করে শুধু ৩১৯ থেকে ৩২৬ নম্বর ধারা পর্যন্ত ভালো করে পড়ে নেবেন। এই জ্ঞান অবশ্যই আপনাকে সহায়তা করবে।

৮) আপনাকে সরাসরি বা ফোনে কেউ ‘ছাব্বিশ’ দিতে বললে বা অন্য কোনো দাবী করলে আপনি সরাসরি হ্যাঁ-ও বলবেন না, না-ও বলবেন না। বলবেন- আপনাকে আরএমওর সাথে বা অন্য ডাক্তারদের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বলবেন- মেডিকেল বোর্ড সিদ্ধান্ত দেবে। মাথা গরম না করে এসব কিছু সত্য-মিথ্যা ভুং ভাং আপনাকে দিতে হবে। Assault খাতা বা Injury Certificate-এ সরাসরি পেনাল কোডের ধারা উল্লেখ করা যায় না, এটিও বলতে পারেন। তবে যা-ই বলুন না কেন, লেখার সময় কোনো অনুরোধের লেখা লিখবেন না; যা পেয়েছেন তাই লিখবেন। আপনাকে কেউ চা খাবার টাকা দিতে চাইলে ‘চা’ খাবেন না।

(চলবে)
আগের লেখার লিঙ্কঃ https://platform-med.org/2014/08/630/

ডক্টরস ডেস্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

উপজেলা পর্যায়ে 'মারামারির রোগী'- সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তারদের জন্য পরামর্শ- পর্ব ৩

Sun Aug 17 , 2014
লেখকঃ ডাঃ অনির্বাণ সরকার ধরে নিচ্ছি- আমার আগের কাঁচা হাতের লেখাদুটো আপনারা পড়েছেন। কোনো প্রাপ্তির আশায় নয়, বরং দু-একজনও যদি আমার লেখা থেকে উপকৃত হন, তাহলেই নিজেকে ধন্য মনে করবো। যাক, এবার আসল কথায় আসি। আজ আপনাদের বলবো- ইনজুরি সার্টিফিকেট (প্রচলিত ভাষায় এমসি বা Medical Certificate) কিভাবে লিখবেন। Assault-এর শিকার […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo