প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৬ মে ২০২০, বুধবার:
ডা. নাজিয়া শাম্মী হোসেন
ইন্টার্ন, এনাম মেডিকেল কলেজ
আমার মেডিকেল জার্নিটা শুরু হয় ২০১৫ সালে। ফার্স্ট ইয়ারের জন্য এ্যানাটমি এক বিশাল ভয়ংকর সাবজেক্ট! ওই বছর মাঝামাঝি সময়ের দিকে “Abdomen” এর মত বিরাট কার্ডটি আমাদের ২৫ জনের ব্যাচকে পড়ানোর দায়িত্ব পড়ে এমন এক টিচারের উপর যাকে আমরা আগে কেউই কখনো দেখিনি, তার প্রেগন্যান্সি লিভের জন্য। শুধু আগের ব্যাচ থেকে তাঁর নাম বেনজীর মাসুদ ও তাঁর কঠোরভাবে পড়া আদায়ের গল্প শুনেছি। সুতরাং ম্যাম আমাদের পড়াবেন এই সংবাদ শুনে আমাদের গলা শুকিয়ে যাবার দশা, “যদি না পারি তাহলে তো নির্ঘাত ফেইল!”
এমন শংকাগুলো পুঁজি করেই যখন আমাদের প্রথম ক্লাস শুরু, দেখলাম খুব স্মার্টলি গাম্ভীর্যপূর্ণ একজন ব্যক্তি আমাদের ক্লাস নিতে এসেছেন। সবার নামধাম জিজ্ঞাসা করেই কেমন যেন নিজের করে “তুই” বলে ডাক শুরু। দারুণ করে পড়া বোঝানো আর কঠোর পড়া আদায়ের মাঝে কবে যে আমাদেরকে এত আপন করে নিয়েছিলেন আমরা টেরই পাইনি। পড়ানো আর পড়া আদায়ের বাইরেও আবিষ্কার করলাম ইনি সবক্ষেত্রেই আপাদমস্তক অসম্ভব সাহসী একজন নারী।
সাভার থেকে প্রথম এইচ এস সি তে স্ট্যান্ড করেছিলেন এবং চান্স পেয়ে যান সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে। তার মেডিকেলের ফার্স্ট ইয়ার থেকেই সংসার আর পড়াশুনা একসাথে সামলিয়েছেন। ম্যাডাম গল্প করতেন যখন তার বন্ধু বান্ধবীরা হলে থাকতো, পড়ার ফাঁকে ঘুরতো ম্যাডাম তখন নিজ বাসার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ভোরের আলোর সাথে পাল্লা দিয়ে উঠে রান্নাবান্না শেষ করে ছুটতেন ক্লাসের উদ্দেশ্যে। অতঃপর কি হয়েছিলো জানেন? প্রতিটা প্রফেশনাল এক্সামে বিভিন্ন সাবজেক্টে অনার্স মার্কস নিয়ে এম.বি.বি.এস শেষ করেছিলেন।
এরপরে এনাম মেডিকেলে এ্যানাটমির লেকচারার হিসেবে জয়েন করেন। প্রথম সন্তান জন্মের পর কিছু সময়ের লিভ ও পরে রিজয়েন। এই সময়টুকুই ভাগ্যক্রমে আমরা তাকে পেয়ে যাই। এরপর যখন ৩৪তম বিসিএস (স্বাস্থ্য) এর রেজাল্ট আসলো ম্যাডাম সারাদেশে ৫ম স্থান অধিকার করলেন এবং প্রথম পোস্টিং হিসেবে চলে গেলেন ধামরাইতে। তারপরে সাভার এবং সর্বশেষ ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে এ্যাসিস্টেন্ট রেজিস্ট্রার হিসেবে জয়েন করেন।
আর এই সময়টাতেই “করোনা” আমাদের দেশে হানা দিতে শুরু করে। তবুও দেখিনি ম্যাডাম এক মুহূর্তের জন্য বিচলিত হচ্ছেন। নিজের সন্তানকে নিজ হাতে ব্যাগ গুছিয়ে তার মায়ের বাসায় পাঠিয়ে দেন, বহু কষ্টে চেপে রাখা চোখের পানিকে আটকাবার চেষ্টা নিয়ে। প্রতিদিন শত শত রোগীর সম্মুখে নিজের অনিরাপত্তার কথা তাঁর থেকে আর কে ভালো জানতো? তবুও এক দিন এক বেলার ডিউটি তিনি কম করেননি। শুধু বলেছিলেন, “তোমরা স্টুডেন্টগুলা আমার অনেক প্রিয়, আমার জন্য একটু দুয়া করো”
হঠাৎ গতদিন মেসেঞ্জারে ম্যাডামের মেসেজ। নাহ নিজ হাতে লেখা কোন শব্দ বা কথা নয়, ধবধবে সাদা কাগজে টাইপ করা কিছু লেখা। “Positive for COVID 19” আর পেশেন্ট হিসেবে আমার ম্যাডাম এবার নিজেই নাম লিখিয়ে ফেললেন!
খুব জানতে ইচ্ছে করে কি দরকার ছিল ম্যাডাম এত সাহসের যা পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে আবার নিজেকেই আক্রান্ত হতে বলে? কি দরকার ছিল এত মনোবলের যে নিজের অসুস্থ হবার খবর এত অনায়াসে নিজ হাতে মেসেজ করে পাঠিয়ে দিতে? কে জানতো যে সাহস আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে তা আজ আমাদের এত বড় বোঝার ভার এনে দেবে? আমি নিশ্চিত সব কেটে গেলে ম্যাডাম আবার ওই পিপিই জড়িয়ে কর্মস্থলে চলে যাবেন, আবার আলাদা থাকার পণ নিয়ে বসে থাকবেন, “সাহসী” হয়ে চলার নতুন গল্প লিখবেন! এমন নির্ভীক মানুষদের জন্যই অন্য মানুষের কষ্ট দূর হয়, নিজেদের সব সুখের বিসর্জন হয়েই অন্য পরিবারের “সুস্থতা” উপহার হয়ে আসে!
আপনাদের দোয়ায় মনভরে স্মরণ করবেন তাঁকে ও তাঁর পুরো পরিবারকে; আল্লাহপাক যেন তাঁকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে আবার আমাদের মাঝে স্বাভাবিকরূপে নিয়ে আসে।