চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে আমাদের সবার জানা আছে যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক বলা হয়ে থাকে হিপোক্রেটসকে। যে সময়ে তাঁর জন্ম হয়েছিলো (৪৬০ খ্রিষ্টপূর্ব) সে সময় চিকিৎসা বিজ্ঞান কুহেলিকায় ঢাকা ছিলো। শুধুমাত্র কুসংস্কার আর বিভিন্ন তন্ত্রমন্ত্রের মধ্যেই চিকিৎসকদের জ্ঞান সীমাবদ্ধ ছিলো। প্রাচীন গ্রীসে চিকিৎসার দেবতা ছিলেন অ্যাপোলো। তার হাতে একটি দন্ড থাকতো। একে বলা হতো হার্মিসের দন্ড, যা চিকিৎসাবিদ্যার প্রতীকী বহন করতো। গ্রীসের বিভিন্ন স্থানে অ্যাপোলো মন্দির ছিলো। লোকজন অসুস্থ হলে এই মন্দিরে গিয়ে সুস্থতা কামনায় পূজা করতো। মন্দিরের পুরোহিতরাই ছিলেন প্রধান চিকিৎসক। তারা নিজেদের খুশিমত চিকিৎসা দিতো লোকজনদের। লোকজন ভাবতো দেবতার ক্রোধে মানুষ অসুস্থ হয়। পুরোহিতরা দেবতার প্রতিনিধি, তারা ইচ্ছে করলেই রোগ ভালো করে দিতে পারে। এভাবেই এক শ্রেণীর পুরোহিত সম্প্রদায় গড়ে উঠলো, চিকিৎসা করাই তাদের পেশা। কালের পরিক্রমায় তারা বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চিকিৎসা সম্পর্কে তারা কিছু জ্ঞান অর্জন করলো। যে টুকু জ্ঞান অর্জন করতো সেটা অ্যাপোলো প্রদত্ত মনে করে গোপন রাখতো। তখন চিকিৎসা বিদ্যাকে বলা হতো গুপ্তবিদ্যা। এই বিদ্যা শুধু পিতা-মাতা তাদের সন্তান কে দিতো। হিপোক্রেটস ছিলেন এমনি এক চিকিৎসকের পুত্র। হিপোক্রেটসের জন্ম অ্যাপিয়ান সাগরের ‘কস’ দ্বীপে। তার জীবন সম্পর্কে বিশেষ কোন তথ্য উদ্ধার করা যায় নি। যেটুকু তথ্য পরবর্তী তে সংগ্রহ হয়েছিলো তার ভিত্তিতে জানা যায় হিপোক্রেটসের বাবা ছিলেন অ্যাপোলো মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। সেই সূত্রে প্রভাব এবং প্রতিপত্তি দুটোই ছিলো। সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে বড় হয়েছেন হিপোক্রেটস।
ছেলেবেলা থেকেই হিপোক্রেটস ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তার শিক্ষার সূত্রপাত হয় তার বাবার কাছে। বাবার কাছ থেকে যাবতীয় গুপ্ত বিদ্যা অর্জন করেন তিনি। সেসময় একমাত্র এসেন্সে চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু পড়াশোনা হতো। হিপোক্রেটস বাবার কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করার পর এসেন্সে গেলেন চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা করতে। সেখানে তার শিক্ষক ছিলেন ডিমোক্রিটাস। তিনি ছিলেন সে যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। এছাড়াও এসেন্সের আরো কয়েকজন শ্রেষ্ঠ পন্ডিতের কাছ থেকে হিপোক্রেটস শিক্ষা লাভ করেন। হিপোক্রেটস চিকিৎসকের পুত্র হয়ে নিজের গভীর জ্ঞান, বাস্তব যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সে যুগের চিকিৎসা ব্যবস্থার ভ্রান্তি আর দোষ ত্রুটি উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি স্থির করেছিলেন এই প্রকৃত চিকিৎসা ব্যবস্থার সূচনা করবেন। তাই তিনি নিজের চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত করে রুগীদের চিকিৎসা শুরু করলেন যা ছিলো প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তখন শুধুমাত্র রোগীর রোগের উপসর্গ দেখে চিকিৎসা দেয়া হতো। কিন্তু হিপোক্রেটস বললেন ‘একজন প্রকৃত চিকিৎসকের উচিৎ রোগ নয়, রোগীর চিকিৎসা করা।’ একজন চিকিৎসকের উচিৎ রোগীর যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা, যেমন রোগীর জীবনযাত্রা, পরিবারের অন্যদের রোগের ইতিহাস, তার কাজকর্ম। এসব তথ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই রোগীর সঠিক চিকিৎসা নির্ধারণ করতে হবে।
অল্পদিনের মধ্যেই চিকিৎসক হিসেবে তার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। নবীন তরুণ চিকিৎসক হিসেবে তার নতুন নতুন মতবাদের কথা শুনে এসেন্সের প্রবীণ চিকিৎসকদল তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো।
হিপোক্রেটস যে শুধু চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শীতা লাভ করেছিলেন তাই নয়, চিকিৎসা বিদ্যার নামে ভণ্ডামির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। এতদিনকার প্রভাব-প্রতিপত্তি বিনষ্ট হয়ে যেতে দেখে পুরোহিত আর চিকিৎসকের দল হিপোক্রেটসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। হিপোক্রেটস উপলব্ধি করতে পারলেন তার একার পক্ষে এসেন্সে থাকা নিরাপদ নয়। তাই তিনি এসেন্স ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান।
কয়েক বছরের মধ্যে তিনি নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি গড়ে তোলেন, যার ভিত্তি ছিলো যুক্তি আর প্রত্যক্ষ জ্ঞান এবং বস্তুনিষ্ঠ চিন্তা ভাবনা।
সে যুগে গ্রিসদেশে শরীরচর্চা কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে মানা হতো। শুধু তাই নয়, স্পার্টায় কোন অসুস্থ দূর্বল কিংবা বিকলাঙ্গ শিশু জন্মগ্রহণ করলে তাকে হত্যা করার বিধান দেয়া হতো। মনে করা হতো কেবল সুস্থ সবল নাগরিকদেরই বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাই খেলাধুলা এবং শরীরচর্চার জন্য গ্রিসের সর্বত্র অসংখ্য ব্যায়ামাগার ছিলো। এসব ব্যায়ামাগারে মাঝেমাঝে দূর্ঘটনা ঘটতো। ওখানে নিয়মিত যেতেন হিপোক্রেটস। খেলোয়াড়দের পেশী-অস্থি সংক্রান্ত যেসব অসুবিধা দেখা দিতো তা থেকে তিনি জ্ঞান লাভ করতেন এবং চিকিৎসার বিধান দিতেন। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক শল্যচিকিৎসার সূচনা করেছিলেন তিনি।
হিপোক্রেটস প্রথম আবিষ্কার করেন যে মানবদেহ থেকে বিভিন্ন ধরনের রস নির্গত হয়। তিনি মনে করতেন মানুষের মানসিকতা, আচার-ব্যবহার, তার অসুস্থতা এমনকি মৃত্যুর প্রধান কারণ দেহ নিঃসৃত রস বা হিউমোর। এই রস কখনো শীতল, কখনো কখনো উষ্ণ, কখনো বা শুষ্ক হতে পারে। এই রসের পরিবর্তনের অর্থ দেহের স্বাভাবিকতার পরিবর্তন। বর্তমান কালে মানবদেহে কোন কারণে তাপ বৃদ্ধি পেলে তাকে অসুস্থ বলে বিবেচনা করা হয় এবং সেইভাবে চিকিৎসা করা হয়। হিপোক্রেটসই প্রথম মানবদেহের তাপের হ্রাস-বৃদ্ধিকে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা মনে করতেন। মৃগীরোগ সম্পর্কে শুধু সে যুগেই নয়, বর্তমানে ও বহু মানুষের ধারণা কোন অপদেবতা কিংবা শয়তান মানুষের উপর ভর করলে এ রোগ হয়। কিন্তু হিপোক্রেটস তার ‘On The Cichlid Disease’ গ্রন্থে বলেছেন অন্যান্য ব্যাধির মত মৃগী ও একটি ব্যাধি এবং সুনির্দিষ্ট কারণেই এই ব্যাধি সৃষ্টি হয়।
হিপোক্রেটস শুধু রোগ এবং রোগীদের সম্পর্কেই কাজ করেন নি, তিনি চিকিৎসকদের প্রতি বহু নির্দেশ দিয়ে গেছেন এবং এই নির্দেশগুলো সর্বকালেই প্রযোজ্য। তিনি বলেছেন যে চিকিৎসক রোগীর প্রাসঙ্গিক খোঁজ না নিয়ে শুধু রোগের চিকিৎসা করেন, তিনি কখনোই মহৎ চিকিৎসক হতে পারেন না। তিনি বলতেন, সকল বিদ্যার মধ্যে চিকিৎসাবিদ্যাই শ্রেষ্ঠ। শুধুমাত্র কিছু অজ্ঞ চিকিৎসকদের জন্যই এ বিদ্যা অন্যসব বিদ্যা থেকে পিছিয়ে পড়েছে।
একজন মহান চিকিৎসা বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি সকল অজ্ঞতা এবং কুসংস্কারের অন্ধকারকে দূর করে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যুক্তিনিষ্ঠ আর তথ্যে। তাই তিনি শুধু সে যুগেই নয়, সর্ব যুগেই চিকিৎসকদের প্রণম্য।
চিকিৎসকরা যাতে তাদের সুমহান আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হন, সেই কারণে তিনি তার ছাত্রদের বিদ্যা শেষ হলে শপথ করাতেন। একে বলা হয়ে থাকে ‘হিপোক্রেটস শপথ’। প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে হিপোক্রেটসের নামাঙ্কিত এই শপথ পৃথিবীর সবত্রই চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্ররা আজ ও শিক্ষানবীশ হওয়ার পূর্বে উচ্চারণ করে। এ থেকেই হিপোক্রেটস ও তার অনুগামী চিকিৎসকদের সেবার আদর্শ ও সুমহানত্বের পরিচয় পাওয়া যায়।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৭০ খ্রিষ্টাব্দে ৯০ বছর বয়সে এই মহান মানবের জীবনাবসান ঘটে। আজ এত বছর পর ও পৃথিবীরর মানুষ তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। সভ্যতা যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন মানুষের কাছে তার অবদান উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
ফিচার রাইটার:
Tahrim Mojumder (Ayesha)
Brahmanbaria Medical College
Session: 2015-16