লেখক –
ডা সুরেশ তুলসান।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ।
কদিন হলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢাকা মেডিকেলের কে – ৪০ ব্যাচের রাজকুমার শীল দাদার খবরটা পড়ে মনে পড়ে গেল অতীতের কিছু কথা।
আমি তখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পড়ি।
থাকতাম পিংকু হোস্টেলে নিচতলায় ১১৫ নং কক্ষে।
আমার এক রুম পরের রুমে থাকতেন সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত এক সিনিয়র ভাই।
অনেকদিন আগের ঘটনা, ঠিকমতো মনে নেই,
তারপরও যতটুকু মনে পড়ে তিনি নিয়মিত ক্লাসগুলো করতেন, সন্ধ্যা হলে সময়মতো পড়ার টেবিলে বসতেন।
ছুটির দিনগুলোতে রুম পরিষ্কার করা, কাপড়-চোপড় ধোয়া ইত্যাদি দেখে বোঝার উপায় ছিলোনা তিনি সিজোফ্রেনিয়ার মতো গুরুতর একটি মানসিক রোগে আক্রান্ত।
শুধুমাত্র ঋতু পরিবর্তনের সময় উনার আচরণে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আসতো এবং উনার বাড়ির মানুষ আর সহপাঠীরা মিলে উনাকে হোস্টেল থেকে নিয়ে যেতেন।
যেকারণে অনেক সুস্থ ছাত্রদের তুলনায় নিয়মিত পড়াশোনা করলেও মাঝেমধ্যে তিনি পরীক্ষায় বসতে পারতেন না।
তবে একটা বিষয় ছিলো লক্ষনিয়, তিনি ছিলেন মিষ্টভাষী এবং সদাচারী।
উনার সহপাঠীরা, সিনিয়র, জুনিয়র সকলেই ছিলেন উনার প্রতি প্রচন্ড সহানুভূতিশীল এবং দায়িত্বশীল।
যার কারণে তাকে রাজকুমারের মতো করুণ পরিনতি বরণ করতে হয়নি।
আমি যেহেতু সেই সময়ের ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র না, তাই জানিনা সেই সময়ে রাজকুমার দাদার প্রতি উনার সহপাঠীদের ভূমিকা কেমন ছিলো এবং এই অসুস্থতার কারণে পিছলে পড়া রাজকুমারকে পথ থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে ধুলোমাটি ঝেড়ে, সাহস আর মনোবল যুগিয়ে উনার জীবনদৌড়টি অব্যাহত রাখা সম্ভব ছিলো কিনা?
মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রায় প্রতি ব্যাচেই একজন দুজন ছাত্র থাকেন যারা যথেষ্ট মেধাবী হওয়া স্বত্তেও তাদের মানসিক স্থিতিশীলতা আরা দশটা সাধারণ ছাত্রদের মত ততটা সবল না।
আমরা মানসিক ভাবে অসুস্থ কাউকে পাগল বলি অথচ একটিবারের জন্যও ভেবে দেখিনা যে, মানসিক অসুস্থতা আর দশটা সাধারণ রোগের মতই একটি রোগ।
ভেবে দেখুন কোন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে কি কখনও আমরা ক্যান্সার বলে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করি? করি না, বরং সহানুভূতি দেখাই।
ঠিক সেভাবেই কোন মানসিক ভারসাম্যহীন কোন মানুষকে পাগল বলে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ না করে তাদের প্রতি আমদের সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত।
তাই সকলের প্রতি অনুরোধ এধরণের সহপাঠীদের সাথে আচরণে যথার্থ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিন।
তাহলে হয়তো আরও অনেককেই রাজকুমার দাদার মত করুন পরিনতি বরন করতে হবে না।
ছোট্ট একটি ঘটনা বলে শেষ করছি —-
আমি তখন বিএসএমএমইউ এর লাইব্রেরিতে এফসিপিএস দ্বিতীয় পত্রের জন্য পড়াশোনা করি।
একদিন দেখতে পেলাম আমার পাশের রুমের সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত সেই সিনিয়র ভাইকে। লাইব্রেরির এক কোনায় একটা টেবিলে গভীর মনোযোগ সহকারে একাকী পড়াশোনায় ব্যাস্ত।
একরাশ কৌতূহল নিয়ে উনার পিছনে দিয়ে দাঁড়ালাম।
তারপর আস্তে করে উনার ঘাড়ে হাত রাখতেই উনি একটা ভুবনমোহিনী হাসিমুখ নিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালেন। তারপর কোনরকম ইতঃস্ততা না করে বইটা বন্ধ করে কভার পেজটা আমাকে দেখালেন। দেখলাম বইটার নাম লেখা আছে “SCHIZOPHRENIA”।
অতঃপর কিছুটা লজ্জা পেয়েই বললেন — “নিজের রোগ তো, তাই একটু ভালো করে পড়ে নিচ্ছি”।