প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৭শে মে, বুধবার, ২০২০
লেখা: ডা. সেলিম শাহেদ
রেজিস্ট্রার (মেডিসিন)
শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।
কিছু করার ইচ্ছাই আজকে মানুষকে এ তিলোত্তমা সময়ের কাছে এনে দাঁড় করিয়েছে। অদম্য ইচ্ছা নিয়ে মানুষ গায়ে ডানা লাগিয়ে উড়তে চেয়েছে বলেই মানুষ আজ প্লেনে চলে মেঘেদের ভেলায় ভেসে বেড়ায়। আজ পৃথিবীর এই ক্রান্তিলগ্নে কিছু মানুষের অদম্য ইচ্ছা এবং সাধ পূরনের চেস্টাই হয়তো মানুষকে এক ভালো সময়ের কাছে নিয়ে যাবে।
এই করোনাকালে চিকিৎসকদের জন্য সত্যিকারের ভালো কিছু করার প্রত্যয়ে এগিয়ে এসেছেন তেমনই একজন, টাংগাইলের কালিহাতী উপজেলার ইউ এন ও শামীম আরা নিপা।
জনগণের সত্যিকারের সেবা করতে চাইলে মনে থাকা চাই সহানুভূতি বা empathy অর্থাৎ আরেকজনের অবস্থানে দাঁড়িয়ে তার সমস্যাটা নিজের সমস্যা মনে করে অনুধাবন করা এবং তা সমাধানে সচেষ্ট হওয়া।
দেশের বিভিন্ন হাসাপাতালের পৃথক করোনা ইউনিটগুলোতে রোগী ও ডাক্তার উভয়ই এখন বেশ ক্রিটিক্যাল সময় পার করছে।
রোগীদের অভিযোগ ডাক্তাররা নিয়মিত রাউন্ডে আসেন না আসলেও খুব কম সময়ের জন্য দূর থেকে কথা বলে চলে যায়, আবার একইভাবে ডাক্তারদের মধ্যেও পিপিই এর মান নিয়ে শঙ্কা রয়েছে কারণ জীবাণু থেকে নিরাপত্তা বিধান বেশ কঠিন,আবার লম্বা সময় পিপিই পরে থাকাও বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
একটি ব্যয়বহুল পিপিই একদিনের বেশি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। করোনা ইউনিটে চিকিৎসক যেনো প্রবেশ করে নিরাপদে রোগীদের খবরাখবর নিতে পারেন সেজন্য স্যাম্পল কালেকশন বুথের এর আদলে ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ তালুতের সহায়তায়
ছোট মোবাইল কার্ট/ভেহিকল এর ডিজাইন স্কেচ করে টাংগাইলের ওয়ার্কশপে বানিয়েছে সেই ভেহিকলটি।
কার্টটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অনেকটা শপরাইডার বা ইলেক্ট্রিক মোবিলিটির মত। কার্টের জানালার গ্লাস কেটে দুইটা গ্লাভস (কিওস্কে যেমন থাকে) আটকে দেয়া হয়েছে। স্টেথোস্কোপের জন্য একটা ছিদ্র আছে গ্লাসে। ছিদ্রগুলো রাবার দিয়ে সিল করে দেওয়া। রোগী দেখে কার্টটি করোনা ইউনিট থেকে বের হলেই ব্লিচিং সলিউশনে শাওয়ার দেওয়া যাবে। এটি শব্দহীন, ব্যাটারিচালিত, উপরের কেবিনটি যতটা সম্ভব এয়ারটাইট যেন জীবাণু ঢুকতে না পারে।
মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই ও চমৎকার একটা গাড়ি তৈরি করিয়েছে টাঙ্গাইলের মো: আল-আমিন নামের এক উদ্যমী তরুণ ও তার টিমের সহায়তায়।
টাঙ্গাইলের ওয়ার্কশপে এই কার্টটি এত চমৎকারভাবে তৈরি করা এক বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে, এই কাজে আল আমীনের আন্তরিক ভূমিকা আসলেই প্রশংসার দাবিদার।
ডা. শাহ আলমের সাথে কথা বলে জানা গেলো পরবর্তী ভার্সনগুলোতে মডিফিকেশন করা হবে। পরের গাড়িগুলোতে দুইপাশেই স্বচ্ছ পিভিসি শীট লাগানো হবে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত।
ব্যাটারিচালিত গাড়িটির দরজা এয়ারটাইট এবং ব্রেকের ব্যবস্থা আছে। পিপিইর বদলে এটা ইউজ করা মানে হল এটাকে পিপিইর সমান সেইফটি ডেলিভারি দিতে হবে।
তাই রাবার সীলের সাথে বিশ্বখ্যাত Buna N Gasket Material ইউজ করে দরজা সীল করে কেবিন এয়ার টাইট করা হয়েছে। মেঝে থেকে ছাদ সর্বত্র ছিদ্র বন্ধ করা হয়েছে।
এতকিছুর পরও কিছু লিক থাকতে পারে, তবে সেটা মাস্ক, পিপিইসহ প্রায় সব প্রতিরোধী ব্যবস্থাতেই আছে। সংক্রমণের সম্ভবনা ন্যূনতমে নামিয়ে আনাই আসল লক্ষ্য। ভিতরে আরও আছে বরফ কুল্ড এয়ার কুলার আর একটা ছোট অক্সিজেন ক্যানিস্টার; যদিও আধা ঘণ্টায় কোন সাফোকেশনের লক্ষণ দেখা যায় নি।
এটি এখন ব্যবহার করা হচ্ছে টাঙ্গাইলের একটি উপজেলার হাসপাতালে। ডাক্তাররা রীতিমত ইম্প্রেসড। ডা. মো. শাহ আলম ও তার সাথে বেশকিছু শ্রদ্ধেয় ডাক্তার মিলে মেডিকেল ও ডাক্তারদের নিরাপত্তার পার্সপেক্টিভ গুলো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন।
তেমন কোন অভিযোগ মেলেনি এখনও। করোনা ইউনিটে পারতঃপক্ষে কেউ যেতেই চাইতেন না। এখন যাচ্ছেন। গ্লাভসে হাত বের করে কাজও করা যাচ্ছে। আকারে সরু হওয়ায় সব জায়গায় চলাচল করতে পারছে অনায়াসে।
খরচ পড়ল প্রায় দেড় লাখ টাকা। সম্পূর্ণ দেশে তৈরি, এই গাড়ি সব জেলা শহরের ওয়ার্কশপগুলোতেই নির্মাণ সম্ভব। মুগদা হাসপাতালে ডেমো হবে ঈদের পর। যেকোন আকারের সবরকমের মানুষই অনায়াসে এঁটে যাচ্ছেন। স্কেল আপও শুরু হচ্ছে শিগগিরই। এর পর থেকে আরও উন্নত, আরও নিরাপদ, আরও ইউজার ফ্রেন্ডলি করা হবে বলে জানালেন ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ তালুত।
এই অনন্যসাধারণ উদ্ভাবনটির উদ্যোগ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য ছোট ভাই ডা. শাহ আলম উৎসের সহধর্মীনি শামীম আরা নিপা এবং প্রকৌশলী মুহাম্মদ তালুতকে প্রাণঢালা অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা।
উদ্ভাবনী আইডিয়া চিন্তা করার চেয়ে তা বাস্তবায়ন শতগুণ বেশি কঠিন। নিপা সেটা করে দেখিয়েছে। ওঁর মহানুভবতা ও প্রচেষ্টা অনুকরণীয়। প্রশাসন সার্ভিসে থেকেও যে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার কথা ও এভাবে ভেবেছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।