চকবাজারের এমএস টেইলার্সে এক সন্ধ্যায় বসে বসে ঝিমোছিল্লাম। দুই নম্বর সুতির কাপড় বলে গুদামে পড়ে ছিলাম এক বছর। মেডিকেলে ভর্তি হল ছেলেদের পাল। ফাহাদ এলো, নাসিরাবাদ, মেডিকেল হোস্টেল থেকে। টেইলারের সাথে কথা বলল। কম দামে, কম সময়ে, সাদামাটা একটা এপ্রনের অর্ডার দিতে হবে, এডভান্স নাই। তাড়াহুড়ো করে কয়েক গজ সাদা কাপড় কিনে ফাহাদের শরীরের মাপ নিল টেইলার। ইমার্জেন্সি ডেলিভারি দিতে হবে বলে টেইলার সেলাই করার সময় ডান পাশের পকেটটা দুর্বলভাবে সেলাই করে এবং উপরের বোতামের চার ছিদ্রের মাঝে দুই ছিদ্র দিয়ে কোনমতে সুতা চালিয়ে দেয়। দরজি তার দোকানের নাম-ঠিকানা ছাপানো একটি কাগজের প্যাকেটে জন্মত্রুটি নিয়ে আমাকে ফাহাদের হাতে ডেলিভারি দেয়। চকবাজার থেকে টেম্পুতে চড়ে নাসিরাবাদ পর্যন্ত আসে ফাহাদ। নতুন রুমমেট ফাহিমের সাথে দেখা হল টেম্পু থেকে নেমে। হাড়কাঁপুনি শীতে ঠাণ্ডা লেগেছিল ফাহিমের ঠাণ্ডা লেগেছে। ফাহাদের হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে আমার উদ্বোধন করল গলায় পেঁচিয়ে, ‘আমার মাফলার নাই, বাড়ি থেকে আনতে ভুলে গেছি’।
ওড়নার মতো করে মাথার হুড আর গলার মাফলার, দুই ফর্মুলা এক করে শীতের সুরক্ষায় আমার এমন টেকনিক্যাল ব্যবহার করলো যে, ফাহিমের গলা থেকে বারবার প্যাঁচ খুলে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, পারিনি। সারারাত কাশেমের নাকডাকা, গলাডাকা শুনতে শুনতে আমার কী যে অসহ্য লাগছিলো, ইচ্ছে করছিল গলাটা ভালভাবে টিপে দিই।
ফাহাদের ছাতা নেই, কখনো ছিল বলে মনেও হয় না, গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে আমিই তার একমাত্র ভরসা। বৃষ্টি আমার খুব প্রিয়। ফাহাদ না হলে সে সুযোগটা কখনো হত কিনা কে জানে। ফাহিম সাথে দেখা করতে কয়েকজন বন্ধু রুমে এলো। কয়েক মাস হল ক্লাসের, সবাই অটোতে যেতে চায়, এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমারও অটোতে যেতে খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কোথায় যাব, কার সাথে থাকব। এখানেতো কিছু একই রঙের বন্ধু আছে। রুমে এলে, মেডিকেলে এলে বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। এসব যখন ভাবছিলাম ঠিক তখন আমার হাতার ভেতরে দিয়ে একটা তেলাপোকা তিরতির করে চলে যায়। আমার যা কুতুকাতু লেগেছিল না! কয়েকদিনের মাথায় কোন রকম সতর্ক বার্তা না দিয়ে হঠাৎ করে সবাই অটোতে চলে গেল। বদ্ধ ঘরে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ। আমার গায়ে ছত্রাক বাসা বাঁধল, বিশেষ করে বগলের তলায়। এক প্যাকেট সার্ফ এক্সেল, দুই লিটার জল এবং দুইটি কিটোকোনাজল ট্যাবলেট মিশিয়ে একদিন ভিজিয়ে রাখল আমাকে। পরদিন বাতাসে সামান্য পচা গন্ধ ছড়াচ্ছিলাম বলেই হয়তো আমার কথা ফাহাদের মনে পড়ল। ধুয়ে রোদে শুকাতে দেয়। সারারাত কুয়াশায় ভিজে ভিজে জীবনানন্দের কবিতা জপছিলাম তখন, ফাহাদ এসে টান দিল। আড়মোড়া করে ব্যাগে ঢুকিয়ে হালকা ভেজা আমাকে নিয়ে দৌড় দিল, ‘এই রিকশা, দাঁড়াও। মামা, কুইক, মমতাজ আফার ক্লাস শুরু হয়া গেছে’।
আমারও এক বন্ধু আছে, যদিও সে একটু ভাবুক টাইপের। ‘ন’ আদ্যক্ষরে তার মালিকের নাম। ভাবুক বন্ধু আমার হ্যাঙ্গারে ঝুলে দুলতে দুলতে সারাক্ষণ কী যেন ভাবে আর ভাবে। আমি খাটে শুয়ে, চেয়ারে বসে ফাহাদের প্যান্ট, শার্টের সাথে আড্ডা দিতে দিতে ওর কথা ভাবি, বেচারার কপাল ভালো, মালিক তার খুব যত্ন নেয়। কাপড় ধোয়ার নির্দিষ্ট ব্রাশে সামান্য ধুলিবালি পড়া চেহারা এতো ঝকঝকে করে দেয় যে মনে হয় মিনা ফেসিয়াল করে এইমাত্র রাস্তায় নামল। উল্লেখ্য, মিনার সাথে ফাহাদের ইটিশপিটিশ হয়। এ পৃথিবীতে এ কথা আমি আর ওরা দুইজন ছাড়া আর কেউ জানে না।
প্রফের ভাইভা ঘনিয়ে এলে প্রতিবছর আমাদের এক মহাসমাবেশ হয়। লন্ড্রিতে জমজমাট রিসেপশন শেষে আমরা ব্যাডমিন্টন কোর্টের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দড়িতে ঝুলতে ঝুলতে মতবিনিময় করি। সারা বছরের কথা চলতে থাকে। রোদের তেজের সাথে পাল্লা দিয়ে চলে আমাদের গালগপ্প। বিকেলের দিকে আমরা সবাই ফুয়েল ফুরিয়ে যখন ডিহাইড্রেটেড তখন লন্ড্রির দাদু এসে আমাদের কান ধরে টান দেন। দাদুর হাতে, ঘাড়ে চড়ে চলে আসি ফের লন্ড্রিতে। উষ্ণ বিদায় নিয়ে আমরা লন্ড্রির তাকে ঝিমুতে থাকি, কখন ফাহাদ বা ফাহিমরা রশিদ দেখিয়ে মালিকানা প্রমাণ করে আমাদের ছাড়িয়ে নেবে।
লিখেছেন- ওমর ফারুক
৫১ ব্যাচ সিএমসি
প্ল্যাটফর্ম ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যা থেকে চয়নিত।