বৃষ্টিস্নাত মন খারাপের বিকেলে জানালা দিয়ে আকাশ থেকে বৃষ্টির নেমে আসা দেখছি। কেমন একটা করুণ কান্নার মত লাগছে আজকের বৃষ্টি পড়ার শব্দ। আকাশের মনে হয় আজ মন খারাপ।সকাল থেকে অজোরে ঝরে যাচ্ছে। তবে মন খারাপ আমার।
একটু আগে ফোন দিয়ে আমার বন্ধু সোফিয়া বল্ল, “হারামজাদারে ডিভোর্স দিছি গতকাল,আর সহ্য হচ্ছিল না এই পোকামাকড় এর জীবন” আমি চুপ করে আছি দেখে বল্ল,তুই আমার বাচ্চাদের জন্য মন খারাপ করিস না। আমি নিজ পায়ে দাঁড়াব। জব পেলে বাচ্চাদের আমার কাছে নিয়ে আসব।সে ফোনে বিভিন্ন প্লানিং বলে যাচ্ছে। আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছি। সে আমাকে বলে, আমি ন্যাশনাল ভার্সিটি তে আমার সাব্জেক্টে সারা দেশে ১৬ তম হয়েছি। তোর মত ব্রিলিয়্যান্ট না,তবে একবারে খারাপ না। সোফিয়ার আত্মবিশ্বাস দেখে ভাল লাগছে মনে মনে।আমাকে ব্রিলিয়্যান্ট বলাতে বিব্রত লাগছিল।
সোফিয়া আমার খুব ভাল বন্ধু।অনেক দিনের জানাশোনা। বন্ধুদের আড্ডায় সে গল্পবাজ মেয়ে।সবাইকে সুন্দর করে কথার বাশ দেওয়াতে সে নাম্বার ওয়ান।বন্ধু পচানোর রানী হিসেবে সে যথেষ্ট সুনাম পেয়েছে।অনেক মজা করে কথা বলে।
চোখ দেখে বুঝার উপায় নেই কতটা বিষাদে ভরপুর তার জীবন। ক্লাস ফাইভে বাবা মারা যায়।ক্লাস সিক্স এ মামার বাসা থেকে লেখাপড়া শুরু,সাথে মামীর অত্যাচার, অনাদর ও অবহেলা ফ্রি।এই মেয়ের অসীম সহ্য ক্ষমতা।মামী এত বাজে ব্যবহার করত কিন্ত কোনদিন কাউকে কিছু বলত না।
অনার্স এ ইডেন এ ভর্তি হয়ে হলে উঠে। নতুন জীবন শুরু।মাস্টার্স এ পড়ার সময় বান্ধবী অনির বোনের বিয়েতে পরিচয় রাশেদ এর সাথে।রাশেদ রাজশাহী ইউনিভারসিটি তে পড়ত। সে প্রচন্ড পাগলামি শুরু করে সোফিয়া কে বিয়ে করার জন্য।
সোফিয়ার ফাইনাল দিয়ে হল ছাড়তে হবে,একটা আশ্রয় তারও দরকার ছিল। রাশেদ এর ভালবাসার তীব্র পাগলাটে প্রকাশ সোফিয়া কে দূর্বল করে ফেলে। অবশেষ এ ফাইনাল এক্সাম এর আগে বিয়ে হয় তাদের। বিয়ের তিন মাসের মাথায় সোফিয়া প্রেগন্যান্ট হয়। ৬ মাসের বাচ্চা পেটে নিয়ে ফাইনাল এক্সাম দেয় সে। প্রথম ছেলেটি জন্মদিতে গিয়ে মরতে বসে ছিল সে।সিজারিয়ান সেকশন এর পর শকে চলে যায় সোফিয়া। ডাক্তার আজ্রাইলের টানাটানি তে অনেক ধকল সামাল দিয়ে প্রথম যেদিন বাচ্চাকে কোলে নিল সে, সেদিন আনন্দ অশ্রুতে চোখ ভিজে ছিল তার।
বেকার স্বামী যখন রীতিমত বেকারত্ব এর অজুহাতে বাচ্চাটি এবরশন এর জন্য ওর গায়ে হাত তুলে সেদিন ই বুঝেছিল ভুল মানুষ এর হাত ধরে জীবন নদী পাড়ি দেওয়া সহজ হবে না তার জন্য।
পরের বছর সে আবার প্রেগন্যান্ট। আবার পেট কাটা। এবার মেয়ে। সংসার এর হাল ধরতে ও নিজ পায়ে দাঁড়াতে সোফিয়া একটি চাকুরী নেয়।রাশেদ এরও চাকুরী হয়। বিয়ের তিন বছর পর তারা স্বচ্ছল হয়।আস্তে আস্তে সুখ আসা শুরু করছিল।
কিন্ত সুখ বেশিদিন সইল না। রাশেদ জড়িয়ে গেল মাদকে।সোফিয়ার সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু হয়ে গেল।বাচ্চা ও সংসার এর খবর নেই। একদিন অফিস এর নাম নিয়ে বের হয়ে তিন দিন বাসায় ফিরে না।
মাদক এর ভয়াল ছোবল এ সোফিয়ার সুখ উড়ে গেল জানালা দিয়ে। আস্তে আস্তে সোফিয়ার দুঃখ গাথা উপন্যাসে রুপ নিচ্ছিল।
রাশেদ একদিন অফিস থেকে বাসায় এসে বললো,তার ট্রান্সফার হয়েছে সিলেটে।
ব্যাগ গুছিয়ে রাতেই সিলেট রওয়ানা দিল।সোফিয়া দুইটা ছোট্টছোট্ট বাচ্চা নিয়ে কিভাবে থাকবে কোন চিন্তাই করল না।
সিলেট গিয়ে রাশেদ তিন মাসের জন্য লা পাত্তা হয়ে গেল।ফোনে পাওয়া যায়না।মোবাইল বন্ধ রাখে।সপ্তাহ ১৫ দিন পর দোকান থেকে ফোন দিয়ে ১/২ মিনিট কথা বলে লাইন কেটে দিত।এই তিন মাসে এক টাকাও দিল না।এই দিকে মেয়ে হওয়ার পর দুই বাচ্চা নিয়ে কুলাতে পারছিল না, সোফিয়া তাই চাকুরী ছেড়ে দিল।
চাকুরী ছেড়ে দেওয়ার আরো কারন নাকি ছিল সোফিয়া বললো পরে জানাবে। রাশেদ জানতেও চাইল না কিভাবে চলছে সংসার।
সিলেট থেকে তিন মাস পর বাসায় ফিরল রাশেদ। দরজা খুলে দিল সোফিয়া।রাশেদ এর চেহারা দেখে আৎকে উঠল।পুরো দস্তুর নেশাগ্রস্থ একজন মানুষ এর রুপ নিয়ে বাসায় ফিরছে রাশেদ। সারাবিকেল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল সোফিয়া। রাতে রাশেদ সোফিয়ার সাথে মিলিত হতে চাইল। সোফিয়া আগ্রহ না দেখালে গলায় টিপে মেরে ফেলতে চাইল।রাশেদ চেঁচামেচি করল। রাশেদ বিশ্রী ভাষায় গালি গালাজ করলো এবং চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুললো !
রাশেদ এর মুখের ভাষা শুনে সোফিয়া বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। রাশেদ এর চিকিৎসা চলল। সোফিয়ার বড় ভাই এর সাপোর্ট এ সংসার চললো কয়েক মাস।
সোফিয়া রাশেদ কে সব মেন্টাল সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিল।সংসারের হাল ধরতে নিজে আবার চাকুরী নিল। অনেক দিন মাদক নেওয়ার কারনে রাশেদ এর ইরেক্টাইল ডিসফাংশন দেখা দিল।
সে প্রতিরাতে সোফিয়াকে সেক্সুয়ালি জাগাত কিন্ত কিচ্ছু করতে পারত না।রাশেদ ঘুমিয়ে যেত,সোফিয়ার শুরু হত তীব্র পেট ব্যাথা।সারা রাত সেই ব্যাথায় নীরবে অশ্রু ফেলত সোফিয়া। রাতের পর রাত এই অত্যাচার সয়ে গেল মেয়েটি।
রাশেদ সুস্থ হয়ে অফিস শুরু করল। কয়েক মাস ভাল ছিল। এই কয়েক মাস সোফিয়া কে জ্বালাতন করেনি। একদিন রাতে রাশেদ আবার ও মিলিত হতে চাইল,কিন্ত পারল না নিজের উইকনেস এর জন্য।
হঠাৎ সে সোফিয়া কে চড় থাপ্পড় মারা শুরু করল। সোফিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। রাশেদ বললো,তুই নিশ্চয় অন্য লোকের সাথে সম্পর্ক করেছিস নাইলে আমি কাছে আসলে আগ্রহ দেখাছ না কেন?
সোফিয়া কান্না করতে করতে বললো,প্লিজ রাশেদ থামো।
আমিও ত একটা মানুষ। তুমি ডাক্তার দেখাও।তুমি নিজে কিছু করতে পারো না,আবার আমার সাথে এই কেমন ব্যবহার।
রাশেদ সন্দেহপ্রবণ হয়ে গেল।এই অলীক সন্দেহ তীব্র থেকে তীব্র হতে লাগল। ফেসবুকে সোফিয়া কোন ছবি পোস্ট দিলে রাশেদ গালিগালাজ করত।বলতো কোন নাগর এর জন্য ছবি দিছ।তুই তুকারী করত।
একবার সোফিয়ার ছবিতে এক স্কুল ফ্রেন্ড কমেন্ট করল ” মায়াবিনী ” এই কমেন্ট দেখে রাশেদ সোফিয়ার সাথে ঝগড়া শুরু করল,কেন এই কমেন্ট।নিশ্চয় তুই ওই ছেলের সাথে প্রেম করিস, নইলে মায়াবিনী বলব কেন তোরে। সোফিয়া যখন রাগ করে বল্ল,আমি শুধু প্রেম করিনা, শুইছি ওই পোলার লগে, এটা বলার সাথে সাথে ঠাস ঠাস করে সোফিয়া কে চড় মারা শুরু করল রাশেদ।
রাশেদের সন্দেহ টা চরম মাত্রায় পৌঁছে গেল।ওর অফিস শেষ রাত ৮ টায়।বাসায় ফিরতে ফিরতে ৯ টা। সোফিয়ার অফিস ৪ টায় শেষ হলে ৫ টায় পৌঁছে যেত বাসায়। মাঝে মাঝে সোফিয়া বাসায় এসে দেখত রাশেদ তার আগেই বাসায় এসে বসে থাকত।এত তাড়াতাড়ি বাসায় কেন আসলো জানতে চাইলে রাশেদ রিয়েক্ট করত।সোফিয়া বুঝত সব।
প্রথম প্রথম সোফিয়া বিষয় টা কে পাত্তা না দিলেও রাশেদ এর আচরন দিন দিন অসহনীয় হয়ে পরলো।
রাশেদ এর মনে বদ্ধমূল বিশ্বাস জন্মে গেল যে সোফিয়া অন্য কারো সাথে ফিজিক্যাল রিলেশন করে বা পরকীয়া করে। কিন্ত সোফিয়া এইসব থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে। সোফিয়া মোবাইলে কথা বললে,রাশেদ সতর্ক ভাবে শুনার চেষ্টা করত কার সাথে কথা বলত।
অল্পতেই রেগে যেত রাশেদ। কথায় কথায় বাচ্চাদের সাম্নেই গায়ে হাত তুলত। অপমানজনক কথা শুনাত।অফিসে শাড়ি পড়ে গেলে খোঁচা মেরে কথা বলত।
মাঝে মাঝে দুপুরে বাসায় ফোন দিয়ে বাচ্চাদের জিজ্ঞাস করত তোমাদের আম্মুর সাথে বাসায় কেউ আসে নাকি। ৮বছর সংসার করে নিঃস্ব হয়ে এই পোকামাকড় এর জীবন থেকে গতকাল নিজের একক সিদ্ধান্তে বের হয়ে গেল সোফিয়া।
ভালবেসে বিয়ে করে ভালবাসার ছিটেফোঁটাও ফেল না। আমাকে যখন বল্ল,সব শুনে আমি বুঝে গেছি সোফিয়ার স্বামী রাশেদ ওথেলো সিন্ড্রোম বা প্যাথলজিকাল জেলাসি তে আক্রান্ত।
এটা একটা মানসিক রোগ যেখানে স্বামী তার স্ত্রী কে বা স্ত্রী তার স্বামীকে অবিশ্বাস ও তীব্র সন্দেহ করে এবং এদের মনে বদ্ধমূল ধারনা জন্মে তাদের সঙ্গী পরকীয়া করছে। শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত ট্রাজেডি নাটক ওথেলো তে ওথেলো তার সৎ ও সুন্দরি স্ত্রী ডেসডিমোনা কে পরকীয়ার অমূলক সন্দেহ থেকে হত্যা করে।
এই ঘটনার সাথে মিল রেখেই এই ভ্রান্ত বিশ্বাস ও সন্দেহপ্রবণ মানসিক ব্যাধির নাম রাখা হয় ওথেলো সিন্ড্রোম। ওথেলো সিন্ড্রোম এ আক্রান্ত রা নিজের সঙ্গীকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না।। সোফিয়া আমার বন্ধু।
হয়ত এই একটি ডিভোর্স বাঁচিয়ে দিল সোফিয়ার প্রান।
লেখকঃ
জোবায়ের আহমেদ
নির্বাহী পরিচালক,
ডাঃ জোবায়ের মেডিকেয়ার সেন্টার
প্ল্যাটফর্ম ফিচার রাইটারঃ
জামিল সিদ্দিকী
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ,গাজীপুর