জোস মুগেলে
ভাষান্তরঃ যায়নুদ্দিন সানী
আমাদের একজন বন্ধু, ডাঃ স্যাম ব্রিসবেন, সম্প্রতি মারা গেছেন। তিনি একজন লাইবেরীয় ডাক্তার ছিলেন আর মারা যান ভয়ঙ্কর, দুঃস্বপ্নসম রোগ, ইবোলায়।
লাইবেরিয়া থেকে খুব কম তথ্যই পাচ্ছিলাম। ডাঃ ব্রিসবেনের মৃত্যুর পরে আমরা জানতে পারলাম, আমরা যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি এমন অন্যান্য ডাক্তার আর নার্সরাও ইবোলায় আক্রান্ত হয়েছেন আর হয় মৃত্যুবরণ করেছেন আর নয়তো, যেমনটা আমরা সংবাদে দেখি, এক অপূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবার মাঝেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমরা সবাই যখন এমন একটা ফোন আসবার ভয়ে ভীত থাকি, তখন এই প্রশ্নটা মনে জাগে, আমরা কিভাবে মরবো, আর কিসের জন্য মরবো?
‘ভালো মৃত্যু’র একটি পুরনো ধারণা আছে—দেশের জন্য মৃত্যু, যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মত মৃত্যু। যুক্তি দেখানো হয়, একজন মানুষের সুখ নিয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন ধারণা করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ না আমরা তাঁর মৃত্যুর ধরন সম্পর্কে জানতে পারছি। গ্রীক ধারণা ছিল, আমরা সবাই মারা যাব আর আমরা সবচেয়ে ভালো যা প্রত্যাশা করতে পারি তা হচ্ছে, আমাদের মৃত্যু যেন আমাদের পরিবার বা মানবতার কাজে লাগে।
আমাদের মত জরুরী চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের জন্য, ‘ভালো মৃত্যু’র ধারনাটি অনেক বেশী বিমূর্ত, অনেক বেশী অধরা। খুব কম সময়ই আমরা এমন মৃত্যু দেখতে পাই, যেগুলোকে বলা যায় ভালো কিংবা উপকারী। আমরা দেখি আঘাত পেয়ে মৃত্যু, দীর্ঘ রোগ ভোগের পরে কোন বৃদ্ধের মৃত্যু, কিছু আত্মহত্যা, আর নয়তো মদ, ধুমপান কিংবা খাবারের আধিক্যজনিত মৃত্যু।
গতবছর, ‘ডিজাস্টার-মেডিসিন’ ফেলোশিপ প্রোগ্রামে, লাইবেরিয়ার একমাত্র অ্যাকাডেমিক রেফারাল হাসপাতালে, মনরোভিয়ার জন এফ কেনেডি মেমোরিয়াল মেডিকেল সেন্টারের সঙ্গে আমরা এক পার্টনারসিপে যাই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় ‘ডিজাস্টার প্ল্যানিং’ প্রোগ্রাম তৈরি করি। আর ইমারজেন্সি বিভাগের স্টাফদের সঙ্গে টিম গঠন করে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ট্রেনিং এবং গবেষণার ব্যবস্থা করি। এখানেই আমরা ডাঃ ব্রিসবেনের সঙ্গে পরিচিত হই। তিনি ছিলেন সেখানকার নির্বাহী পরিচালক। একজন জরুরী বিভাগের ডাক্তার হিসেবে তিনি আমাদের মন জয় করে ফেলেন। সারাক্ষণ খোঁজ নিচ্ছেন। এই মুহূর্তেই হাসিখুশি আবার এখনই গম্ভীর। সংক্ষেপে, টাক মাথার, বাদামী চামড়ার আর মোটা চশমা পরিহিত লোকটি, খোলাখুলি আর সহজে কথা বলতেন।
যখন আমরা হাসপাতালের দুর্বলতাগুলোর প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ করলাম, তখন আমরা আমাদের আশংকাগুলোর কথা বললাম। ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার সরঞ্জামের অভাব, নিয়মিত ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাওয়া এবং মাঝে মাঝে বিদ্যুতের তারে আগুন লেগে যাওয়া। উত্তরে ডাঃ ব্রিসবেন আমাদের জানালেন, তিনি সবেচেয়ে বেশী ভয় পাচ্ছেন, এক ভাইরাসজনিত রক্তক্ষরণকারী জ্বরের মহামারী আকার ধারণ করার। তাঁর ভয় পাওয়ার কারণও ছিল। আমরা দেখলাম ‘গ্লোভস’ দেয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে রেশন ব্যবস্থা। হাত ধোয়ার সাবানের সরবরাহও বেশ অল্প। আর কর্তৃপক্ষও ইতস্ততঃ করছে এমন সার্বজনীন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। সম্ভবতঃ অর্থের অভাব। এখন যে মহামারী তারা মোকাবেলা করছে, তাঁর জন্য না হাসপাতালটি, না ১.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার শহরটি, কেউই প্রস্তুত না।
জেএফকে তে থাকবার সময়, আমরা ডাঃ ব্রিসবেনের বন্ধু হয়ে যাই। আমরা জানতে পারি তিনি ১৯৭০ সালে জার্মানিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এরপরে তিনি কাজ করার জন্য লাইবেরিয়ায় ফিরে আসেন। যদিও চার্লস টেলারের সেই সময়কালে তখন দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে, তারপরও তিনি থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর চারপাশে চলা এতোসব রক্তপাতের মাঝেও তিনি রুগি দেখা চালিয়ে যান। দেশটির নতুন গণতান্ত্রিক নির্বাচিত সরকারকে এবং হাসপাতালের একজন নারী পরিচালককে তিনি অভিনন্দন জানান। তিনি একটি সফল কফি খামার চালাতেন আর যখনই আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম, আমাদের ব্যাগ ভর্তি কফি দিতেন। তাঁর নিজের আট সন্তান এবং চার জন দত্তক সন্তানের বাবা ছিলেন। আর সারা বিশ্বে তাঁর অসংখ্য নাতিপুতি ছিল।
২০১৪এর জুনে, মনরোভিয়ার আমাদের ফেরত আসবার কিছুদিনের মধ্যেই, ইবোলায় আক্রান্ত শহরের প্রথম রুগী, হাসপাতালে আসে। আর শীঘ্রই আমরা জানতে পারি ডাক্তার এবং কিছু নার্স মারা গিয়েছেন। রটনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, আর স্টাফরা হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে যায়। জেএফকে তে আমাদের সহকর্মীরা দুশ্চিন্তায় পরে যায়। জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মধ্যে তখন উত্তেজনা চলছে। একজন সন্দেহজনক ইবোলা রুগী আসলে কি করণীয় সে ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। কিভাবে স্টাফরা নিজেদের প্রতিরক্ষা করবে? কিভাবে তাঁকে ‘আইসোলেশান’ এ রাখবে? কিভাবে তারা মন্ত্রণালয়ের একমাত্র ‘আইসোলেশান সেন্টার’এ নিয়ে যাবে? ডাঃ ব্রিসবেন ছিলেন বেশ ভীতু। যখন তিনি দেখতেন আমরা তাঁর দিকে তাকিয়ে নাই, তখন তিনি ভয়ে ভয়ে নিজের মনে কথা বলতেন, তাঁর হাসি গায়েব হয়ে যেতো। তিনি সর্বসমক্ষেই বলতেন কিভাবে তিনি নিজেকে রক্ষা করবেন। তিনি আমাদের বেশ রুক্ষভাবেই বলেছিলেন, ‘মনরোভিয়া ছেড়ে চলে যাও’।
একদিন সকালে, সময় তখন সাতটা, আমরা হাসপাতালে পৌঁছেই দ্রুত ডাঃ ফিলিপ জকনিস আয়ারল্যান্ডের কাছে গেলাম। সে আমাদের একজন তরুণ চিকিৎসক। সে বেশ রেগে গেছে। ভীতি তাঁর মুখে পরিস্কার দেখা যাচ্ছেঃ জরুরী বিভাগে একজন রুগী শুয়ে আছে, সন্দেহ করা হচ্ছে ‘ইবোলা’। রুগীটি সেখানে একটি বিছানায় শুয়ে আছে। জায়গাটা ছোট, সেখানে অনেক লোক আর সেখানে সে শুয়ে আছে ছয় ঘণ্টা ধরে। তাঁর উপসর্গ আবিস্কার হওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁকে ঘিরে ছিল নার্স এবং অন্যান্য রুগীরা। আমরা দ্রুত ডাঃ ব্রিসবেনের কক্ষে গেলাম। সেখান তাঁর এবং মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডাঃ আব্রাহাল বারবারের সঙ্গে দেখা করলাম। অন্যান্যরাও বুঝতে পারলো, কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। রুগীরা এবং তাদের পরিবারের লোকেরা দ্রুত পালিয়ে গেল। নার্সরাও ঘর থেকে যতটা দূরে সম্ভব চলে গেল।
প্রথম অগ্রাধিকার ছিল, রুগীটিকে সেই সাধারণ কক্ষ থেকে বের করে ‘আইসোলেশান কক্ষে’ নিয়ে যাওয়া। কিন্তু যে বিছানায় রুগীটি শুয়ে আছে সেটি এতোটাই চওড়া যে দরজা দিয়ে বের করা সম্ভব না। তাই, ডাঃ ব্রিসবেন, ডাঃ বারবার আর দুইজন দ্রুত পোশাক পরে নিলেন, হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক। এরপরে তারা রুগিটিকে ওঠালেন। ম্যাট্রেস সহ। এরপরে ‘আইসোলেশান কক্ষে’ নিয়ে গেলেন। নিয়ে যেতে যেতে তারা প্রায় ফেলেই দিচ্ছিলেন। একজন তো হাপাতে লাগলো। তাঁর প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও রুগীটি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মারা গেল। সেইদিন পরের দিকে ল্যবরেটরিতে পরীক্ষা করে জানা গেল, রুগীটির সত্যিই ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করার আগে পর্যন্ত মৃত ব্যক্তিটি জরুরী বিভাগেই পরে ছিল।
আমরা পরের সপ্তাহ মনরোভিয়ায় থেকে গিয়েছিলাম আর যতটা সম্ভব সাহায্য করেছিলাম। ডাঃ ব্রিসবেন তাঁর নিজের থার্মোমিটার এনে প্রতিনিয়ত নিজের তাপমাত্রা দেখতেন। সারাক্ষণ ভয়ে থাকতেন, কখন হঠাৎ জ্বর হয়। হাসপাতালে তিনি নিজেকে রক্ষার জন্য সারাক্ষণ ফেডোরা (এক ধরনের টুপি) পরে থাকতেন। তারপরও তিনি আমাদের সঙ্গে রসিকতা করতেন।
কিছুদিন পরে আমরা আমেরিকায় ফিরে আসি। মনরোভিয়ার এক বন্ধুর কাছ থেকে কিছুদিন পরে ফোন পাই, ডাঃ ব্রিসবেনকে ‘আইসোলেশান কক্ষে’ রাখা হয়েছে আর পরীক্ষায় সনাক্ত হয়েছে তাঁর শরীরে রয়েছে ইবোলা ভাইরাস। এর পরের ফোনে তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে জানতে পারলাম আর জানলাম খুব দ্রুত তাঁকে তাক কফি খামারে কবর দেয়া হয়েছে। আগস্টের শেষের দিকে, ডাঃ আয়ারল্যান্ড এবং আমাদের পরিচিত একজন নার্সও ইবোলায় আক্রান্ত হন এবং মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন। ডাঃ বারবার এবং জরুরী বিভাগে কাজ করা একজন চিকিৎসকের সহকারীও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
ডাঃ ব্রিসবেনের জেএফকে তে থাকা এবং রুগি দেখা চালিয়ে যাওয়া জরুরী ছিল না। তিনি অবসর নিয়ে তাঁর কফি খামারে তাঁর স্ত্রী পুত্র আর নাতিপুতি নিয়ে সময় কাটিয়ে দিতে পারতেন। তিনি ইবোলাকে ভয়ও পেতেন, তারপরও আমরা জানতাম, সকালে জরুরী বিভাগে ঢুকলেই দেখবো, তিনি রুগী দেখছেন।
রুগীদের প্রতি চিকিৎসক এবং নার্সের একটি দ্বায়িত্ব আছে। আমরা যে প্রশিক্ষণ পেয়েছি আর যেকোনো অবস্থায়ই আমরা আমাদের কর্তব্য করে যাওয়ার যে অলিখিত সামাজিক চুক্তি আমরা করেছি, তার কারণে আমাদের কাছে প্রত্যাশা করা হয়, নিজের প্রতিরক্ষার সাধন না থাকলেও, আমরা আমাদের কর্তব্য কর্তব্য যাব। তবে আমাদের নিজেদের প্রতি এবং আমাদের পরিবারের প্রতিও আমাদের দ্বায়িত্ব আছে। আর যখন আমাদের কাজের কারণে আমরা মৃত্যুঝুঁকিতে পরি, তখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে, আমরা আমাদের রুগির কতোটা উপকার করতে পারবো, আর তাঁর জন্য আমাদের কি মূল্য দিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে আমরা সঠিকভাবে আমাদের কর্তব্য পালন করতে পারবো, এমনটা প্রত্যাশা করা অনুচিত। তবে পৃথিবীর প্রথম ইবোলা মহামারীতে, ডাঃ ব্রিসবেনরা থাকেন প্রথম সারিতে—আর এ কারণে মারা যান। নিজেকে ঝুকির মধ্যে ফেলেও তারা রুগী দেখেন। অপর্যাপ্ত সরবরাহ, জীবাণু সংক্রমণ রোধের ওপর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের কাজ করে যান।
ডাঃ ব্রিসবেনের মৃত্যু মানুষ হিসেবে আমাদেরকে ছোট করে দেয়। তাঁর স্ত্রী এবং তাঁর পরিবারের প্রতি ক্ষমা চেয়েই বলছি, তাদের চরম ক্ষতি হয়েছে তবে আমাদের বন্ধু একটি ‘ভালো মৃত্যু’ পেয়েছে। যেমনটা পেয়েছে সেই সব নার্স, ডাক্তার। তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন এই ভয়ানক রোগে আক্রান্ত রুগীদের সেবা করতে গিয়ে।