একটোপিক প্রেগন্যান্স
একটোপিক প্রেগন্যান্সী/গর্ভধারণ সাধারণ মানুষের কাছে যেটা টিউবে বাচ্চা বলেই বেশী পরিচিত,যদিও টিউব ছাড়াও ডিম্বাশয় বা প্রজননতন্ত্রের অন্য যেকোন অংশেও ভুলক্রমে আটকে যেতে পারে ভ্রুণ। নিষিক্ত ডিম্বানুর স্বাভাবিক বিছানা,জরায়ু ছাড়া অন্য যেকোন স্থানে বেড়ে উঠাকেই আমরা বলি একটোপিক প্রেগন্যান্সী। এসকল এক্টোপিক স্থানের মধ্যে ডিম্বনালি/টিউবে আটকানোর সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশী,এ কারণে এটা সাধারণের কাছে কিছুটা হলেও পরিচিত।
প্রতিনিয়ত এরকম অসংখ্য রোগীর সম্মুখীন হচ্ছেন এদেশের গাইনী ডাক্তাররা। এবং মজার বিষয় হচ্ছে, এই রোগীরাও বৈচিত্র্যময়। এর পাশাপাশি এটি নিয়ে উদ্বিগ্নতার মূল কারণ হল,এই সমস্যার কিছু ভয়ঙ্কর দিক রয়েছে।
প্রথমতঃ এসব রোগীর খুব অল্প সময়ের মাসিক বন্ধের ইতিহাস থাকে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সেটাও থাকেনা। যেমন ধরুন, রোগী বলতে পারে আমার মাসিকের তারিখ আরও দুদিন পরে। কিংবা, এইতো দুদিন আগে তারিখ ছিল, হয়নি।
সুতরাং,বুঝিয়ে বললেও একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী আমাদের কথা বিশ্বাস করেনা যে, এটা গর্ভজনিত জটিলতা হতে পারে।
দ্বিতীয়তঃ এসব ক্ষেত্রে হুট করেই উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন ধরুন, বলা নেই, কওয়া নেই, তীব্র ব্যথা হয়েই রোগী অজ্ঞান। কিংবা, হুট করেই পেটে এমন তীব্র ব্যথা যে রোগী স্থির থাকতে পারছেনা।
তৃতীয়তঃ কিছু বিভ্রান্তিমূলক উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যেমন, তীব্র ব্যথার সাথে মাসিক শুরু হয়েছে। কিংবা, তলপেটের তীব্র ব্যথার পরে উপরের পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে। এমনকি এমনও রোগী পেয়েছি যে প্রথমেই উপর পেটে তীব্র ব্যথা নিয়ে এসেছে যা অনেকটাই গ্যাস্ট্রিক এর ব্যাথার মত।
চতুর্থতঃ এই ঘটনা গুলোতে রোগী এবং ডাক্তার উভয়ের হাতে সময় থাকে খুব কম। উপসর্গ দেখা দেয় একেবারে এমন পর্যায়ে যখন রোগী খুব দ্রুত খারাপ হতে থাকে।
একবার কল্পনা করুন,পেটের ভেতরে একটা নালী ফেটে গিয়ে প্রবল বেগে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কি ঘটতে পারে? সহজ ভাষায় যদি বলা হয় , মুহূর্তে রোগী রক্তশুণ্য হয়ে মারা যেতে পারে। ফলে এসব সমস্যা ধারণা করলে ডাক্তাররা সময়ের হিসাব করে শুধু মিনিটে নয়,সেকেন্ডে।
পঞ্চমতঃ সমস্যা ধরা পড়ার সাথে সাথেই এইসব রোগীর অপারেশন (অস্ত্রপচার)করতে হয় অতি দ্রুত গতিতে। এবং অপারেশন (অস্ত্রপচার)করতে হলে হাতে রক্ত থাকা খুব জরুরী।আর সেটা হওয়া উচিত নতুন, তাজা রক্ত। আমাদের দেশে জরুরী ভিত্তিতে তাজা রক্ত জোগাড় করা কতোটা কঠিন তা এদেশে যাদের দরকার হয় তারা আর ছাড়া আর কে জানে!
রোগীর শত শত উদগ্রীব লোকজন হঠাৎ আবিষ্কৃত রোগে উত্তেজিত হয়ে আশেপাশে ঘোরাঘুরি করলেও নিজ শরীর থেকে রক্ত দিতে এরা খুবই শারীরিক দূর্বলতা অনুভব করে। যেমন ধরুন, স্বামী বলবে, আমাকে তো অনেক কাজ করতে হয়, আমার পক্ষে রক্ত দেয়া সম্ভব নয়। শাশুড়ি বলবে, না না আমার ছেলেদের শরীর এমনিতেই দূর্বল। এরা রক্ত দিতে পারবে না।
এখন আসা যাক, এসব ভয়ংকর ঘটনার পেছনের সেই অঘটনঘটনপটুয়সীর রহস্য।
একটু পেছনে গেলে দেখি, ডিম্বানু নিষিক্ত হয় মূলতঃ জরায়ুর উপরের দিকে কানের মত ঝুলে থাকা দুটি ডিম্বনালি/টিউবের একটিতে। নিষিক্ত ডিম্বানু এরপর সাঁতরাতে সাঁতরাতে এসে জরায়ুতে ঢুকে সেখানেই প্রতিস্থাপিত হয় এবং ধীরে ধীরে বড় হয়ে মানব আকৃতি ধারণ করে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
এখন,এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি যদি কোনভাবে বাঁধাগ্রস্ত হয়! ধরুন,নিষিক্ত ডিম্বানুটি কোন কারণে ডিম্বনালি/টিউব থেকে জরায়ুতে আসতে পারল না, তাহলে ঘটনা কি ঘটবে? একটু চিন্তা করুন তো!
এই ফাঁকে আমরা বরং জেনে নিই, বাঁধা প্রাপ্তির কারণ কি হতে পারে?
খুব সহজভাবে যদি বলি, তাহলে বলতে পারি দুটো কারণে নিষিক্ত ডিম্বানু বা ভ্রুন স্বাভাবিক গতিতে স্থানান্তরিত হতে পারছেনা।
১.ডিম্বনালি/ টিউবের ভেতরের যে পথ বেয়ে সাঁতরে ভ্রুণ জরায়ুতে আসে সেটা কোনকারণে নষ্ট হয়ে গেলে।
২.বাইরের কোন প্রভাবে টিউবের স্বাভাবিক গঠন নষ্ট হয়ে গেলে। হতে পারে সেটা সংক্রামণ,বড় টিউমার, এন্ডোমেট্রিয়োসিস (জরায়ুর সংক্রামণ) ইত্যাদি ইত্যাদি যেটা ভ্রুণের গতিপথটা বদলে দেয় বা বাঁধাগ্রস্ত করে।
যে কারণেই হোক না কেন, সময়মত ভ্রুণটি জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত হতে না পারলে সে ঐ টিউবের মধ্যেই বড় হতে থাকবে। কিন্তু ডিম্বনালি/টিউব তো জরায়ুর মত স্ফীত হতে পারেনা, সুতরাং নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করার সাথে সাথেই সেটা ফেটে যাবে। শুরু হবে পেটের ভেতরে প্রবল রক্তক্ষরণ।
মজার বিষয় হল, ভ্রুণ তৈরী হবার সাথে সাথেই জরায়ু তার ভেতরে ভ্রুণের জন্য বিছানা পাততে শুরু করে। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সে বিছানা পেতে অপেক্ষা করার পর যখন ভ্রুণের দেখা পায়না তখন বিছানা সরিয়ে ফেলে সেডের আকারে, অর্থাৎ স্বাভাবিক পথেই শুরু হয় রক্তপাত যা অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর মাসিক পিরিয়ডের ডেটের সাথে মিলে যায়। ফলে রোগী এটাকে স্বাভাবিক মাসিক বলেই ধরে নেয়। আর এখানেই রোগ নির্ণয়ে আরো জটিলতার সৃষ্টি হয়।
একটা বিষয় মনে রাখা খুবই জরুরী, সঠিকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ করার পরেও কিন্তু অনাকাঙ্খিত গর্ভধারন হতে পারে। কারণ, প্রতিটা পদ্ধতিরই একটা নির্দিষ্ট শতাংশ অকার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এবং কিছু কিছু পদ্ধতির অকার্যকারীতার জন্য একটোপিকের সম্ভাবনা বেশী থাকে।
সুতরাং, আমার গর্ভ ধারনের কোন সম্ভাবনাই নেই, আমার তো মাসিক হচ্ছেই, আমার তো গর্ভধারন পরীক্ষার ফল ঋণাত্মক ইত্যাদি বিষয়ে অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হবেন না।
আর একটা কথা তো বলে রাখা ভাল, গর্ভধারন পরীক্ষা কোন নির্ভর যোগ্য পরীক্ষা না। অর্থাৎ গর্ভ ধারন হলেও এটা ঋণাত্মক দেখাতে পারে আবার গর্ভ ধারন ছাড়াও এটা ধনাত্মক দেখাতে পারে।
এই ফাঁকে একটা তথ্য আপনাদের জন্য, আপনারা হয়তো জানেন না, ছেলেদের এক ধরনের টিউমারেও গর্ভ ধারন পরীক্ষার ফলাফল ধনাত্মক মানে হ্যাঁ সূচক দেখায়।
এখন আসা যাক আসল কথায়, কিভাবে প্রতিরোধ করব এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনা!
সত্যি বলতে কি এই ঘটনা প্রতিরোধ আসলেই কঠিন। তবে একটোপিকের ক্ষেত্রে কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর মানে ঝুঁকি পূর্ণ বিষয় কাজ করে আর যেগুলো এড়িয়ে চলতে পারলে কিছুটা প্রতিরোধ সম্ভব।
আসুন,জেনে নিই কি সেই ঝুঁকি পূর্ণ বিষয় সমূহ।
রোগী বা তার স্বামী কিংবা সংগীর, একের অধিক যৌন সংগী বা অবাধ যৌন মেলামেশা, ধূমপান করা, বারবার বাচ্চা নষ্ট করা, তলপেটে সংক্রামণ ,এমার্জেন্সী জন্মনিয়ন্ত্রণক বড়ির যথেচ্ছ ব্যবহার,পূর্বে ডিম্বনালি/ টিউবে কোন অস্ত্রপচার ( অপারেশন) এর ইতিহাস ইত্যাদি থাকলে একটোপিক প্রেগন্যান্সী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
উল্লেখিত প্রতিরোধযোগ্য বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া ছাড়াও, গর্ভধারনের পরিকল্পনা করার আগেই একজন স্ত্রীরোগ (গাইনী) বিশেষজ্ঞের পরামর্শ কমিয়ে দিতে পারে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত একটোপিক প্রেগন্যান্সীর হার।
ঘটনা প্রতিরোধ যদি নাও করা যায়, অন্ততঃ এই বেজায়গায় বেড়া ওঠা ভ্রুণ যেন দুর্ঘটনা ঘটাতে না পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজন সাধারণ জনসাধারণের সচেতনতা। এক্ষেত্রেঃ-
★ গর্ভ ধারন পরীক্ষা ধনাত্মক হলে অতি সত্ত্বর একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। অবশ্যই একটা স্ক্যান করে দেখে নিন,আপনার ভ্রুণ তার উপযুক্ত বিছানায় সময়মত পৌঁছেছে কি না!
★ মাসিক বন্ধ থাকুক বা না থাকুক, পেটে তীব্র ব্যাথা অনুভব করার সাথে সাথেই কিংবা হঠাৎ ব্যাথায় অজ্ঞান হলেই রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব নিকটবর্তী হাসপাতালে বা ক্লিনিকে নিয়ে যান।
একটা কথা মনে রাখা খুবই জরুরী,সময়মত ব্যবস্থা না নিলে ডিম্বনালি/ টিউবে বাচ্চা বা একটোপিক প্রেগন্যান্সীর জটিলতায় রোগী খুব দ্রুত মৃত্যুপথে ধাবিত হয়। পরিশেষে একটা কথা, একটোপিক প্রেগন্যান্সীর ক্ষেত্রে একটু বেশি সচেতনতার প্রয়োজন
বাস্তবতা এই যে, আমাদের দেশে বিবাহিত ব্যতীত অন্যান্য রোগীদের ক্ষেত্রে গর্ভজনিত এই জটিলতা একদিকে যেমন ধারণা করা মুসকিল, অন্যদিকে একবার ঘটনা উদঘাটনের পর রোগী পক্ষকে বোঝানোও বেশ জটিল। সুতরাং, প্রতিরোধই এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
লেখক
ফাহমিদা নীলা
এফ.সি.পি.এস ( স্ত্রীরোগ এবং প্রসূতি বিদ্যা)
জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনী)।
শাজাহানপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে,
শাজাহানপুর, বগুড়া
অনুলিখনে
সুমাইয়া নার্গিস সুগন্ধি
শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ
সেশন : ২০১৬–১৭.