প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩০শে জুন, ২০২০, মঙ্গলবার
লেখা: মঈনুল ইসলাম
চট্টগ্রাম মা-ও-শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ
আমাদের সবারই জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে একাকীত্ব বোধ হয়। আমরা যখন নতুন কোন শহরে যাই, নতুন মানুষদের ভীড়ে থাকি কিংবা একা কোন কাজ করে চলি তখনই নিজেদেরকে একাকী মনে হতে পারে। একাকিত্ব ব্যাপারটা আধুনিক যুগে এসে মারাত্নক রূপ ধারণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ৬০ শতাংশ তরুণ-তরুণী তাদের যৌবনে এসে একাকিত্ব বোধ করে। যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ মানুষ এই সমস্যাটায় নিয়মিত ভুগে থাকে।
আমরা আধুনিক যুগে এসে সবথেকে বেশি একে অন্যের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার সুযোগ পাচ্ছি। সোশ্যাল মিডিয়াগুলো আমাদের যোগাযোগকে অত্যন্ত সহজ বানিয়েছে। তবুও, এই যুগেই আমরা কিন্তু সবথেকে বেশি কানেক্টেড থেকেও সর্বোচ্চ একাকিত্বে ভুগি।
“একাকীত্বে ভোগা” আর “একা হয়ে যাওয়া” একই কথা নয়। আপনি একা থেকে ভালো আছেন নাকি খারাপ আছেন সেটা নির্ভর করে শুধুমাত্র আপনার উপরই। কেউ কেউ নিজেকে নিজে অফুরন্ত সময় দিয়ে ভালো থাকেন, ভীড়ের মাঝে যেতে চাননা তেমন, তারা কিন্তু আলাদা থেকেও নিজেকে কখনো একা ভাবেন না। শুধুমাত্র আপনি নিজেকে একা ভাবলেই একা হয়ে পড়েন, একাকিত্ব আপনাকে গ্রাস করে তখন।
একাকীত্বে ভোগা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তারা হয়তো আশেপাশের মানুষদের সাথে ঠিকমতো যোগাযোগ করে উঠতে পারছেন না, কিংবা কেমন আচরণ করা উচিত সবার সাথে তার সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। একাকিত্বের এই রোগ সমাজের সকল ধরনের মানুষকে আঘাত করে থাকে।
টাকাপয়সা, খ্যাতি, ক্ষমতা, সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব কোন কিছুই একাকিত্বকে থামাতে পারে না, এটা মানবদেহের বায়োলজিরই একটা উৎস। একাকিত্ব অনেকটা ক্ষুধা উদ্রেকের মতো, আপনার খুব খেতে ইচ্ছে করলে আপনি খাবার খান। একাকীত্বে ভুগলে মানুষের সামাজিক সাহায্যের প্রয়োজন হয়। আপনার মস্তিষ্ক এই সামাজিক চাহিদাকে গুরুত্ব দেয়, কারণ প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা দলবদ্ধ হয়ে যে কোন শিকার কিংবা কাজে যেত। কারণ, দলবদ্ধ শিকারে না নামলে সিংহ কিংবা বাঘের আক্রমণের মুখে পড়তে হতো। আবার, কাউকে দলছাড়া করে দিলে সে নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারতো না, খাবার সংগ্রহে ব্যর্থ হতো, অবশেষে মৃত্যুর মুখে পতিত হতো।
মানব মস্তিষ্কের গঠনটাই এমন যে, আমাদের বেঁচে থাকা, ভালো-মন্দ চিন্তাভাবনায় অন্যদের প্রভাব থাকে। সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমে যাতে আমরা একে অন্যকে সাহায্য করে বেঁচে থাকতে পারি, সেভাবেই প্রোগাম করা ব্রেইন। তাই সামাজিকতা আমাদের বায়োলজির একটা অংশ। আপনার আশেপাশে অনেকগুলো নির্দিষ্ট মানুষ আপনাকে সারাজীবন ঘিরে রাখবে, যাদের সাথেই চলাচল নির্ধারিত হয়ে যায় আপনার। একসাথে থাকা মানেই বেঁচে থাকার চেষ্টা, আলাদা জীবনযাপন নিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে, এমন বৈশিষ্ট্য প্রাচীনকাল থেকেই মানব বায়োলজিতে ঢুকে আছে।
আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলোশনের কারণে যৌথ পরিবারের গুলো ভেঙ্গে একক পরিবার হয়েছে, মানুষের কাজের পরিধি বেড়েছে, একটা নিজস্বতা ধারণ করতে গিয়ে মানুষ নিজেকে অন্যের থেকে আলাদা করে ফেলেছে দিনের পর দিন। আমাদের লাইফ যতোই উন্নত হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনও বেড়েছে, আমরা মানুষের সাথে মুখোমুখি যোগাযোগ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। বর্তমানে শিক্ষা, চাকুরী কিংবা নতুন সংসারের টানে পরিবার থেকে বহু দূরে অবস্থান করছি অনেকেই, যেটা একাকিত্বকে ডেকে আনে সমাজে।
অতীতে মানুষরা যতোটা মুখোমুখি সাক্ষাত করত, তার পরিমাণ বর্তমানে তুলনামূলক খুবই কম। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মূল ভূমিকা রাখে টাচ স্ক্রিন। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮৫ সালে একজন মানুষের ঘনিষ্ট বন্ধুবান্ধব ছিলো গড়ে ৩ জন, যেটা এখন গড়ে ২ জনে নেমে এসেছে। মানুষ এখন জীবনের গতিপথে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে যে পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সংসার-এই চক্রে সামাজিক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া আর গড়ে ওঠেনা।
তাই কারো হয়তো একদিন হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে মনে হতে পারে, সে ব্যাক্তিগত জীবনে খুবই একা! তার জীবনে সবই আছে,তবুও সে ভীষণ একা। তখন মানুষটার মনে হতে পারে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেই বললেই চলে। কিন্তু সে এই বয়সে এসে নতুন বন্ধু বানাতে গিয়ে বিপাকে পড়ে যায়! ফলে ভুগতে থাকে একাকিত্ব নামক মহামারিতে। আমরা আইফোন কিংবা স্মার্টফোনের যুগে থাকলেও, পঞ্চাশ হাজার বছর আগেরকার মানুষেরা যেমন নিজেদের সঙ্গ পছন্দ করতো, তেমনি রয়ে গেছি এখনো।
দীর্ঘস্থায়ী একাকীত্ব মানবদেহে জন্য সবথেকে অস্বাস্থ্যকর একটা ব্যাপার। এটা আপনার বয়স বাড়িয়ে দেবে দ্রুত, ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াবে অনেকগুণ, Alzheimer’s ঘটবে, ইমিউন সিস্টেম হয়ে যাবে দুর্বল। একাকিত্ব স্থূলতা থেকে দ্বিগুণ পরিমাণে ক্ষতিকর এবং প্রতিদিন এক প্যাকেট সিগারেট খাবার সমান ধ্বংসাত্মক। একাকিত্ব একবার মানবমনে গেঁথে গেলে, সেটা আর ছেড়ে যেতে চায়না।
আমাদের শরীরের ব্যথা আর সামাজিক কোন অবহেলায় প্রাপ্ত ব্যথা একই পেইন মেকানিজম কে উদ্দীপ্ত করে। আমরা ব্যথা পেলে নিজের ভেতরে একটা ডিফেনসিভ ভাবধারার প্রকাশ ঘটাই। তাই একাকীত্ব অনেকদিন ঘিরে থাকলে মানুষ “সেল্ফ প্রিসারভেশন” মুডে চলে যায়। তার আশেপাশের সব মানুষকেই সে ক্ষতিকর ভাবা শুরু করে।
তাছাড়া, একাকীত্বে ভুগলে আমাদের ব্রেইন অনেকবেশি রিসেপটিভ এবং সতর্ক হয়ে যায় সামাজিক কর্মকান্ডে। ফলে একাকীত্বে ভোগা মানুষটি তার আশেপাশের মানুষকে খুব মনোযোগ দিলেও তেমন বুঝে উঠতে পারেনা। সে কাউকে তেমন ভরসা করতে পারেনা এবং সবার প্রতি বিরূপ আচরণ করে। ধীরে ধীরে নিজেকে আগলে রাখার জন্য ব্যক্তি সবার থেকে আলাদা হয়ে আত্মকেন্দ্রীকতায় ভুগে। এটা তাকে ব্যক্তি জীবনে আরো নিরুৎসাহিত, নির্জীব করে দেয়।
একাকীত্ব একটা চক্রের মতো, অনেকেই এই চক্রের গভীরে চলে যায়। নিজেকে ঠিকমতো খুঁজে পায়না আগের মতো। কারো ফোনকল না ধরা, ক্লাসে আলাদা হয়ে চুপচাপ বসে থাকা কিংবা বন্ধুদের সাথে সবগুলো পার্টিকে বাতিল করে দেয়, বন্ধুদের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে দীর্ঘস্থায়ী একাকীত্ব এ ভোগা মানুষেরা।
নিজেকে আয়নার সামনে নিয়ে দাঁড়া করিয়ে আরেকবার ভরসা করার মাধ্যমেই শুরু হতে পারে একাকীত্ব থেকে মুক্তির যাত্রা। এটাকে খুব স্বাভাবিক ধরে নিয়ে, বন্ধ রুমের দরজাকে আনলক করে বাহিরে বেরিয়ে কাছের মানুষগুলোর সাথে কথা বললে, নিজের সমস্যাগুলো তুলে ধরলে একাকীত্ব অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। অন্য মানুষটাকে আক্রমণাত্মক না ভেবে নিজেই কি বেশি চিন্তা করছি কিনা, ভুল মিনিং বের করছি কিনা সেদিকে ফোকাস দেয়া যেতে পারে।
নিজেকে ঠান্ডা মাথায় প্রশ্ন করে দেখা যে, যেভাবে ভাবছি আমরা বিষয়গুলো আসলেই কি তেমনি ঘটেছে আমাদের সাথে অতীতে, নাকি ভাবছিই আমরা বেশি বেশি। বন্ধুদের সাথে থাকার জন্য তারা যখন আপনাকে অনুরোধ করেছিলো, আপনি সেটাকে বাতিল করে দিয়েছিলেন একসময়, তারা কিন্তু এখনো আপনাকে পাশে চায়। খুব কঠিন একাকীত্ব রোধে কাউন্সেলিং নেওয়া গেলে ভালো ফল পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। আমাদের সবার সচেতনতাই পারে কাছের মানুষগুলোকে একাকীত্বের হাত থেকে বাঁচাতে। আমাদের বাড়ানো সহযোগিতার হাতই পারে একটা সুস্থ মনের সুন্দর সমাজ গড়তে।