মানুষের যত রোগ বালাই হয় তার একটা বড় অংশ হয় জীবাণু সংক্রমণের ফলে। জীবাণুর কারণে রোগ হলে জীবাণু বিরোধী ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। যাকে বলে ‘এন্টিবায়োটিক‘ । কোন রোগটা জীবাণুর কারণে আর কোন রোগটা জীবাণুর কারণে নয়, আর জীবাণুর জন্য হলে কোন রোগে জীবাণুবিরোধী কোন ওষুধটি দিতে হবে তা বুঝার জন্যই এমবিবিএস/ বিডিএস কোর্সের ৬ বছর সহ পরবর্তীতে বছরের পর বছর ডাক্তারি পড়তে হয়। যে রোগটির জন্য জীবাণু দায়ী নয় সে রোগের চিকিৎসার জন্য জীবাণু বিরোধী ওষুধ দরকার নাই। চিকিৎসক যখন রোগীকে জীবাণু বিরোধী ওষুধ দেন, তখন সেটি রোগীর শরীরে উপস্থিত রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে হত্যা করে বা জীবাণুটিকে অচল করে দেয়। তার পর রক্ত সেই মরা বা স্থবির জীবাণুকে চূড়ান্তভাবে শরীর থেকে অপসারন করে। রোগী রক্ষা পায়। এক প্রকারের জীবাণু বিরোধী ওষুধ সাধারনত প্রথম থেকে চতুর্থ প্রজন্ম পর্যন্ত ভাগ করা থাকে। প্রথম প্রজন্মের চেয়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের ওষুধ বেশি শক্তিশালী, এভাবে চতুর্থ প্রজন্মের ওষুধ সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী এবং ক্ষমতাধর।
এমবিবিএস/ বিডিএস ডাক্তারেরা সাধারনত চিকিৎসাবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী চেষ্টা করেন রোগীকে প্রথম বা দ্বিতীয় বা একান্ত অপারগ হলে তৃতীয় প্রজন্মের ওষুধ দিয়ে রোগ সারাতে। জীবাণু সাধারনত এক ব্যক্তির শরীর থেকে অন্য ব্যক্তির শরীরে গিয়ে রোগ ছড়ায়। ব্যতিক্রমও আছে। যে জীবাণুর সংক্রমণে ১ম বা ২য় প্রজন্মের জীবাণুবিরোধী ওষুধ প্রয়োগ করলেই যথেষ্ট, সে ক্ষেত্রে রোগীকে ৩য় বা ৪র্থ প্রজন্মের ওষুধ প্রয়োগ করলে জীবাণু সেই ৩য় বা ৪র্থ প্রজন্মের ওষুধটিকে চিনে নেয়। এই ওষুধটির আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সে নিজের খোলস পরিবর্তন করে। ফলে এই জীবাণুটি পরবর্তীতে যেকোন উপায়ে অন্য আরেকজনের শরীরে প্রবেশ করে যখন রোগ সৃষ্টি করে, তখন আগের সেই ৩য় বা ৪র্থ প্রজন্মের ওষুধ এক্ষেত্রে আর কাজ করে না। অর্থাৎ আগেই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ওষুধ প্রয়োগের কারণে এই জীবাণুটি নিজের খোলস পরিবর্তন করে রোগ সৃষ্টি করার নতুন উপায় বের করে নিয়েছে। তাই এখন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ৪র্থ প্রজন্মের ওষুধ প্রয়োগ করেও আর এই জীবাণুকে দমন করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু ৪র্থ প্রজন্মের চাইতে বেশি ক্ষমতাবান নতুন কোন জীবাণু বিরোধী ওষুধও আর আবিষ্কৃত হয় নি! ফলে চিকিৎসাবিহীন মৃত্যুর দিকে ধাবমান হচ্ছে মানবজাতি।
সে কারণে চিকিৎসাবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী ডাক্তার চেষ্টা করেন কম ক্ষমতার ওষুধ ব্যবহার করে যেন রোগীর জীবাণু সংক্রমণের চিকিৎসা করা যায়। কেননা চিকিৎসক হওয়ার কারণে তিনি জানেন যে, শুরুতেই যেকোন রোগীকে উচ্চ ক্ষমতার ওষুধ প্রয়োগ করলে পরবর্তীতে এইসব জীবাণুকে দমন করার জন্য আর কোন ওষুধ থাকবে না। ফলে জীবাণুর কাছে অসহায় হয়ে পড়বে মানুষ জাতি। বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে মানুষ। আবার চিকিৎসক যখন রোগীকে নির্দিষ্ট মেয়াদে ওষুধ সেবনের জন্য উপদেশ দেন, তখন কোন কোন রোগী দেখা যায় রোগ সেরে গেছে মনে করে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই ওষুধ সেবন বন্ধ করে দেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে জীবাণুগুলো তখন সবেমাত্র মরতে শুরু করেছে। তারা অর্ধমৃত অবস্থায় আছে। এমন অবস্থায় রোগী ডাক্তারের পরামর্শ অমান্য করে নিজে থেকে ওষুধ সেবন বন্ধ করার কারণে জীবাণুগুলো পুনরায় জেগে ওঠে । এইবার আগের সেই ওষুধটি আর কাজ করে না। কারণ আগের ওষুধটিকে এই জীবাণু ইতোমধ্যেই চিনে ফেলেছে। ফলে পরবর্তী উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ওষুধ ছাড়া এই রোগীর এই রোগ আর সারে না। কিন্তু যদি ইতোমধ্যেই সরবোচ্চ ক্ষমতাধর ওষুধ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, তাহলে আর কোন ওষুধ না থাকার কারণে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
তাই চিকিৎসকগণ সাধারনত চেষ্টা করেন রোগীকে প্রথম বা দ্বিতীয় বা একান্ত অপারগ হলে তৃতীয় প্রজন্মের ওষুধ দিয়ে রোগ সারাতে। এভাবে কাজ না হলে তখন রোগীর শরীর থেকে বিভিন্ন নমুনা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা হয়, সেখানে কোন জীবাণু দ্বারা সংক্রমণ হয়েছে এবং কোন ওষুধটি সেই জীবাণুটির বিরুদ্ধে কার্যকর। তখন সে ফলাফল অনুযায়ী রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হয়।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে ফার্মেসিওয়ালাদের একটা বিশেষ অংশ নিজেকে দেশের সেরা চিকিৎসক প্রমান করার জন্য বা নিজের ‘হাতের যশ’ দেখানোর জন্য রোগীদেরকে শুরুতেই সরবোচ্চ ক্ষমতাধর জীবাণুবিরোধী ওষুধ প্রয়োগ করে। অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা নির্মম বাস্তবতা। ফার্মেসিওয়ালারা এসব উচ্চ ক্ষমতাধর ওষুধের নাম জানার কথা নয়। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা তাদেরকে এসব ওষুধের নাম জানায়। ফলে যে ওষুধ প্রয়োগ করার আগে ডাক্তারেরা শতবার চিন্তা করেন, সেই ওষুধটি ফার্মেসিওয়ালা নিমিষেই রোগীর শরীরে প্রয়োগ করে। ৪র্থ প্রজন্মের বাইরে ভিন্ন আর একটি সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ওষুধ আছে। চিকিৎসকরা সাধারনত এ ওষুধটি রোগীর নমুনা পরীক্ষা না করে কখনো প্রয়োগ করেন না। কেননা এটা জীবাণুর বিরুদ্ধে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বশেষ অস্ত্র। এই ওষুধটি সাধারনত আইসিইউ , বার্ন ইউনিট, এবং সাধারন ওয়ার্ডে যেসব রোগীর জীবাণু সংক্রমণ ১ম, ২য় বা ৩য় প্রজন্মের ওষুধ দ্বারা নিরাময় হচ্ছে না তাদেরকে দেয়া হয়, নমুনা পরীক্ষা করার পর। এই ওষুধটি প্রয়োগ করার পর সাধারণত ডাক্তারকে তার সহকর্মীদের নিকট অঘোষিত/ অলিখিত জবাবদিহি করতে হয় , কেন কি কারণে এটা প্রয়োগ করা হল?
কিন্তু লোমহর্ষক বিষয় হচ্ছে , ফার্মেসিওয়ালাদের কেউ কেউ ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে নিজের কেরামতি (!) প্রদর্শনের জন্য রোগীকে এই ওষুধটি প্রয়োগ করতে শুরু করেছে! দেখা যায় ডাক্তার রোগীকে ২য় প্রজন্মের ওষুধ লিখেছেন। রোগী ব্যবস্থাপত্র নিয়ে ফার্মেসিতে গেলে ফার্মেসির দোকানে বসা লোকটি বলেন, “ডাক্তার এই সব কি ছোট খাট ওষুধ দিয়েছে আপনাকে, এর চাইতে ভালো ওষুধ তো আমিই দিতে পারি আপনাকে!” এই বলে ফার্মেসিওয়ালা রোগীকে পরবর্তী উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ওষুধ ধরিয়ে দেয়। ফার্মেসিওয়ালার দৌরাত্মের কারণে পরিস্থিতি ডাক্তারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ফলে দিনে দিনে উচ্চ ক্ষমতার জীবাণুবিরোধী ওষুধগুলো জীবাণুর বিরুদ্ধে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে! হুমকির মুখে চলে যাচ্ছে মানব সভ্যতা। ফলে ভবিষ্যতে এমন অবস্থা হতে যাচ্ছে যখন দেখা যাবে জীবাণুর বিরুদ্ধে আর কোন এন্টিবায়োটিক কার্যকর থাকছে না। ফলে বিনা চিকিৎসায় যখন-তখন মারা যাবে মানুষ। বাদ পড়বে না ডাক্তারেরাও! সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ অসহায় হয়ে পড়বে ব্যাকটেরিয়ার কাছে। মহামারী দেখা দিতে পারে!
ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ফার্মেসিওয়ালা যখন নিজের হাতের যশ দেখানোর জন্য রোগীকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে, তখন সেটা হয় গ্যাসের পাশে কোন শিশু যদি আগুন নিয়ে খেলে সে ধরনের বিষয়।
যেসব রোগের সাথে জীবাণুর সম্পর্ক নেই সেসব রোগের সংখ্যা যেমন বেশি, তেমনি সেসব রোগের চিকিৎসার জন্য ওষুধের সংখ্যাও অনেক বেশি। তাই ফার্মেসিওয়ালার পক্ষে এত ওষুধের নাম মুখস্ত করে ‘কেরামতি’ দেখানোর অপচেষ্টা করা সম্ভব হয় না। কিন্তু জীবাণুবিরোধী ওষুধের সংখ্যা তত বেশি নয়। তাই তারা এ বিষয়ে কেরামতি দেখানোর জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ফলশ্রুতিতে হুমকির মুখে চলে যাচ্ছে মানব সভ্যতা!
এমনকি ডাক্তারদের মধ্যে যারা সর্বশেষ ৭-৮ বছরের মধ্যে গ্রামে বা উপজেলা পর্যায়ে কখনো ১ বছর চেম্বার বা চাকুরি করেন নি, তাদের দ্বারা বুঝা সম্ভব না, ফার্মেসিওয়ালারা কিভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে কলুষিত এবং জিম্মি করে রেখেছে। রোগী এবং ডাক্তার উভয় পক্ষই ফার্মেসিওয়ালা আর দালালের কাছে জিম্মি। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে একজন রোগী ফার্মেসি ব্যবসায়ীর কাছে গেলে তাদের অনেকেই এমন ঔষধ দেয় যা ঐ ব্যবস্থাপত্রে লেখা নেই। ফলশ্রুতিতে ভুল চিকিৎসা হয়। বদনাম হয় ডাক্তারের! অপমানের ঝুকিতে থাকে ডাক্তার। তারা যখন তখন রোগীকে বলে , “ডাক্তারের চিকিৎসার কারণে আপনার রিএকশন হয়েছে!” তারপর ডাক্তারের সঠিক চিকিৎসা বাদ দিয়ে নিজের মনগড়া অপচিকিৎসা শুরু করে ফার্মেসি ব্যবসায়ী।
ব্যাথার ওষুধের ক্ষেত্রেও ফার্মেসিওয়ালাদের কেউ কেউ একই অপকর্ম করছে! চিকিৎসাবিজ্ঞানে যেখানে এক মুহূর্তে একটির বেশি ব্যাথানাশক ওষুধ প্রয়োগ করতে নিষেধ করা হয়েছে, সেখানে ফার্মেসিওয়ালা তার কেরামতি দেখানোর জন্য ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির কাছে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর কিছু ব্যাথানাশক ওষুধের নাম জেনে নিয়ে রোগীকে এক সাথে ৪-৫ টি ব্যাথার ওষুধ দিচ্ছে! ফলে ব্যাথা কমে যাচ্ছে দ্রুত! রোগী খুশি, নিজের কেরামতি ফলাতে পেরে ফার্মেসিওয়ালাও খুশি! যেমন ডাক্তারের তেমন রোগী! যেমন রোগীর তেমন ডাক্তার! কিন্তু এ সস্তা চিকিৎসার ফলে রোগীর পাকস্থলী , কিডনী, হৃদপিণ্ড আর রক্তনালীর বারোটা বাজতেছে! সেটা ফার্মেসিওয়ালা আর রোগী , কেউই টের পাচ্ছে না! টের পাওয়ার কথাও নয়। রোগীও ইচ্ছামত খাচ্ছে ফার্মেসি ওয়ালার ওষুধ!
তাদের কারণে আজ মানব সভ্যতা হুমকির মুখে। ফার্মেসিতে ওষুধের ব্যবসা করা একটি সৌখীন হালাল পেশা। কিন্তু সেটা ভুলে গিয়ে তারা যখন নিজেদেরকে দেশের সেরা ডাক্তার প্রমান করার জন্য উঠেপড়ে লাগে তখন সেটা হয় সীমালঙ্ঘন। আইনের প্রয়োগ না থাকার কারণে এই সভ্যতা বিধ্বংসী অপকর্ম চলছে সারা দেশে। নিজেকে সেরা ডাক্তার প্রমানের জন্য অতিমাত্রায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিছু ফার্মেসিওয়ালা।
ডাঃ মোঃ মাকসুদ উল্যাহ
সম্পাদনাঃ তানজিল মোহাম্মাদীন