১.
ইন্টার্ণীর পরপর অভিজাত পাড়ার এক প্রাইভেট হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে চাকরী শুরু করলাম। চাকরীটা আমার না করলেও হত, পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনিং শুরু করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু যেহেতু বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাচ্ছি, এমন সময় বেকার থাকাটা শোভন দেখায় না।
সে যাই হোক, প্রাইভেট হাসপাতালে চাকরী শুরু করলাম এবং সে চাকরীই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। হাসপাতালটিতে একটি নির্দিষ্ট কনসালট্যান্ট এর আন্ডারে জ্বরের রোগী ভর্তি হলেই আমার মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জড়ো হতো, মেজাজটাও বিগড়ে যেতো। কারণ, আমার জানা ছিলো এই রোগীটিকে একটু পরেই অযৌক্তিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি অ্যান্টিবায়োটিক (মেরোপেনেম) প্রয়োগ করা হবে এবং আমাকে ট্রিটমেন্ট শীটে সেটাই লিখতে হবে।
বিনীতভাবে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, অবস্থার উপর ভিত্তি করে প্রাইমারী লেভেলের সিলেক্টিভ অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা যায় কিনা? কনসালট্যান্ট আমাকে বেশ কঠিনভাবে অপমান করলেন। ভালোই হয়েছিলো, আমি রিজাইন লেটার জমা দিলাম এবং ঢাকা মেডিকেলে ট্রেনিং স্টার্ট করলাম। আনন্দের বিষয়, ঢাকা মেডিকেলে আমাকে কখনও এমন অযৌক্তিক অবস্থায় পড়তে হয় নাই।
২.
অভিজাত পাড়ার গল্প বললাম, এবার অজপাড়াগাঁয়ে যাই। বিসিএসে জয়েন করলাম, যেখানে অন্য কোনো সরকারী কর্মকর্তা সহজে পা মাড়ান না, সেখানে যেতে হলো এবং আবারো মেজাজ খারাপ হলো। এক ইনভেস্টিগেশনের খপ্পরে পড়লাম, পরীক্ষার নাম Widal Test।
টাইফয়েড ফিভার সাসপেক্ট হলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা আছে, আর আছে একটা ফালতু পরীক্ষা। Widal Test হলো সেই ফালতু পরীক্ষা। Kumar and Clark’s Clinical Medicine বইয়ে এই ইনভেস্টিগেশন সম্পর্কে বলা আছেঃ
“Serological tests such as the Widal antigen test are of little practical value, are easily misinterpreted and should not be used.”
এবার গ্রাম এলাকায় মেজাজ খারাপ হবার কারণটা বলি। যেখানে আমাদের দেশে এই ইনভেস্টিগেশনের অ্যাকচুয়ালী কোনো মূল্য নাই, সেখানে কারো জ্বর হলেই ফার্মেসীর দোকানদার থেকে শুরু করে পল্লী ডাক্তার, হোমিও ডাক্তার, আয়ুর্বেদ ডাক্তার, ইউনানী ডাক্তার এবং কিছু অ্যালোপেথিক ডাক্তারকেও এই টেস্ট সাজেস্ট করতে দেখলাম। রেজাল্ট একটু বাড়লেই (যেটা আমাদের এই দেশে খুবই স্বাভাবিক) কেল্লা ফতে! টাইফয়েড হয়েছে বলে ১৪ দিনে ২৮ টা থার্ড জেনারেশন অ্যান্টিবায়োটিকের ইনজেকশন স্টার্ট করা হয়। ব্যবসা ভালোই চলে।
৩.
অভিজাত পাড়া গেলো, অজপাড়াগাঁ গেলো। এবার আমার এক আমজনতা বন্ধুর কথা বলি।
বন্ধুর কাশি আর শ্বাসকষ্ট কিছুতেই কমে না। ফার্মেসীওয়ালার কাছে গিয়ে তিনটি ভিন্ন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ইনএপ্রোপ্রিয়েটলী খাবার পরও যখন কাশি থামে না, তখন বন্ধুবর ভীত হয়ে আমার শরণাপন্ন হলো। বন্ধুর কাশি ও শ্বাসকষ্টের কারণ ছিলো অ্যাজমা/হাঁপানী, যেখানে অ্যান্টিবায়োটিকের আসলে কোনো প্রয়োজনই ছিলো না।
৪.
দেশ থেকে বের হই, একটু পাশ্চাত্ত্যে নজর দেই।
বৃটেনের রয়েল কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস্ এর মেম্বারশীপ পরীক্ষা দিতে গেলাম। প্রশ্নগুলো করা হয় রিয়েল লাইফ কেইস বেইজড্ সিনারিওর সাথে সামঞ্জস্য রেখে। ইনফেকশনের টপিক আসলেই প্রশ্নে দেখি রোগীকে ৫-৬ টাকার Amoxicillin, Flucloxacillin টাইপের প্রাইমারী লেভেলের অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রিপশন করা হয়েছে, সে কথা বলা হয়। আমি প্রশ্নের অ্যান্সার দেই আর মিটিমিটি করে হাসি। মনে মনে বলি, “হায়রে গরীব বৃটিশ, বাংলাদেশে আয়। দেখ ব্যাটা, আমরা কত ধনী! আমাদের পাড়ার ফার্মেসীওয়ালাও চিকিৎসা শুরু করে থার্ড জেনারেশনের Cef-3 দিয়ে….”
আমার এক কাজিন থাকে USA তে। কয়দিন আগে তাকে বলেছিলাম প্রেসক্রিপশন ছাড়া প্রাইমারী লেভেলের অ্যান্টিবায়োটিক Amoxicillin যোগাঢ় করতে। উনি যে উত্তর পাঠিয়েছিলেন তা হুবহু আপনাদের কাছে তুলে ধরিঃ
“Dr, I just spoke to the CVS, the largest pharmacy in u.s.a. Any antibiotic has to be prescribed by doctor. No way you can have it without doctor’s prescription. Thanks.”
এইবার যে কাজিন ইটালীতে থাকে তাকে বললাম, “ভাই, একটা কাজ দিব, করতে পারেন কিনা দেখেন। প্রেসক্রিপশন ছাড়া Flucloxacillin কিনে বাসায় আনেন। আমারে ছবি পাঠান…’
২৪ ঘন্টা যাবার পর ভাই রিপ্লাই দিলেন, “প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক!!!পাগল হইছো?”
৫.
অ্যানালাইসিসে আসি। আমাদের দেশের অবস্থা বললাম, পাশ্চাত্যের দেশগুলোর কথাও বর্ণনা করলাম। পার্থক্যটা কি?
পার্থক্যটা হলো, পাশ্চাত্যের কান্ট্রিগুলো যখন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সংযত, আমরা সে ব্যাপারে ততটাই উচ্ছৃংঙ্খল। প্রয়োজন না থাকলেও আমরা অ্যান্টিবায়োটিক খাই, প্রয়োজন থাকলে যে ইনফেকশন প্রাথমিক লেভেলের অ্যান্টিবায়োটিকে সারে, সেখানে আমরা রিজার্ভ ড্রাগকে ব্যবহার করি।
এর ফলাফল শুভ হবার কথা নয়। কিছু কিছু জীবাণুর জেনেটিক কোড দ্রুত পরিবর্তনশীল। রিজার্ভ অ্যান্টিবায়োটিককে যখন আমরা মুড়ি-মুরকির মত ব্যবহার করি, তখন জীবাণুগুলো তাদের চিনে নেয়, নিজের জেনেটিক কোড পরিবর্তন করে সেগুলোর বিরুদ্ধে নিজেকে রেজিস্ট্যান্ট করে গড়ে তোলে, কোনো কোনো জীবাণু ‘সুপারবাগ’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অন্যদিকে একেকটা অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারে যুগের পর যুগও কিন্তু পার হয়ে যায়। তাই, মনে রাখবেন, নতুন নতুন ‘সুপারবাগ’ তৈরি হচ্ছে, নতুন যুদ্ধাস্ত্র কিন্তু সেভাবে তৈরি করা যাচ্ছে না।
ফলশ্রুতিতে আমরা ধীরে ধীরে Post Antibiotic Era-তে প্রবেশ করছি, যেখানে জীবাণু আছে কিন্তু কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক নেই। আমার কথা বাদ দেই, ফুকুদা সাহেবের (Keiji Fukuda, Assistant Director, WHO) কথাকে কোট করিঃ
“A post-antibiotic era — in which common infections and minor injuries can kill — far from being an apocalyptic fantasy, is instead a very real possibility for the twenty-first century….”
এই বছরের শুরুতে খবর পেলাম USA তে সবধরণের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু আত্মপ্রকাশ করেছে, মানুষ তাতে মারাও গিয়েছে। বৃটেনে নাকি বিভিন্ন ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু দিয়ে প্রতিবছর সরকারী হিসেবে ৫,০০০ (বেসরকারী হিসেবে ১২,০০০) রোগী মারা যাচ্ছে।
কেউ কি ধারণা করতে পারছেন অসংযত বাংলাদেশে কি ঘটছে বা ঘটতে চলেছে?
৬.
মাস ছয়েক আগে একটি সায়েন্স ফিকশন মুভি দেখছিলাম। কোনো এক অজানা জীবাণুর আক্রমণে পৃথিবীতে বিপর্যয় নেমে এসেছে, নিজেদের DNA তে আনএক্সপেক্টেড কিছু পরিবর্তনের কারণে একাকীত্বকে সঙ্গী করে কিছু মানুষ জীবাণু থেকে বেঁচে রয়েছে। কি ভয়াবহ! কি নিষ্ঠুর সে একাকীত্ব!
লেখাটা লিখতে গিয়ে মুভিটার কথা মনে পড়লো। যদিও সেটি একটি সায়েন্স ফিকশন মুভি তবুও তা কি বাস্তবে খুব অসম্ভব?
অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে আমরা যেভাবে রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু তৈরির ক্ষেত্র প্রশস্ত করছি, আমি আতঙ্কিত, হয়ত একসময় মুভিটি সত্য হিসেবে আবির্ভূত হলেও হতে পারে।
৭.
একটা হিউম্যান সাইকোলজী বলি, আমরা দৃশ্যমান প্রলয়কে ভয় পাই, অদৃশ্য প্রলয়ের আগমনকে উপেক্ষা করি। এটি হবার কথা ছিলো না, উল্টোটাই হওয়া উচিত ছিলো, দৃশ্যমান প্রলয়ে প্রস্তুতি থাকে, অদৃশ্য প্রলয়ে নয়।
অ্যান্টিবায়োটিকের অযাচিত ব্যবহারে আমরা আস্তে আস্তে Post Antibiotic Era-এর দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছি, প্রলয়বীণা দ্রুতই বাজবে। দরজা উন্মুক্ত হলেই অদৃশ্য প্রলয় তার ধ্বংসাত্মক চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হবে। আমরা ভুলে যাচ্ছি, সে ক্ষমাহীন প্রলয় কোনো নির্দিষ্ট মানবগোষ্ঠীর জন্য নয় বরং সে নির্দয় প্রলয় সমগ্র মানবজাতিকেই গ্রাস করবে।
৮.
সুকান্তের ‘ছাড়পত্র’ কবিতাটি কি আপনাদের মনে আছে? আমি কয়েকটি লাইন মনে করিয়ে দেইঃ
“চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার…..”
মানবসভ্যতার ইতিহাস অগ্রযাত্রার ইতিহাস, ধ্বংস থেকে মাথা তুলে দাঁড়াবার ইতিহাস। সাময়িক সময়ের জন্য এরা মিসগাইডেড হলেও, ইতিহাস বলে, এদের নিজেদের প্রয়োজনে কখনো না কখনো আবার শুভবুদ্ধির উদয় ঘটেছে।