প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৯ জুলাই ২০২০, বুধবার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এ করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া শুরু হয় গত ৪ জুলাই থেকে। তার আগে গত ২৪ জুন থেকে শুরু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোভিড ইউনিটের ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে বলা হয়, কর্মরত চিকিৎসকদের সুরক্ষায় ১৮৬০ এন-৯৫ মাস্ক এবং অন্যান্য মানসম্পন্ন সুরক্ষা সামগ্রীও দেওয়া হবে।
৪ জুলাই(শনিবার) প্রথম ব্যাচের চিকিৎসকরা ডিউটি শুরু করার পর তাদের দেওয়া হয় ৮২১০ এন ৯৫ মাস্ক। তাতেও চিকিৎসকদের কোনও অভিযোগ ছিল না। কিন্তু তৃতীয় গ্রুপের চিকিৎসকরা কাজ শুরু করতেই বাঁধে বিপত্তি। তাদের দেওয়া হয় নকল এন-৯৫ মাস্ক। নকল মাস্কগুলোতে লেখা ভুল, লট নাম্বার নেই। আসল এন-৯৫ মাস্কের সঙ্গে নকল মাস্কও সরবরাহ করেছে সরবরাহকৃত প্রতিষ্ঠান অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল। আর প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে প্রায় ৮০-৯৫ লাখ টাকার মাস্ক নিয়েছে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ।
বিএসএমএমইউ তে কর্মরত একাধিক চিকিৎসক বলেন,
গত শনিবার যখন বিষয়টি হাসপাতাল পরিচালকের নজরে আনা হয় তখন তিনি নকল মাস্কগুলো বদলে দেন। তিনি নতুন করে যেগুলো দেন সেগুলোও নকল ছিল। কোনও রকম স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ছাড়াই নিজস্ব লোকদের মাধ্যমে এসব কেনাকাটা হয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়া হয়নি, মান যাচাই না করে, যাচাই-বাছাই কমিটি ছাড়াই এসব কেনাকাটা সম্পন্ন করেছে কর্তৃপক্ষ।
তারা আরও বলেন,
করোনা ইউনিটে ভর্তি রোগীদের জন্য একেকটি গ্রুপে ৪৫ জন আবাসিক চিকিৎসক থাকেন। তাদের প্রত্যেককে পাঁচটি করে মাস্ক দেওয়া হয় সাতদিনের ডিউটি করার জন্য। তাদের প্রায় প্রত্যেকেই দুই থেকে তিনটি করে নকল মাস্ক পেয়েছেন। এরপর পরিচালককে জানানোর পর সেগুলো রিপ্লেস করে নতুন মাস্ক দেওয়া হয়, কিন্তু রিপ্লেস করা নতুন মাস্কও ছিল নকল। যারা নকল মাস্ক সাপ্লাই দিচ্ছেন তাদের সঙ্গে তো চুক্তি করা, তারা তো সবসময়ই এসব নকল মাস্ক দিতে থাকবে। তাই আমাদের সুরক্ষা বলতে কিছু থাকছে না। মাস্ক ও অন্যান্য পিপিই কেনার সঙ্গে পরিচালক অফিসকে নিযুক্ত করা হয়। যাদের দায়িত্ব ছিল মাস্কের কোয়ালিটি নিশ্চিত করা, তারা ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এত শিক্ষক চিকিৎসক থাকা সত্ত্বেও ‘কোয়ালিটি নিশ্চিতের’ জন্য আলাদা একটি কমিটি করা যায়নি, এটা নিঃসন্দেহে একটি অব্যবস্থাপনা। বিষয়টি নিয়ে তৎক্ষনাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আহমেদ আমিনের ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি, এসএমএস দেওয়া হলেও তার উত্তর দেননি।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার(২৩ জুলাই) রাতে নকল ও ত্রুটিপূর্ণ মাস্ক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় প্রতারণার মামলা করেছেন। মামলায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী শারমিন জাহানকে আসামি করা হয়েছে। তারপর শুক্রবার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) রাত সাড়ে ১০টায় শারমিন জাহানকে শাহবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। এর আগে অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে এর কারণ দর্শানোর জন্য নোটিস দেয়া হলে, তার উত্তরে অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার শারমিন জাহান বিষয়টিকে অনাকাক্ষিত বলে উল্লেখ করেন। বলা হয় নকল মাস্ক সরবরাহ করার কোনো ইচ্ছা তাদের ছিল না। তাদের কাছে যেখানে প্যাকেটজাত অবস্থায় মাস্কগুলো এসেছে সেভাবেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। তবে অভিযোগ পাওয়ার পর পরই তারা সেসব মাস্ক প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিষয়টি অনাকাক্ষিত সে জন্য তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করা হয়েছে।
বিএসএমএমইউ এর সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য কারা দায়ী, এর পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখবে তদন্ত কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেছেন,
“কারণ দর্শানো নোটিসে তারা যা বলছেন তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। বিষয়টি তদন্তের জন্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তিন সদস্যবিশিষ্ট যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তিন কর্মদিবসের মধ্যে তারা যাতে এই বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেন। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই আমরা সিদ্ধান্ত নেব। করোনা মহামারীতে সম্মুখসারির যোদ্ধাদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ধরনের আপস নয়। যারা এই ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।”
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন,
“বিএসএমইউর মতো একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কী করে চিকিৎসকদের নকল মাস্ক দেওয়া হলো এটা গবেষণার বিষয়। কারণ এখানে তো আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেয়নি। তারা নিজেরাই এটা কিনেছেন। পরিচালক বলেছেন, এটা সাপ্লাইয়ার ভুল করেছে। কিন্তু কোন মাস্ক দেওয়া হয়েছে, কত টাকার মাস্ক দেওয়া হয়েছে, তাদের রিকমেন্ডশন অনুযায়ী মাস্ক দিয়েছে কিনা এসব বিষয় কর্তৃপক্ষ দেখেনি কেন? মাস্কের মান যাচাই না করে এগুলো বিতরণ করা ঠিক হয়নি। তারা এখন বলছেন সরবরাহকারী ভুল করেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কী করলো? বিতরণ করার আগে এগুলো দেখা উচিত ছিল। যেখানে প্রতিদিন চিকিৎসকসহ অন্যরা মারা যাচ্ছেন, আক্রান্ত হচ্ছেন, সেখানে এমন ভুল করে সাপ্লাইয়ারের ওপর দায় চাপানো মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়”।
সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন, বাংলাদেশ প্রতিদিন