যুগে যুগে মানুষ নিজেকে আকর্ষণীয় আর সুন্দর করার জন্য অনেক কাজই করেছে। হাল আমল এর মেয়েদের মেকআপ থেকে শুরু করে আফ্রিকান বিভিন্ন উপজাতিদের মুখে টেট্যু আঁকা, প্রাচীন কালের চাইনিজ মেয়েদের পা ছোট করার জন্য লোহার জুতা পরায় রাখা, থাইল্যান্ড ও মায়ানমার কায়ান(Kayan) উপজাতিদের গলায় রিঙ পরে পরে গলা লম্বা করা এ সবই হয় নিজেকে আকর্ষণীয় করার উদ্দেশ্যে অথবা নিজের সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থান তুলে ধরার জন্য। যেহেতু আমাদের শরীরের অন্যান্য অংশের মধ্যে মুখমন্ডল সবার আগে চোখে পরে তাই নিজেকে আকর্ষণীয় করতে দাঁতের ইচ্ছাকৃত পরিবর্তন করাটা অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয়।
আচ্ছা নিচের তিনটি ছবির মাঝে কোন হাসিটি আপনার চোখে সবচাইতে আকর্ষণীয় বলুন তো?
বর্তমান সমাজের অনেক কিছুর সংজ্ঞাই মিডিয়া বানিয়ে দেয় – কোনটা সুন্দর, কোনটা অসুন্দর, কোন স্টাইল হাল ফ্যাশনের আর কোনটা ব্যাকডেটেড এইসব নির্বাচনে মানুষ মিডিয়ার দ্বারা অনেক প্রভাবিত হয়ে থাকে। ফলস্বরূপ কিছু “স্টেরিও টাইপ” জিনিস সৌন্দর্যের আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
এটা অনস্বীকার্য যে একজন মানুষের সামনের দাতগুলোর উপর সৌন্দর্যের অনেকটাই নির্ভর করে। কোন ধরনের শারীরিক অসুবিধা ছাড়াই আমাদের কাছে অনেক রোগী আসেন যাদের হয়ত সামনের দাতগুলো ফাঁকা, আঁকাবাঁকা অথবা অন্য কোন ধরনের ত্রুটিযুক্ত যা তাদের প্রাণ খুলে হাসির ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ।
মায়া সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করা বেশ কিছু মাথার খুলির সামনের দাঁতগুলোতে মূল্যবান পাথরের inlay দেখা যায়। মেক্সিকো আর মধ্য আমেরিকায় পাওয়া এই দাঁতের মাঝে করা ইনলেগুলো এক মহা বিস্ময় ডেন্টাল সার্জনদের কাছে, কারন দাঁতের মাঝে এই ধরনের পাথর লাগাতে হলে অনেক দক্ষতার দরকার, শরীরের সবচাইতে শক্ত অংশ দাঁত বেশ সংবেদনশীলও বটে, অই সময় চেতনা নাশকও ছিল না। ধারনা করা হয় যে এই মূল্যবান পাথরগুলো লাগানো একধরনের প্রাচুয্য আর ক্ষমতার বহিঃ প্রকাশ ছিল। মজার ব্যাপার হল কিছু কিছু খুলি পযবেক্ষন করে এই ধরনের পাথর লাগানো দাঁত থেকে periapical abscess হয়ে যাবার প্রমান পাওয়া গেছে। আবার কিছু কিছু দাঁত থেকে পাথর পরে গিয়ে গর্ত বের হয়ে থাকতে দেখা গেছে। সুতরাং আমরা ইদানিং দাঁতের মধ্যে যে তথাকথিত ডায়মন্ড লাগাই সেটার চর্চা হাজার বছর আগেই শুরু হয়েছিল।
দাঁতের আকার পরিবর্তন করা
আফ্রিকার বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে এখনো এই রীতি প্রচলিত আছে। তারা সাধারনত দাঁতের আকার সুচালো বা অন্য রকম ভাবে পরিবর্তন করে থাকে। এই কাজের জন্য প্রথমে তারা কিছু গাছের রস ব্যাবহার করে যা দাঁতের বহিঃস্থ আবরন এনামেলকে নরম করে ফেলে এরপরে গ্রানাইড বা অন্য কোন পাথরের সাহায্যে ঘষে ঘষে দাঁতের আকার পরিবর্তন করা হয়।
ছবিতে জাভা দ্বীপপুঞ্জে ১৯শতকের শেষ দিকে ব্যবহার হত এমন একটি যন্ত্রপাতির সেট দেখা যাচ্ছে যা দিয়ে সেখানকার আদিবাসীদের সামনের দাঁতগুলোর আকৃতি পরিবর্তন করা হত। যে যন্ত্রগুলো এই কিটে(!) আছেঃ
- গ্রানাইড পাথরের মসৃণ টুকরো – দাঁত ঘষার কাজে ব্যাবহার হত।
- খাঁজকাটা নারিকেল এর খোল – দাঁত ঘষার এবং মসৃণ করার উদ্দেশে ব্যাবহার হত
- বড় ধারালো চাপাতি (!) – এনামেল এর অংশ খসানোর জন্য
- এনামেল এর ভাঙা অংশ।
- গোল কাঠের টুকরো- সম্ভবত যখন দাঁতের অংশ ভাঙা হত বা ঘষা হত তখন ব্যাথা সহ্য করার জন্য রোগী কামড় দিয়ে ধরে রাখার জন্য (!)। এই ধরনের যন্ত্রপাতি দিয়ে যেসব কাজ হত তার কিছু নমুনা দেখুনঃ
সুদানের মরো সম্প্রদায় আবার উপরের পাটির দাঁত এইভাবে সুচালো করার পাশাপাশি নিচের পাটির সামনের দাঁত তুলে ফেলে গলায় মালা মানিয়ে পরে থাকতো (উপরের C ছবি) । মনোবিজ্ঞানীরা এর পেছনে যে কারন ধারনা করেন তা হল নিচের পাটির দাঁতের ফাঁকা জায়গা দিয়ে লাল জিহ্বা দেখা যায় যা বিশেষ ধরনের আকর্ষন অনেকের চোখে। আফ্রিকার কেপ্ টাউনে এখনো এই রীতি প্রচলিত আছে। বিবাহযোগ্য মেয়েরা এইভাবে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলে।অনেক ক্ষেত্রে আবার গাছের নির্যাস মেখে ইচ্ছা করেই এই দাতগুলোকের কুচকুচে কাল বানিয়ে রাখে অনেকে।
দাঁতের মধ্যে রহস্যজনক দাগ
ফিলিপাইনের মেরিয়ানা দ্বীপে কিছু সমাধীতে উদ্ধারকৃত দাতগুলোতে বিভিন্ন ভাবে দাগ টানা দেখা গেছে। এই দাগ গুলোর বিশেষ বিশিষ্ট রয়েছে, ২ থেকে ৬ টি দাগ হয় আড়াআড়ি, ক্রস ও তির্যক এই তিন প্যাটার্নে দেয়া হয়েছে যা আসলে সামাজিক অবস্থান কিংবা সনাক্ত করন চিহ্ন বলে মনে করা হয়।
অফ্রিকার গভীরে বসবাসকারী উপজাতী ছাড়া দাঁত নিয়ে বর্তমানে খুব একটা প্রথা প্রচলিত নেই তবে ব্যাতিক্রম বালি দ্বীপ, সেখানে এখনো হিন্দু বিবাহযোগ্য মেয়েদের একটি ধর্মীয় রীতি পালন করতে দেখা যায়। মেপান্ডিস (Mepandes) নামের সেই অনুষ্ঠানে একজন পুরোহিত কন্যার উপরের পাটির সামনের ৬টি দাঁতের মাথা (incisal edge) ধাতব শলাকা দিয়ে ঘসে দেন। তারা বিশ্বাস করে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষ এর ৬টি পশুসুলভ অনুভূতি ভোতা করে দেয়া সম্ভব, সেই ৬ পশুসুলভ অনুভূতি হল- কাম, রাগ, লোভ, হিংসা, দ্বিধা এবং পাগলামি।
তথ্যসুত্রঃ Nothing buttheTooth A Dental Odyssey by Barry K.B.Berkovitz
সহকারী অধ্যাপক ও ইউনিট প্রধান নর্থইষ্ট মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট, সিলেট